লেখক: রুবাই শুভজিৎ ঘোষ
আমার এক আত্মীয় আছে। তার নিজের যথেষ্ট বিদ্যা বুদ্ধি, দৃঢ়তা, ব্যক্তিত্ব সবই আছে। সে নিজের ক্ষমতায় নিজের একটা জায়গা বানিয়ে নিয়েছে। কিন্তু সমস্যাটা হল অপরের ভালো সে সহ্য করতে পারে না। বিশেষ করে তার মেজ ভাইকে। তার মেজ ভাইটি নিপাট ভালোমানুষ। সে একটা পার্টির সাথে যুক্ত এবং ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো টাইপের সে লোকের সেবা করে বেড়ায়। এই নিয়ে তার বেশ নামডাকও আছে এলাকায়। তো এই বিষয়টা তার দাদার একদমই হজম হয়না। সে মানে দাদাটা ভাইকে পৈত্রিক সম্পত্তির কোনো ভাগ না দিয়ে নিজেই পুরোটা হাতিয়ে নিয়েছে। ভাই কিছু বলেওনি, দাদাকে সে সব সম্পত্তি ছেড়েই দিয়েছে। কিন্তু যখন এই মেজ ভাইয়ের ছেলে সম্পূর্ণ শূন্য থেকে শুরু করে নিজেরও আলাদা একটা প্রতিপত্তি নিজেই বানিয়ে ফেলেছে, তখন তার জ্যাঠা কিভাবে তার ভাইপোর বানানো সম্পত্তিও হাতানো যায় তাই ভেবে ভেবে কাহিল হয়ে পড়েছে। নিজে এত সম্পত্তির মালিক হয়েও সে ভাইপোর সুখ সহ্য করতে না পেরে প্রায় অসুস্থই হয়ে পড়েছে।
আসলে কিছু মানুষ থাকে, তারা নিজের কাছে যাই থাক না কেন, তা নিয়ে একদমই খুশি হয় না, যতটা খুশি হয় অন্য কাউকে কষ্ট পেতে দেখলে। এদের গোটা দুনিয়া শাসন করতে দিলেও তাদের আক্ষেপ, ওই লোকটা কেন ভালো আছে, ওই লোকটা কেন শান্তিতে আছে। বাহুবলী সিনেমাটায় ভল্লাল দেবের চরিত্রটা হল অনেকটা এরকম। নিজের মুখেই সে বলেছে সে এই কথা। বাহুবলী ২ সিনেমাটায় শেষের দিকে সে তার বাবা বিজ্জল দেবকে বলছে , “আমি ভাবতাম এই সোনার মূর্তি, সোনার মুকুট, এই সিংহাসনে বোধয় আমার শান্তি। আসলে তা না। এই শিকলে দেবসেনাকে কষ্ট পেতে দেখলে তবেই আমার শান্তি। এখন এই শিকল আছে, কিন্তু দেবসেনা নেই। সে মুক্ত। আর তাই ভেবে ভেবে আমার মাথার শিরা ফেটে যাচ্ছে। “
শুধু এই বৃদ্ধ বয়সেই না, যৌবনেও যখন ভাই বাহুবলীকে সরিয়ে সে রাজা হয়েছিল তখনও কিন্তু শান্তি পায়নি। কারণ সিংহাসনে না বসলেও মানুষের মনে কিন্তু বাহুবলীই আছে, সব মানুষ তাকেই চায়। ভল্লাল দেব তাই মুকুট পেয়েও শান্তি পায় না। ভাইকে চক্রান্ত করে রাজপ্রাসাদ থেকে বার করে দেয়। কিন্তু বাহুবলী সাধারণ মানুষের মাঝে থেকেও তাদের নিয়ে সুখে থাকে। ভল্লাল তা দেখে সহ্য করতে পারে না, তাকে মারবার চক্রান্ত করে তারপর। ভল্লালের এই স্বভাব সে পেয়েছে তার বাবা বিজ্জলের কাছ থেকে। সে মায়ের থেকে সৎশিক্ষা পেলেও, বেশিরভাগ সময় সে কাটায় বাবার সাথে। আর কথায় আছে না সঙ্গ ভাল হতে হবে। তো বাবা আর তার কিছু পেটোয়া লোক আছে, যাদের সঙ্গে সে থেকেছে এবং কোনও সৎবুদ্ধি তাদের থেকে সে পায়নি। আর বাবার হিংসা, বাবার সিংহাসন না পাওয়ার ক্ষোভ তার মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে ধীরে ধীরে।
যদি বিদ্যা বুদ্ধি শক্তির বিচার করা হয়, তাহলে কিন্তু ভল্লাল পিছিয়ে নেই বাহুবলীর থেকে। সেটা দেখানো হয়েছে বাহুবলী ১ সিনেমাতে। যখন দুজনই যুবরাজ অবস্থায় তাদের শিক্ষা প্রায় সম্পূর্ণ করে ফেলেছে, তখন কটপ্পার প্রশ্ন, “অস্ত্রবিদ্যা আর শাস্ত্রজ্ঞানে দুজন যুবরাজই সমান। তো আমাদের মহারাজ কে হবে আপনি কিভাবে সিদ্ধান্ত নেবেন?” বাহুবলী ১ সিনেমাটায় যখন ভল্লাল দেবকে প্রথমবার দেখানো হয়, তখন সে একটা বুনো ষাঁড়, যাকে কিনা অনেকগুলো সৈনিক একসাথে কাবু করতে পারছে না, তাকে কিভাবে একাই সে কাবু করে ফেলে, সেটা দেখানো হয়েছে। সেখান থেকেই প্রমাণিত হয় তার শক্তি সম্বন্ধে। এরপর কালকেয় সৈনিকদের সাথে যুদ্ধের সময় সে তার বীরত্ব প্রমাণ করে। আবার যখন তার কয়েদ থেকে শিবারা দেবসেনাকে ছাড়িয়ে নিয়ে গেছে, সে তখনও শিবাদের হারিয়ে আবার দেবসেনাকে বন্দী করে নিজের যুদ্ধ পারদর্শিতা প্রমাণ করেছে। শেষের দিকে যখন শিবা আর তার যুদ্ধ বাধে, প্রথমেই কিন্তু শিবা তাকে কাবু করতে পারে নি। কারণ ভল্লাল দেব রীতিমত বড় একজন যোদ্ধা।
আর যদি রাজনৈতিক বুদ্ধির কথাই বলা হয়, সেটা আমরা দেখতে পাই বাহুবলী ২ সিনেমাটায়। সে তার মা ওরফে রাজমাতা শিবগামীর কাছে নিজেকে ধীরে ধীরে মহানহৃদয় একজন মানুষ প্রমাণ করে, সাথে বাহুবলীকে ছোট করে দেয়। তারই রাজনৈতিক চক্রান্তের শিকার হয়ে তার মা, বাহুবলীকে হত্যার নির্দেশ দেয়। তারই চক্রান্তে বাহুবলী সিংহাসন হারায়, তারপর হারায় রাজপ্রাসাদে থাকবার অধিকার, এবং সর্বশেষে হারায় নিজের প্রাণ। কিন্তু তার রাজনৈতিক বুদ্ধি থাকা সত্ত্বেও সে একজন মহান রাজা, ভাল শাসক হয়ে উঠতে পারে না। সে কখনও বাহুবলী হতে পারেনি, কারণ তার মন, তার হৃদয়। বাহুবলীর মত বিশাল হৃদয় তার নেই। সকলকে ভালবেসে তাদের সুখ দুঃখ বোঝার ক্ষমতা তার নেই। সে শুধু আধিপত্য চায়। সে ভাবে সিংহাসনে বসলেই রাজা হওয়া যায়।
ভল্লাল মানুষের কষ্ট বোঝে না, বুঝতে চায় না। অপরপক্ষে সে কষ্ট দিতে জানে, অপরের কষ্টে আনন্দ পায়। কেউ সুখে থাকলে সে কষ্ট পায়। আর তাই নিজের পতন সে লিখে ফেলে নিজেই। মানুষকে কষ্ট দিয়ে বেশিদিন সুখে থাকা যায় না। ২৫ বছর সে অত্যাচারের রাজত্ব করে। কিন্তু তারপরে নেমে আসে তার পতন তার ভাইপোর হাত ধরে। তার রাজনৈতিক বুদ্ধি, তার বল কোনও কিছুই তাকে বাঁচাতে পারে না। এই রকম মানুষদের পতন অনিবার্য। সব যুগেই এদের গল্প একইরকম।
লেখকের কথা: রুবাই শুভজিৎ ঘোষ
লেখকের জন্ম পশ্চিমবাংলায়। পেশায় একটি বহুজাতিক সংস্থার তথ্যপ্রযুক্তিবিদ। নেশায় লেখক এবং পরিচালক। বাঙালির জনপ্রিয় ওয়েবসাইট সববাংলায় এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তিনি। কবিতা থেকে শুরু করে গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস, চিত্রনাট্য সবকিছুই লিখতে ভালবাসেন। লিটিল ম্যাগাজিন থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক বিভিন্ন ম্যাগাজিনে নিয়মিত লিখেছেন। স্রোত থেকে প্রকাশিত তাঁর কবিতার সংকলন দৃষ্টি এবং বালিঘড়ি। এছাড়া তথ্যচিত্র, শর্ট ফিল্ম বা অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের ভিডিও পরিচালনা করেন। ধর্ম এবং বিজ্ঞান তাঁর প্রিয় বিষয়। ভ্রমণ তাঁর অন্যতম শখ। অন্যান্য শখের মধ্যে রয়েছে স্কেচ, ফটোগ্রাফি, ছবি ডিজাইন করা।