লেখক: কৃষ্ণাশীষ রায়
জায়গাটার নাম কেউ বলে বার্সে, আবার কেউ বলে ভার্সে। তবে সেখানে পৌঁছে স্থানীয় দোকান বা বাসস্থানের বোর্ডে বা ডাকবাক্সের ঠিকানার জায়গায় ‘বার্সে’ নামটাই পাওয়া যায়। এই বার্সে জায়গাটির পরিচিতি প্রধানত ‘বার্সে রডোডেনড্রন স্যাংচুয়ারি’র জন্য। পশ্চিম সিকিমে অবস্থিত ১০৪ বর্গ কি.মি জুড়ে এই বার্সে রডোডেনড্রন স্যাংচুয়ারি। এই স্যাংচুয়ারিটি সিঙ্গালিলা জাতীয় উদ্যানের অন্তর্গত। পশ্চিম প্রান্তে নেপাল সীমান্ত। আপনারা যদি রডোডেনড্রন ফোটার মরসুমে যেতে চান তাহলে সেরা সময় মার্চ-এপ্রিল, কিন্তু সেই সময় বরফ দেখতে পাবেন না। এতক্ষণ তো গেল জায়গার বৃত্তান্ত, এবার ভ্রমণে আসা যাক। কলকাতা থেকে উত্তরবঙ্গ কীভাবে যেতে হয় সে কথা ফলাও করে লেখা মানে ‘বাঙালকে হাইকোর্ট দেখাব’ মতো ব্যাপার হয়ে যাবে, শতকরা ৯৫ ভাগ বাঙালি সে কথা জানে। তবু লেখার সম্পূর্ণতা রক্ষা করার জন্য লিখতে হচ্ছে।
এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি এক বৃহস্পতিবারের রাত ১০টা বেজে ৫ মিনিট, শিয়ালদহ স্টেশন থেকে দার্জিলিং মেইল-এর ভেঁপু বাজতেই আপামর বাঙালির মন চাঙ্গা হয়ে যায়। মোট ৫ দিনের ছুটি সম্বল করে অনায়াসেই বেরিয়ে পড়া যায়, ডেস্টিনেশন নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন।
পরদিন সকালে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নেমে সকালের জলখাবার সেরে নেওয়া জরুরি, কেননা গন্তব্যে পৌঁছতে লাগবে মোটামুটি ৮ ঘন্টা। এখনে বলে রাখা দরকার বার্সে-তে থাকার জায়গা কেবল একটি, নাম ‘গুরাস কুঞ্জ’। ‘Holiday Home India’ কলকাতার অফিস থেকে এটির বুকিং নেওয়া হয়। এটির থাকার জায়গায় খুব সীমিত, তিনটি মাত্র ঘর। তাই সাধারণত বেশিরভাগ লোকই থাকে ওখড়েতে। ওখড়ে বার্সে থেকে ১১ কিমি আগে। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে ওখড়ে বা বার্সে যাওয়ার ব্যাপারটা পুরোটাই নিজের ট্যাঁকের জোর এবং মানসিকতার উপরে নির্ভর করে। স্টেশন থেকে পুরো গাড়ি রিসার্ভ করেও যেতে পারেন অথবা খরচ বাঁচিয়ে যাওয়ার জন্য নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে প্রথমে শিলিগুড়ি SNT বাসস্ট্যান্ডে আসুন, তারপর সেখান থেকে শেয়ার গাড়িতে করে জোড়থাং। জোড়থাং থেকে ওখড়ে বা বার্সে যাবার শেয়ার বা রিসার্ভ গাড়ি পেয়ে যাবেন।
গাড়ি রিসার্ভ করে গেলে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে চলে যেতে পারবেন, রুট সম্বন্ধে বিশেষ কিছু না জানলেও চলবে। জোড়থাং পৌঁছতে লাগবে ঘন্টা চারেক। জোড়থাং সাউথ সিক্কিমের একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর। জোড়থাং দিয়ে বয়ে গেছে তিস্তারই এক প্রশাখা — রঞ্জিত। প্রতি বছর ১৪ জানুয়ারি এক বড়ো মেলা বসে এই জোড়থাং-এ। নেপালি সাংস্কৃতিক মেলা, নামটাও খুব সুন্দর — ‘মেঘ মেলা’। জোড়থাং ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে “women’s welfare canteen” নাম এক সরাইখানা আছে। নেপালি থালি থেকে শুরু করে হরেক চাউমিন, মোমো, স্টেক ইত্যাদি পাওয়া যায়। স্বাদ মুখে লেগে থাকার মতো। দুপুরের খাওয়ার খেয়ে ওখড়ে যাওয়ার বাস ধরে নেবেন। ওখড়ে পৌঁছতে লাগবে ঘন্টা দুয়েক।
ছোট্ট একটা গ্রাম, এই ওখড়ে। এই জায়গাকে বার্সের গেটওয়েও বলা হয়ে থাকে। সত্যি, সিকিম রাজ্যটার প্রতিটা বাঁকেই প্রকৃতি বেশ সুন্দর সাজুগুজু করে থাকে। গুটিকতক ছড়ানো ছিটনো কাঠের বাড়ি নিয়ে তৈরি এই পুঁচকি গ্রামও অনন্য টুরিস্ট স্পট, যদিও এখন বেশ কিছু কংক্রিটের বাসস্থান উঠেছে। একদিকে ভার্সে যাওয়ার পাকদণ্ডী, অন্যদিকে দিগন্ত ছুঁয়ে থাকা নীল পাহাড়, ওদিকটায় রিম্বিকের রাস্তা দেখা যায়, যেটা নদীর ধার ধরে সোজা চলে গেছে শ্রীখোলা পর্যন্ত। নিজের মতো করে দিব্যি সতেজ সুন্দর এই ওখড়ে গ্রামটি। ওখড়ের থাকার আস্তানাগুলোয় অকারণ বাহুল্য বা বিলাসিতার চিহ্নমাত্র নেই। তবে রয়েছে স্বাভাবিক জীবনযাপনের পরিচ্ছন্ন ব্যবস্থাপনা। খাঁটি সিকিমিজ খানার লোভেই শুধুমাত্র এখানে চলে আসা যায়।
সেখানে হোটেলে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই আপনার আপ্পায়ন হবে খাঁটি রডোডেনড্রন ফুলের নির্যাস থেকে তৈরি জুস্ দিয়ে। শান্ত, নিঃস্তব্দ জায়গাটি। শীতটা কিন্তু বেশ ভালোই পরে সেখানে। ওভারকোট আর মাঙ্কি টুপি নিতে ভুলবেন না। নির্জন ওখড়ের নিঝুম রাতকে বড় বেশি মায়াবি করে দেয় দূর পাহাড়ের শৈলশহর — হ্যাঁ আমার আপনার অতি পরিচিত দার্জিলিং। দার্জিলিঙের এক ঝাঁক ঝিকমিকে জোনাকি আলোর সমারোহ কোথাও যেন এসে রাতের তারার সঙ্গে মিশে যায়। সব পাহাড়ি জায়গাতে লোকজন তাড়াতাড়ি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। রাতে আপনার খাবার পাতে থাকবে নরম গরম হাত রুটি, স্কোয়াশের তরকারি আর মুরগির ঝোল। পরের দিন বার্সে যাত্রা। হোটেলওয়ালার থেকেই বার্সে যাওয়ার গাড়ির বন্দোবস্ত করে দেওয়ার ব্যবস্থা আছে।
পরদিন সকালে উঠে লুচি আর ফুলকপির তরকারি দিয়ে ব্রেকফাস্ট শেষ করে রওনা দেবেন বার্সের পথে। আধ ঘন্টার গাড়ি পথ পেরিয়ে বার্সে রডোডেনড্রন স্যানচুয়ারির গেটে পৌঁছবেন। পাহাড়ের কোলে এই অভয়ারণ্যের উচ্চতা ১০,৫০০ ফুট। অভয়ারণ্যের গেট থেকে ৪ কিলোমিটারের ছোট্ট, সহজ ট্রেক। কিন্তু জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। চারদিকে ঘন রডোডেনড্রনের বন। সঙ্গে পাইন, ফার, ওক, দেওদর হেমলকের ছায়ায় ঘেরা আর্দ্র সংকীর্ণ পথ। বড় বড় মহীরুহের ফাঁক দিয়ে আলোছায়ার লুকোচুরি। পায়ের তলায় ফার্ণ, মস আর নাম না-জানা পাহাড়ি গুল্মে নরম সবুজ গালিচা। পথ পেরিয়ে অবশেষে এসে পৌঁছবেন বার্সের কেন্দ্রস্থলে। যেখানে চারপাশের পাহাড় রডোডেনড্রন ঘেরা। স্থানীয় ভাষায় যার নাম গুরাস। মার্চের শেষ থেকে গোটা এপ্রিল মাস প্রতি বছর আগুন জ্বলে বার্সেতে। লাল গুরাসের আগুন। মাঝে মাঝে সেই আগুনে হলুদ শিখার সংযোজন ঘটায় হলুদ গুরাস। শীতে অবশ্য গুরাস ফোটে না। কিন্তু গুরাস গাছের শুকনো ডালে বাসা বাঁধে সাদা কুচি বরফ। শীত বাড়লে বরফ চাদর ঢেকে ফেলে বার্সের হৃদয়।
বার্সেতে থাকার জায়গা একটাই। গুরাস কুঞ্জ। খাতায় কলমে সরকারি হলেও বর্তমানে এক স্থানীও যুবক লিজ নিয়েছেন। বার্সেতে কোনও বিদ্যুতের ব্যবস্থা নেই, নেই লাগাতার জলের জোগান। তাই রাত বাড়লে মোমের টিমটিমে আলোই ভরসা। বস্তুত, নাগরিক সভ্যতার যান্ত্রিক জীবনযাপন থেকে শত যোজন দূরে বেঁচে থাকে এই একফালি পাহাড়। এরপর ফিরে আসার পালা। একরাশ ভালোলাগা সঙ্গে করে।
( চিত্রগ্রহণঃ লেখক )
লেখক পরিচিতি: কৃষ্ণাশীষ রায়
কৃষ্ণাশীষ রায় একজন ভ্রমণ পিপাষু মানুষ। তিনি দেশে-বিদেশে ঘুরতে এবং সেই ভ্রমণ অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখালিখি করতে ভালোবাসেন।