বৌ পুতুল

লেখক : মানব মন্ডল

দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বারুইপুরের শিখরবালি গ্রাম, বিখ্যাত মৃৎশিল্পী মহিতপালের বাড়ি।কথায় বলে “মাটি টাকা, টাকা মাটি” কিন্তু মৃৎশিল্প আজ মুল্য পায় না। বারুইপুর, কাছে শাসন নাম শুনেছেন। সেখানের কাছে , শিখরবালি, পালপাড়া আমাদের গন্তব্য। পথে বহু বাড়ি চোখে পড়বে যেখানে মাটির টব, মালসা, হাড়ি, প্রদীপ স্টেন্ড, ঘট, তৈরি হচ্ছে। কিন্তু আমার খোঁজ বৌ পুতুল।ছাঁচ তৈরি হয় কিছু পুতুল, তবে কিছু পুতুলগুলি হাতে টিপে টিপে ও তৈরি, তবে আগুনে পুরিয়ে পরে রঙিন করে করা হয়। পুতুলগুলি নির্মানে গ্রামীণ ছোঁয়া আছে।

বারুইপুর কাছে, শিখরবালি পালপাড়ায় এখানে তৈরি হতো আগে, ঘরে ঘরে।আজ তা হয় মাত্র দুইটি ঘরে। শিয়ালদহ থেকে লক্ষীকান্তপুর ডাউন লোকাল ধরে বারুইপুরের পরের স্টেশন শাসন৷ সাইকেল ভ্যান ও অটো করে শিখরবালি গ্রামে গ্রামের পালেদের শীতলামন্দিরের সামনে নেমে উল্টো দিকে পাড়াতুতো রাস্তা ধরে একটু এগিয়ে স্থানীয় মানুষ দেখিয়ে দেবে বাড়িটা। এলাকায় এখানে প্রায় সব বাড়িতে মাটির জিনিস পত্র তৈরি হয়। আগে কম বেশি সব পালপরিবারের মহিলারা, বৌপুতুল এবং পুতুল বানানোর সাথে যুক্ত ছিল৷ এখন যদিও দুইটি ঘর পুতুল বানায়। এক দিদা, আর বয়স্ক স্বামী-স্ত্রী তারা অবশ্য এখন অসুস্থ। গ্রামে আর কেউ এই বউপুতুল বানায় না৷

তাই হয়তো মাটির পুতুলগুলি দ্রুত হারিয়ে যাবে। শিল্পীরা অর্থনৈতিক কারনে, বাজারের অভাবে, অপ্রকাশ্যে বিক্রেতার অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে শিল্প।

কারণ গ্রামীণ মেলা গুলো একমাত্র নির্ভর করে থাকে এরা। তাই শুধু ডাসা পিয়ারা জন্য নয় , মৃৎশিল্প জন্য একটা প্রচারের আলোয় আসা উচিত শিখরবালিকে।

আবার শিখরবালির কথা বলতেই হয়।১৭০০ খ্রীষ্টাব্দে বারুইপুরের শিখরবালি গ্রাম কথা শোনা যায়। জগাদি ঘাটায় নদীর দুপাশে ঘনবন জঙ্গল পরিষ্কার করে গড়ে উঠেছিল জনবসতি ধনবেড়িয়া গ্রাম। এলাকায় বার বার মহামারী হয়ে প্রচুর মানুষের মৃত্যু হয় ।আশে পাশের অনেক গ্রাম মানুষ শূন্য হয়ে যায়। ডাক্তার বৈদ্য কোথায় তখন ।মহামারী রোগকলেরা, হাম, বসন্ত, সাপের কামড়ে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচতে সেই সময় গ্রামের মোড়ল মাতব্বররা ঠিক দেবদেবীকে সন্তুষ্ট করে পূজো দিলেই এমন সব বিপদের হাত থেকে নিস্তার মিলবে। ২০০ বছর আগে গ্রামবাসীরা এলাকার মোড়লরা মাতব্বরদের নিয়ে জগাদিঘাটায় জঙ্গল লাগোয়া নদীর তীরে একটি বট ও অশ্বথ গাছের নীচে পুরাতন সুন্দরবনে প্রাচীন লৌকিক দেবদেবী প্রকৃতির ‘মা শীতলা’ পূজা শুরু করেন। সাথে সুন্দরবনের বাদাবনের লৌকিক দেবদেবী ‘ঘন্টাকর্ণ’(শীতলার স্বামী),‘জরাপাত্র ও বসন্ত’(শীতলার দুই পুত্র), ‘রক্ত প্রতীম’(শীতলার দাসী), ‘মনসা’ ,‘বনবিবি’ , ‘সজঙ্গুলি’ , ‘পদ্মাবতী’ , ‘পঞ্চানন’ , ‘দূর্বাবতী’ , ‘কালী’ সহ দেবদেবীরা পুজো পাওয়া শুরু করলেন।উল্লেখ্য ফকির সম্প্রদায়ের এই জগাদি ঘাটে বনবিবি পূজা করে থাকেন । নিয়ম অনুযায়ী এই পুজোর দিনে এলাকার প্রতিটি পরিবারে অরন্ধন পালিত হয়।

ঐতিহাসিক জগাদিঘাট থাকলেও প্রবাহমান নদী মজে গিয়েছে।তবে প্রাচীন সেই বটবৃক্ষ আজও দাঁড়িয়ে আছে। মানুষজন নানান সমস্যা,বিপদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য প্রাচীন বট গাছে আজও মানত করে কাপড়ের  গিঁট (আঞ্চলিক ভাষায় “মুদো”) বেঁধে আসেন। উদ্ধার হলেই পুনরায় সেই কাপড়ের গীট খুলে যাঁকজমক ভাবে পুজো দিয়ে থাকেন।

যাইহোক আমি শিখরখোলা এসেছি বৌপুতুলের খোঁজে। এখানে পালরাও শীতলা মন্দির তৈরি করেছিল তবে সেটা ১৯৪০ সালে।

শিখরবালির ঐতিহ্যবাহী নিদর্শনের এক প্রতিফলন এই শীতলা মন্দিরগুলি।

এখানে মনাসা পূজাও বিখ্যাত।শিখরবালি তুলোরবাদা মনসা মায়ের পূজাতে বিশাল নরনারায়ণ সেবার আয়োজন করা হয়। শিখরবালির সমগ্র অধিবাসীবৃন্দের রইল আমন্ত্রণ।মহাদেবের মানস কন্যা ও সর্প কুলের অধিষ্ঠাত্রী দেবী মা মনসা । সাপের সঙ্গেই ঘর করতে হয় গ্রামগঞ্জের মানুষকে, তাই মনাশা পূজা র চল আছে এখানে।আগের রাতে অমাবস্যা তিথি তে বাড়ির সবাই একত্রিত হয়ে সারা রাত ধরে কুটনো, বাটনা, রান্না ও পর দিন মা মনসাকে নিবেদন করে তবে খাওয়া। বাংলার নিতান্তই এই আন্তরিক অরন্ধন ব্রত বা রান্না পূজা । জগদ্ধাত্রী পূজা, হয় ।এখানে এখনো চলে, বারোমাস তেরো পার্বণে চলে গ্রামীণ মেলা , যা এই অঞ্চলের পুতুল শিল্পের ফুসফুস বলা চলে।

প্রসঙ্গত বলি বৌ সাথে দেখালাম পুতুল দেখে আছে কৃষ্ণ তৈরি হচ্ছে। এটি একটি বৈষ্ণব প্রভাবিত অঞ্চল, বৌ পুতুলকে ভালোভাবে দেখলে দেখা যাবে, এই গুলো বাঙালি মেয়ে নয়। এরা গোপীনী।


লেখক পরিচিতি : মানব মন্ডল
মানব মন্ডল, স্বপ্ন অনুঘটক নামে একটি ত্রৈমাসিক পত্রিকার সম্পাদক হিসাবে সাহিত্য জগতে হাতেখড়ি

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।