অবসাদ দূর করে সুস্থ থাকুন!

লেখক: মিজানুর রহমান সেখ

লকডাউনে গৃহবন্দি অবস্থায় আবালবৃদ্ধবনিতা অধিকাংশেরই সময় কাটানোর রসদ কমেছে,পাল্টে গেছে প্রাত্যহিক রুটিন ও খাদ্যাভ্যাস – যার পরিণতিতে বেশিরভাগেরই মনে অবসাদ কমবেশি থাবা বসিয়েছে । অবসাদ কিংবা বিষণ্নতার পিছনে কাজ করে এক সূক্ষ্ম মনোবৈজ্ঞানিক, শারীরবৃত্তীয় ও সামাজিক প্রক্রিয়া। দিনের পর দিন মন খারাপ, সমস্ত বা অধিকাংশ কাজে অনাগ্রহ, প্রাত্যহিক জীবনের রুটিনে অবহেলা, মেজাজ হারিয়ে মনমরা হয়ে থাকা – এসবই অবসাদের সাধারণ লক্ষণ।

গবেষকরা জানাচ্ছেন অবসাদ জিনগত সমস্যা হতে পারে। সমীক্ষা বলছে পরিবারের কেউ ডিপ্রেশন ডিসঅর্ডারে ভুগে থাকলে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে অবসাদগ্রস্থ হওয়ার সম্ভবনা বেশি। তবে কোন্ জিন থেকে তা হয় এখনো গবেষণায় উঠে আসেনি। মনোচিকিৎসকরা জানাচ্ছেন মস্তিষ্কের বায়োকেমিক্যাল বিক্রিয়ার সমস্যায় অবসাদ আসতে পারে। বিশেষ করে নিউরোট্রান্সমিটারগুলোর কাজের ভারসাম্য বিঘ্নিত হলে অবসাদ আসতে পারে। সেরোটোনিন,ডোপামাইন এবং নরেপাইনফ্রিন (serotonin, dopamine, or norepinephrine) মূলত এই রাসায়নিক বার্তাবহগুলোই আমাদের মন-মেজাজ ভালো রাখে ও অবসাদ দূর করে। এদের কাজের গরমিল হলেই অবসাদ আসে। অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট ওষুধগুলো এই নিউরোট্রান্সমিটারগুলোর উপর কাজ করে।

শরীরে হরমোনের পরিবর্তনে অনেকসময় অবসাদ আসে, বিশেষ করে মেনোপজের সময়, কিংবা গর্ভাবস্থায় ও শিশুর জন্মের সময় অবসাদ আসতে দেখা যায়। এছাড়া থাইরয়েডের সমস্যায় অনেক সময় মানসিক চাপ ও অবসাদ আসতে পারে। আবহাওয়া বদলালেও এই সমস্যা দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে শীতকালে আলস্য, দুর্বলতা ইত্যাদি খুবই স্বাভাবিক।

অবসাদের একটা বড়ো কারণ হলো জীবনের লড়াই ও পরিস্থিতি। প্রিয়জনের ছেড়ে যাওয়া বা মারা যাওয়া, কাজ চলে যাওয়ার আশঙ্কা, প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়া, মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হওয়া কিংবা জীবনের বড়ো কোনো পরিবর্তন যা মেনে নেওয়া মুশকিল – এসবই আমাদের দারুণভাবে অবসাদগ্রস্ত করে তোলে। এই অপ্রীতিকর মানসিক অবস্থায় ব্যক্তি ব্যাপকভাবে কোনো নির্দিষ্ট বিষয় বা কাজে আগ্রহ ও মনোযোগ হারায়।

প্রত্যেকের জীবনে বিভিন্ন সময় নানা ভাবে অবসাদ আসে। বিজ্ঞানীরা সমীক্ষা করে দেখেছেন মহিলাদের তুলনায় পুরুষরা বেশি অবসাদের শিকার হন। এর সাথে জড়িয়ে আছে একাকীত্ব, রাগ, দুঃখ, দুশ্চিন্তা ও আবেগ। শিক্ষা ও সচেতনতা থাকা সত্ত্বেও শুধু মনের জোর কম থাকার কারণে অনেক বিশিষ্ট মানুষই মারাত্মক অবসাদের শিকার হন। কোনো কর্মভার বা অভিজ্ঞতা যদি আগে থেকেই নিশ্চিত ও পুনরাবৃত্তিমূলক হয়, তাহলে তা একঘেয়েমি ডেকে আনে। কোনো কাজের গতির সাথে ব্যক্তির দক্ষতা মিশে গেলে এবং কাজটির উদ্দেশ্য পরিষ্কার বোঝা গেলে সহজে অবসাদ আসে না। বিপরীতক্রমে কাজ দীর্ঘদিন ধরে করলেও যদি প্রতিসংকেত (feedback) না আসে তবে সেই কাজ একঘেয়েমির কারণ হয়। ঝুঁকি-মুক্ত ও চিরাচরিত কাজ একদিকে যেমন অনেকের পছন্দের তেমনি নতুন ও উৎসাহব্যঞ্জক কাজ আবার অনেকে পছন্দ করেন।

যাঁদের আত্মসচেতনতা কম, নিজের ইচ্ছা ও আকাঙ্খা প্রকাশ করতে পারেন না, প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে যাওয়ার মানসিক চাপ নিতে পারেন না, বিশেষত যাঁরা এ.ডি.এইচ.ডি (attention deficit hyperactivity disorder) তে ভুগছেন তাঁদের অবসাদ সহজেই আসে । বাহ্যিক উদ্দীপকের উপর বেশি মাত্রায় নির্ভরশীল হলে আত্ম-পরিতৃপ্তির ক্ষমতা কমে, ফলে বিষণ্নতা আসে। স্ব-শাসনের অধিকার থাকে না বলে, ইচ্ছে পূরণ ও স্বাধীনতার সুযোগ কম হওয়ায় কিশোর-কিশোরীদের অবসাদে বেশি ভুগতে দেখা যায়।

আবার অনেক গবেষক মনে করছেন অবসাদ আধুনিক জীবনের বিলাসিতা। মানুষের জীবন জীবিকার লড়াই করতে গিয়ে জয়-পরাজয়, উত্থান-পতন মেনে নেওয়ার মতো মানসিক ক্ষমতা না থাকলে অবসাদ আসতে পারে। পারিপার্শ্বিক সমালোচনা ও নিন্দা সহ্য করতে না পেরে বিশেষকরে মনের ভাব আদান প্রদান করার লোকের অভাবে অবসাদগ্রস্ত মানুষ আত্মহননের পথ বেছে নেন।

ভীষণ মাত্রায় অবসাদগ্রস্ত হলে মনোবিজ্ঞানী ও চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরী। আলাপচারিতা ও ওষুধের মাধ্যমে অবসাদের চিকিৎসা করা হয়। প্রাথমিকভাবে ঘুম না হওয়া, হতাশাগ্রস্ত ও মনমরা হয়ে সারাদিন একাকী থাকার চেষ্টা, হজমে সমস্যা, খিদে কমে যাওয়া, দুর্বলতা, সহজে মিশতে না চাওয়া ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য দেখলে পরিবারের লোকজন দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন।
এখানে অবসাদ কাটানোর কিছু সহজ উপায় নিয়ে আলোচনা করা হলো:

  • নিয়মিত ডিপ ব্রিদিং এক্সারসাইজ করুন। এই পদ্ধতি চর্চা করতে আপনার পছন্দের যেকোন আরামদায়ক জায়গায় বসুন। হাতদুটো হাঁটুতে রাখুন। ঘাড় থাকবে সোজা। এবার নাক দিয়ে গভীরভাবে প্রশ্বাস নিন। ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস ছাড়ুন। প্রতিবার দম ছাড়ার পর ১-২ সেকেন্ড অপেক্ষা করুন। আবার ধীরে ধীরে গভীরভাবে প্রশ্বাস নিন। এই সময় ১ থেকে ৫ পর্যন্ত গুণতে থাকুন। ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস ছাড়ুন। ছাড়ার সময় ১ থেকে ৭ পর্যন্ত গণনা করুন। এভাবে ১০ বার করলে হবে এক রাউন্ড। এতে শরীর দ্রুত আরাম পেতে শুরু করবে। ক্লান্তি, অবসাদ মুক্ত হয়ে অনেকটা স্বস্তি আসবে। ঘুমের সমস্যা হলে বিছানায় শুয়েও একই নিয়মে ‘ডিপ ব্রিদিং’ চর্চা করতে পারেন। শরীর ‘রিলাক্সড’ হয়ে কখন যে আপনি ঘুমিয়ে যাবেন তা টেরও পাবেন না।
  • ভোরে যখন পৃথিবী শান্ত থাকে, বায়ুতে দূষণ কম থাকে এবং লোকজনের আনাগোনা কম থাকে, তখন হাঁটুন। মাস্ক পরেই বাড়ির আশপাশে কিংবা ছাদেও হাঁটতে পারেন। এতে মন শান্ত হয়।
  • সেল্ফ ডেভেলপমেন্ট এর উপর ভালো কিছু বই পড়তে পারেন। ইন্টারনেট থেকে রিভিউ পড়ে কিনতে পারেন। এখন ই-বুক সহজেই পাওয়া যায়। একটা ভালো বই হাজার বন্ধুর থেকে উত্তম।
  • নিজের উপর আস্থাবান হন। একা এসেছেন একাই যেতে হবে। একা বাঁচার রসদ জোগাড় করুন। প্রয়োজনে ধর্মীয় আচারগুলো হুবহু করার চেষ্টা করুন। ধর্মের মোহ মানুষকে পার্থিব আশা আকাঙ্খা থেকে অনেকটাই দূরে নিয়ে যায়।
  • অহেতুক ইলেকট্রনিক ডিভাইস নিয়ে পড়ে থাকবেন না। বিশেষকরে সোশ্যাল মিডিয়ার অলীক জগতের হাতছানি থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করুন। প্রয়োজন হলে ফোন করে কথা বলুন। ইমোশনগুলো ইমোজি দিয়ে প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকুন। যে বিষয় নিয়ে আলোচনা করে সমাধান করা যাবে না, তা নিয়ে অহেতুক বেশী চর্চা করবেন না।
  • নিজের খাবারদাবার সম্পর্কে সজাগ হোন। প্রয়োজনে ইন্টারনেট থেকে রিসার্চ করে নিজের ডায়েট নিজে প্ল্যান করুন। নতুন ডিশ রান্না করুন। রান্নার চেষ্টা করতেই পারেন এতে সময়ও কাটে মনও ভালো হয়।
  • নিজেকে নিজের কাছে ভালো লাগলেই হবে। অন্যের চোখে ভালো হওয়ার বেশি চেষ্টা করবেন না। এপিয়ারেন্স নিয়ে সচেতন হোন। সাজলে মন ভালো থাকে। তাই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকার চেষ্টা করুন।
  • এখন যদি আপনার ছাত্রজীবন চলে তবে পড়ালেখায় মোটামুটি ভালো রেজাল্ট করার চেষ্টা করুন। টপার সবাই হবে না। হবার দরকারও নেই। নিজের সাধ্যমতো ভালো করার চেষ্টা করতে হবে। জীবনের জন্য শিক্ষা। পড়াশোনার অভ্যাস হয়ে গেলে রেজাল্ট এমনিতেই ভালো হবে।
    অভিভাবকরা নিজেদের স্ট্যাটাস দেখানোর জন্য সন্তানদের ইঁদুর দৌড়ে ঠেলে দেবেন না। নিজেদের অপূর্ণ ইচ্ছা তাদের উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয়।
  • FOMO বা fear of missing out – এই চিন্তা ছাড়তে হবে। সবাই যা করবে আপনাকেও তাই করতে হবে এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। প্রত্যেকেই এক একটা হীরের টুকরো শুধু চিনতে সময় লাগে। আর চেনার পর সঠিকভাবে পরিচর্যা ও ঠিক দিশায় চালনা করতে হয়। তাহলেই সাফল্য আসে।

বর্তমানে বিষণ্নতা বা অবসাদের প্রধান কারণ হলো চাপ। এই চাপ শরীরে অতিরিক্ত অ্যাড্রেনালিন ও অন্যান্য হরমোনের নিঃসরণ বাড়িয়ে দেয়। এতে হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায় ও শরীরে শক্তির জোগান বেড়ে যায়। কিন্তু এই অতিরিক্ত শক্তি আমাদের অবসন্ন করে তোলে। কিছু নির্দিষ্ট ওষুধও ক্লান্ত বা অবসাদগ্রস্ত করে তুলতে পারে। এসব ওষুধের মধ্যে রয়েছে অ্যান্টি হিস্টামিন, উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ এবং কাশি নিরোধক ওষুধ। বিষণ্নতা বা অবসাদ কাটিয়ে ওঠার প্রথম চেষ্টা নিজেকেই করতে হবে। পরিবার ও শুভাকাঙ্খীদের সাথে আলাপ আলোচনা করেই তা সম্ভব। অবসাদের মাত্রা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে গেলে চিকিৎসা ও মনোবিজ্ঞানীদের সাহায্য নিতে হবে।


লেখকের কথা: মিজানুর রহমান সেখ
মিজানুর পেশায় শিক্ষক এবং একজন সমাজসেবক। বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার জন্যই মূলত লেখালিখি। লেখক পদার্থবিদ্যা ও শিক্ষাবিজ্ঞানে মাস্টার্স।

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

3 Comments

  1. মিজানুর

    খুব বেশি ধার্মিক হয়ে গেলে,মোক্ষ লাভের চিন্তা চলে আসে তাই বাস্তব আশা আকাঙ্খা পূরণ হলো কি হলোনা-এগুলোর অর্থ থাকে না।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।