কৃষ্ণগত প্রাণ: প্রথম পর্ব

লেখক: মিত্রা হাজরা


শ্রীকৃষ্ণের প্রিয়তমা মহিষী রুক্মিনী অপেক্ষা করছেন স্বামীর জন্য। শিথিল কবরী বাঁধা গুঞ্জা ফুলের মালা দিয়ে, ললাট চর্চিত কুমকুম আর চন্দনে, পট্ট বস্ত্রে আবৃত দেহ। শ্রীকৃষ্ণ এইমাত্র ফিরলেন গণমুখ্য সভা থেকে, আজ বেশ দেরি হয়ে গেছে তাঁর, এসেই ভোজনে বসলেন।
– ‘এখনো অপেক্ষা কেন প্রিয়ে…তোমার ভোজনও আনিয়ে নাও। দুজনে একত্রে বসে ভোজন করি।’
রুক্মিনী হেসে বললেন – ‘আপনি প্রথমে শুরু করুন আর্য, আমার বিলম্ব আছে। আজ আমি নিজহস্তে পরমান্ন প্রস্তুত করেছি, মিছরি দিয়ে নবনী, আপনার প্রিয় পিষ্টক, মোদক, সকলই আছে, আপনি গ্রহণ করুন।’
শ্রীকৃষ্ণ এখন অপেক্ষারতা মহিষী রুক্মিনীকে নিয়ে একটু কৌতুক করার লোভ সংবরণ করতে পারলেন না।
– ‘কী দেখে আমাকে ভালোবাসলে প্রিয়ে! আমার রূপ! আমার গুণ! না আমার বীরত্ব!’
– ‘জানি না, যবে থেকে আপনাকে দেখেছি, আমি কৃষ্ণগত প্রাণা হয়ে গেছি। তাই তো পত্র দিয়ে আপনাকে অনুরোধ করেছিলাম আমাকে উদ্ধার করতে। শিশুপালের সাথে বিবাহ ঠিক করে দিয়েছিলেন পিতা ও ভ্রাতা। আপনি করুণার সাগর, এত দয়া, মায়া, করুণা আর কোনো রাজপুরুষের মধ্যে পাই নাই। তবে মাঝে মাঝে মনে হয়….আপনাকে যেন আমি পাই নাই। সকলে বলে আপনি ভগবান, কেউ বলেন আপনি পূর্ণ পরমেশ্বর, সমুদ্রের তল আছে, আকাশেরও সীমা থাকা সম্ভব….আপনার না তল, না সীমা, কিছুই খুঁজে পাই না। আপনাকে প্রশ্ন করলে আপনি এড়িয়ে যান। সত্যি করে বলুন তো, আপনি কে?’
শ্রীকৃষ্ণ বললেন – ‘আমি এড়িয়ে যাই না, তুমি বুঝতে পারো না। ঈশ্বর সর্ব জীবে আছেন, সর্বত্র বিরাজমান। তাঁকে ছাড়া আর কি কিছু আছে! শুধু সেটা উপলব্ধি করতে পারে না মানুষ। যার মধ্যে এই বোধ জাগ্রত হয় – সেই শক্তিমান, সেই শক্তি পরিপূর্ণ রূপে যে কাজে লাগাতে পারে…জনকল্যাণে লাগায়, সেই অবতার, সেই ভগবান।’

একটা অভিমান কাজ করে রুক্মিনীর মনে, প্রিয়সঙ্গ বিরহেই তো কাটে তাঁর, তাই মনে ব্যথা আছে, কিন্তু কৃষ্ণ কাছে এলেই সব ভুলে যান রুক্মিনী।

এমন সময় রক্ষী এসে দাঁড়ায়, ‘কোন এক ভিক্ষুক এসে এই অসময়ে শ্রীকৃষ্ণের দর্শন প্রার্থী। যদি মহারাজ হুকুম করেন, একে তাড়িয়ে দিতে পারি।’
শ্রীকৃষ্ণ বলছেন – ‘কী বলছো রক্ষী! কে শিখিয়েছে তোমাকে আগন্তুকদের সাথে এ ব্যবহার করতে? তাঁকে সম্ম্মানে এখানে নিয়ে এসো।’
সেই ভিক্ষুক দ্বারীর সাথে আসতেই শ্রীকৃষ্ণ আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, ‘মিত্র সুদামা, মিত্র সুদামা!’ গভীর আবেশে জড়িয়ে ধরলেন তাঁকে। অশ্রুসজল চোখে ‘কৃষ্ণ কৃষ্ণ’ করতে করতে সুদামা যেন কেমন হয়ে গেলেন… ‘হে কৃষ্ণ তোমার মুরলীধ্বনি যে বৃন্দাবন আর পায় না শুনতে, যমুনাও আমাদের মত দুখী, কেননা সেও কৃষ্ণ কৃপা থেকে বঞ্চিত।তুমি আমাকে চিনতে পেরেছো মিত্র, এই আমার অনেক বড় সৌভাগ্য।’
‘না চেনার কি আছে! গুরু সন্দীপনি ঋষির আশ্রমে আমরা একত্রে বিদ্যা লাভ করেছি। আর তোমাকে এখন ছাড়ছি না’, আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে সিংহাসনে বসালেন, মলিন বসন, পা দুখানি ফেটে রক্তাক্ত। কৃষ্ণ নিজে এবং রুক্মিনী আদর সৎকার করছেন, লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছেন সুদামা।
হঠাৎ মৃদু হেসে বললেন, ‘বন্ধু ঐ চাদরের খুঁটে বেঁধে আমার জন্য কী এনেছ?’
লজ্জা লজ্জা মুখ করে চাদরের খুঁট খুলে কটা নাড়ু বের করেন সুদামা। পরম সন্তোষে সেই নাড়ু খেয়ে, দুটো বাড়িয়ে দেন রুক্মিনীর হাতে, ‘প্রিয়ে খেয়ে দেখো, এ নাড়ু মাতা যশোদার হাতে ছাড়া আর কোথাও খাইনি।’

মুখে শুধু কৃষ্ণ কৃষ্ণ নাম করছেন, আর কাঁদছেন সুদামা, শ্রীকৃষ্ণেরও চোখে জল, আর বিভোর হয়ে তাঁদের দেখে চলেছেন রুক্মিনী।


কৃষ্ণগত প্রাণ: দ্বিতীয় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন


লেখকের কথা: মিত্রা হাজরা
আমি মিত্রা, লেখালেখি করতে ভালোবাসি, কবিতা, ছোটগল্প লিখি মাঝে মাঝে। বই পড়তে ও গান শুনতে ভালোবাসি। পড়ি শংকর এর লেখা, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর লেখা, আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প আমার খুব প্রিয়। জীবনানন্দ দাশ, রুদ্রমুহম্মদ শহিদুল্লা, সুনীল, বিষ্ণু দে এর কবিতা পড়তে ভালোবাসি। আমার লেখা পড়ে আপনাদের ভালো লাগলে বা খারাপ লাগলে অবশ্যই জানাবেন।

3 Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।

লেখা আহ্বান - বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন