ডাইনোসরের ডিম

লেখক : রুবাই শুভজিৎ ঘোষ

আজ আবার জগার সাথে নদার একচোট ঝগড়া হয়ে গেল। কারণটা রোজকার মত সেই একই। কেন মুরগীদের ডিম যে মাপের হয়, তার থেকে বড় মাপের হবে না! জগা বাজারে ডিম বেচে। আর নদা পাড়ার মোড়ে একটা ফাস্ট ফুডের দোকান চালায়। তার স্পেশাল আইটেম সবই ডিমের। ডিমসেদ্ধ, ডিমের পোচ, ডিম পাউরুটি, অমলেট, এগরোল, এগপকোড়া আরও কত কী! রোজ সকালে নদা ডিম কিনতে এসে জগার সাথে ঝগড়া করে যায়।নদার বক্তব্য মুরগীর ডিমের সাইজ বাড়ছে না কেন? চাল ডালের দাম তো বাড়ছে। জগা আজও বুঝিয়ে বলল তাকে, “কত্তবার বলেছি তোমায়, এর থেকে বড় সাইজ পাবেনি গো!”
“পাবো না মানে! মুরগীদের খাওয়াস না কেন ভালো করে?”, নদা চেঁচিয়ে ওঠে।
সকালে যারা বাজার করতে আসে সবাই দাঁড়িয়ে দেখে ওদের ঝগড়া। অনেকে নদাকে দুএকবার বোঝাতেও গেছিল যে ডিমের আকার ঠিকই আছে। কিন্তু তারপর নদা তার দুহাত দিয়ে যে আকার দেখিয়েছিল, সেটা ডিমের না, তরমুজের। তার ওরকম বড় ডিম চাই। তারপর থেকে কেউ আর বোঝাতে যায় নি। জগার সাথে নদার ঝগড়া তাই বাজারে একটা রোজকার সাধারণ ঘটনা। রোজকার মতই ঝগড়া শেষে জগার থেকে ডিমগুলো কিনে নদা বাড়ির পথ ধরল। কিন্তু মাঝপথে থামতে হল তাকে। রাস্তাটা ইলেকট্রিক সাপ্লাইয়ের লোকেরা খুঁড়েছে, এদিক দিয়ে যাওয়া যাবে না এখন। অতএব দস্যিবুড়োর মাঠ ধরেই যেতে হবে এখন তাকে।
দস্যিবুড়োর মাঠের পাশেই বাস এক পাগলা প্রফেসরের। আসল নাম প্রফেসর তারকেশ্বর দাস, তবে সবাই এখন তাকে প্রফেসর পাগলাদাস বলেই ডাকে। নদা তার বাড়ির সামনে সবে এসেছে, এমন সময় বাড়ির ভেতর থেকে ডাক এলো, “নদা নাকি?”
“এই রে পাগলটা ধরল আবার!” মনে মনে ভাবল নদা। মুখে উত্তর দিল, “আজ তাড়া আছে আসলে! পরে আসব”
বাড়ির ভেতর থেকে ততক্ষণে বেরিয়ে এসেছে প্রফেসর পাগলাদাস। নদার হাত ধরে টেনে তাকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে যেতে যেতে বলল, “আজ তোমায় টাইম মেশিনটা না দেখিয়ে যে ছাড়ছি না! তিনমাস হল এদিক দিয়ে যে কেউ যাচ্ছেই না, দেখাই কাকে!”
“আবার কি সব বানিয়েছে রে বাবা! আর আমাকেই পেল বলির পাঁঠা!” মনে মনে এইকথা চিন্তা করতে করতে প্রফেসরের বাড়িতে ঢুকল নদা। প্রফেসর একটা হলঘরে নিয়ে এলো তাকে। ছোট রান্নাঘরের মাপের একটা বড় কাঠের বাক্সের মত দেখতে একটা বাক্স দেখিয়ে প্রফেসর বলল, “এই হল আমার টাইম মেশিন। এতে করে টাইম ট্রাভেল করা যায়।”
নদা ভাবল পাড়ার মনিদার মত ট্রাভেল এজেন্সি খুলেছে প্রফেসর। বাজারের ব্যাগটা নীচে রেখেছিল নদা, সেটা তুলে নিয়ে বলল, “এখন তো ট্রাভেলের সময় না। আমি পরে আসব’খন! আর এখন তো কোথায় যাব ঠিকও করিনি।” এই বলে যেতে যাবে, প্রফেসর তাকে টানতে টানতে নিয়ে চলল বাক্সের ভেতর, “আমি ঠিক করে রেখেছি কোথায় যাব। গেলেই বুঝতে পারবে”। প্রফেসরের এই কথায় হাঁউমাউ করে চেঁচিয়ে উঠল নদা, “মাগো! পাগলটার হাত থেকে রক্ষা কর আমায়! কোথায় নিয়ে যাচ্ছে দ্যাখো!”
“চুপ” ধমকে উঠল প্রফেসর, “এমন একটা জিনিস দেখতে পাচ্ছো কত সৌভাগ্য জানো তোমার? চুপ করে ঐ সিটটায় বসো।”
বাক্সটার ভেতর যন্ত্রপাতি প্রচুর। খোপও আছে বেশ কয়েকটা। একটা খোপে তিনটে বসার সিট পরপর। প্রথমটায় বসল প্রফেসর। তার সামনে কাঁচের জানলায় দেখা যাচ্ছে হলঘরের ভেতরটা। নদা বাজারের ব্যাগটা কোলে করে ভয়ে ভয়ে প্রফেসরের সিটের পরের সিটটা ছেড়ে শেষ সিটটায় বসল। বসেই মনে মনে কালীনাম জপতে থাকল। প্রফেসর মেশিন চালু করল। কিছুক্ষণ পর নদা দেখল কাঁচের জানলার বাইরের দৃশ্য বদলে যাচ্ছে দ্রুত। একটু আগে ছিল প্রফেসরের হলঘরের ভেতরটা, এখন একবার হল পাহাড়, পরমুহূর্তেই নদী-সাগর, আবার কখনও জঙ্গল। “কোথায় যাচ্ছি আমরা?” জিজ্ঞেস করল নদা। প্রফেসর পিছন ফিরে নদাকে বলল, “অতীতে।”
“অতীতে মানে?” ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে না পেরে নদা জিজ্ঞেস করল, “অনেক দূরে নাকি? ফিরতে আবার দেরী হবে না তো?”
নদার দিকে তাচ্ছিল্যভরে চেয়ে বলল প্রফেসর, “আমরা যাচ্ছি সুদূর অতীতে। যখন তুমি জন্মাওনি। যখন মানবসভ্যতাই জন্মায়নি।”
নদা পুরো কথাটা শুনলও না, বুঝলও না, তার কানে শুধু একটাই কথা ঢুকেছে, যখন সে জন্মায়নি সেখানে যাচ্ছে তারা। হঠাৎ করে সিট ছেড়ে লাফিয়ে উঠল নদা, “বন্ধ করুন এখুনি।” পাগলের মত এই স্যুইচ ঐ স্যুইচ টিপতে থাকল সে।
প্রফেসর রেগে গেলেন খুব। “অ্যাই! হয়েছেটা কি? থামো বলছি!”
“আপনি আমার আগের জন্মে যাচ্ছেন? আমি যাব না। ও পাড়ার ল্যাংড়া জ্যোতিষী বলেছিল আমি আগের জন্মে ছাগল ছিলাম। এখন গেলে যদি আর মানুষ না হই! বন্ধ করুন, আমি যাব না।”
নদার জ্বালাতনে মেশিন বন্ধ করল প্রফেসর। বাইরে জঙ্গল দেখে নদা ভাবল বোধহয় প্রফেসরের বাড়ির বাইরের দস্যিবুড়োর মাঠের পাশের জঙ্গল সেটা। সে চটজলদি টাইম মেশিনের দরজা খুলে বাইরে সবে পা রেখেছে পালাবে বলে, সামনের দৃশ্য দেখে তো তার মন আনন্দে আত্মহারা! সে দেখল মাটিতে পাখির বাসার মত জায়গায় রাখা অনেকগুলো ডিম। আর সে ডিমের সাইজ কি! একেবারে নদার মনের মত! প্রফেসর তাহলে তার মনের কথা জেনেই তাকে আজ এখানে এনেছিল, আর সে কিনা প্রফেসরের মেশিনে ওরম কাণ্ড করে বসল, ভাবতে তার নিজেরই লজ্জা লাগল। নদা সবে একটা ডিম নিয়ে ব্যাগে পুরেছে, এমন সময় ভেতর থেকে প্রফেসরের চিৎকার, “কোথায় গেলে? ভেতরে এসো!”
ভেতরে আসতে প্রফেসরকে দেখে ভয় পেল সে। প্রফেসর খুব রেগে আছে এখন। “চলো বাড়ি! তোমাকে এনেই এখানে ভুল করেছি! চলো এখখুনি!”
এখন প্রফেসর রেগে গেছে খুব, এখন কোনও কথা শুনবে না নদার। কিন্তু এতগুলো ডিমের লোভ সে ছাড়তে পারছে না। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল নদা, আবার একটা ধমক খেল সে প্রফেসরের। আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ আগের জায়গাটাতে গিয়ে বসল। প্রফেসর মেশিনে করে ফিরে এলো বর্তমানে। মেশিন থেকে নামিয়ে তাকে প্রায় তাড়াই করল প্রফেসর। নদা “আবার আসব স্যার” বলে বেরিয়ে গেল। মনটা তার খুশিতে ভরে গেছে।
সারাটা দুপুর বড় ডিমটায় হাত বুলিয়ে কাটিয়ে দিয়েছে নদা। আজ তার স্বপ্নপূরণের দিন। বিশাল বড় অমলেট বানাবে সে এটা দিয়ে। আরও কয়েকটা আনলে বড় একটা এগরোল বানাত সে, তাক লাগিয়ে দিত সবাইকে। কিন্তু প্রফেসরের রেগে যাওয়াতে আর আনা হল না সবকটা। যাই হোক, আজ হয়নি তো কি হয়েছে, পরে গিয়ে প্রফেসরকে ঠাণ্ডা করে জায়গাটা আবার ঘুরে আসতে হবে। এবার গেলে ভালো করে চিনেও নিতে হবে কিভাবে যেতে হয় ওখানে। আপাতত সে অমলেট বানানোতে মন দিল।
ডিমটা ফাটিয়ে ভেতরের অংশটা বাটিতে ঢেলে নিল। তাতে ভালো করে নুন পিঁয়াজ লঙ্কা এইসব মিশিয়ে একটা লেই করল। তারপর পুরো চাটু জুড়ে মেলে দিল লেইটা। ডিমের খোসাটা বালতিতে ফেলে মাথাটা সবে তুলেছে নদা, দেখল একটা বিকট প্রাণী চাটুর দিকে চেয়ে আছে। মুখটা তার কুমীরের মত লম্বা। মুখ তুলে খ্যাঁকখ্যাঁক করে কি যেন বলল সে নদাকে। নদার তো তাকে দেখে গলা শুকিয়ে কাঠ। দোকান-চাটু-ডিম ছেড়ে সে লাগাল ছুট। বিকট প্রাণীটাও ছুট লাগাল তার পিছনে।
ছুটতে ছুটতে নদার লুঙ্গিতে একটা টান পড়ল। প্রাণীটা তার লুঙ্গিতে কামড় দিয়েছে। লুঙ্গি খুলে ছিটকে পড়ল নদা। আর লুঙ্গিটা জড়িয়ে গেল প্রাণীটার মুখে। সেই সুযোগে নদা দস্যি বুড়োর মাঠের পাশের জঙ্গলটায় ঢুকে পড়ল। প্রফেসর পাগলাদাসের ভয়ে এদিকটা কেউ মাড়ায় না, তাই নদা আর প্রাণীটা বাদে সেখানে কেউ নেই। প্রাণীটা অনেকক্ষণ খুঁজেও নদাকে পেল না যখন, চলে গেল অন্যদিকে। জঙ্গলের মধ্যে কলাগাছ দেখতে পেয়ে একটা কলাপাতা অনেক কষ্টে ছিঁড়ে সেটা দিয়ে কোনও রকমে কোমর ঢাকল নদা। একটু উঁকি মেরে যখন দেখল প্রাণীটা নেই কোথাও, তখন সাহস করে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এলো সে। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চলেছে নদা, এমন সময় প্রফেসরের চিৎকারে চমকে উঠল, “কি করেছ জানো তুমি?”
“আমি আবার কি করলাম”, মনে মনে ভাবল নদা, “নিজেই পড়েছি এক জ্বালায়!” পিছন ফিরে দেখল প্রফেসর তার বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে।
“তুমি কার ডিম চুরি করে এনেছ জানো?”, চেঁচিয়ে উঠল প্রফেসর, “ভেলসির‍্যাপ্টারের ডিম। তোমার জ্বালায় তখন ক্রেটেসাস যুগে থামতে হয়েছিল। আর তুমি বেরিয়ে গিয়ে ওদের ডিম চুরি করে এনেছ?”
“কার ডিম?” নদা ব্যাপারটা না বুঝলেও কোনও বিপজ্জনক কারও ডিম যে সে এনেছে এটা বুঝল।
“ডায়নোসরের ডিম” প্রফেসর বলল, “ঐ ডিমের মালিকও টাইম মেশিনে চড়ে এখানে চলে এসেছে। আমার ল্যাব তছনছ করে ডিম খুঁজেছে। এখন তোমায় খুঁজতে বেরিয়েছে।”
“মালিক মানে?” ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস নদা।
“মানে ডিমগুলোর মা ডায়নোসর। ওর ডিম ফেরত চাই। নাহলে কাউকে ছাড়বে না বলেছে।”
নদার জিভ শুকিয়ে গেছে। ডিম তো এতক্ষণে চাটুতে পুড়েই গেছে পুরো, কোত্থেকে ফেরৎ দেবে এখন সে?। কোনওরকমে বলল নদা, “ভেজে ফেলেচি যে!”
“ভালো!” খেঁকিয়ে উঠল প্রফেসর, “ডায়নোসরও ভেজে খাবে তোমায়!” এই বলে গটমট করে বাড়ির ভেতর চলে গেল।
কলাপাতা জড়ানো নদা থপ করে বসে পড়ল মাটিতে। মনে মনে কালীমাকে স্মরণ করতে লাগলো, “আর বড় ডিমে লোভ করব না মা! এবারের মত উদ্ধার করে দাও!” তারপর নিজের মনেই বলল, “মুরগী বাবা অনেক ভালো। ছোট ডিম দেয় ঠিক আছে। এদের মত তাড়া তো করে না। ডিম একটু বড় বলে দেমাক দ্যাখো ডাইনোসরের!”

ছবি – লেখক


লেখকের কথা: রুবাই শুভজিৎ ঘোষ
লেখকের জন্ম পশ্চিমবাংলায়। পেশায় একটি বহুজাতিক সংস্থার তথ্যপ্রযুক্তিবিদ। নেশায় লেখক এবং পরিচালক। বাঙালির জনপ্রিয় ওয়েবসাইট সববাংলায় এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তিনি। কবিতা থেকে শুরু করে গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস, চিত্রনাট্য সবকিছুই লিখতে ভালবাসেন। লিটিল ম্যাগাজিন থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক বিভিন্ন ম্যাগাজিনে নিয়মিত লিখেছেন। স্রোত থেকে প্রকাশিত তাঁর কবিতার সংকলন দৃষ্টি এবং বালিঘড়ি। এছাড়া তথ্যচিত্র, শর্ট ফিল্ম বা অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের ভিডিও পরিচালনা করেন। ধর্ম এবং বিজ্ঞান তাঁর প্রিয় বিষয়। ভ্রমণ তাঁর অন্যতম শখ। অন্যান্য শখের মধ্যে রয়েছে স্কেচ, ফটোগ্রাফি, ছবি ডিজাইন করা।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।

লেখা আহ্বান - বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন