কৃষ্ণগত প্রাণ: শেষ পর্ব

লেখক: মিত্রা হাজরা

কৃষ্ণগত প্রাণ: তৃতীয় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন

নন্দ মহারাজ বলছেন, “আমরা সব সময় কৃষ্ণের কথাই চিন্তা করি। কৃষ্ণের হাসি, কৃষ্ণের দুষ্টুমি, যমুনার তীরে, গোচারণভূমিতে, গিরি গোবর্ধনের কাছে সর্বত্র কৃষ্ণের চরণচিহ্ন দেখি।”
এ সকল কথা বলতে বলতে নন্দমহারাজ বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন; মা যশোদা নীরবে অশ্রুবিসর্জন করে যাচ্ছেন। তিনি একদৃষ্টে উদ্ধবকে দেখে চলেছেন…ঠিক যেন আমার কৃষ্ণ! কৃষ্ণের বারতা নিয়ে এসেছে, তাহলে মনে আছে কৃষ্ণের আমাদের কথা!

যশোমাতা ও নন্দমহারাজের এরকম আকুলতা দেখে উদ্ধবেরও চক্ষু সজল হয়ে উঠলো। বললেন, “হে স্নেহময়ী মাতা ও পিতা, আপনারা মানবকুলে সকলের বন্দনীয়, কারণ আপনাদের মত কেউই এমন দিব্য কৃষ্ণানুরাগে বিভাবিত হয়ে কৃষ্ণচিন্তা করতে পারে না। আপনারা সতত কৃষ্ণ বলরামের প্রতি প্রগাঢ় অনুরাগে আবিষ্ট। কৃষ্ণ কুশল আছেন, তিনি আসবেন বৃন্দাবনে, স্বয়ং উপস্থিত হয়ে, আপনাদের পরিতুষ্ট করবেন। এই সংবাদই আমি আপনাদের জন্য এনেছি। আপনারা সর্বক্ষণ কৃষ্ণের উপস্থিতি অনুভব করেন, কারণ কৃষ্ণ সর্বত্র বিরাজমান। তিনি অন্তর্যামী পরমেশ্বর। তিনি কারোর শত্রু নন, কারোর মিত্র নন, কেউ তাঁর সমকক্ষ নয়, কেউ তাঁর থেকে শ্রেষ্ঠ নয়। ভক্তজনের রক্ষার জন্য তিনি আত্মমায়ার প্রভাবে ধরায় অবতীর্ণ হয়েছেন। কোনো মায়িক গুণের দ্বারা তিনি আচ্ছন্ন নন। তিনি নিখিল, নির্গুণ, সৃষ্টির তত্ত্বাবধায়ক। তিনি সৃষ্টি করেন, পালন করেন, আবার বিনাশও তিনিই করেন।”

এভাবে নন্দমহারাজ ও উদ্ধব সারারাত কৃষ্ণ কথায় অতিবাহিত করলেন। প্রভাতে গোপ রমণীরা নবনীত, দধি, মিশ্রিত করে ছিটিয়ে মঙ্গলারতি করে নন্দের গৃহে এলেন, যশোমাতা ও নন্দমহারাজকে প্রণাম করতে। কুমকুম চন্দনে চর্চিত তাঁদের মুখমন্ডল, উদীয়মান সূর্যের মত তাঁদের দেখতে। তাঁরা কৃষ্ণ নাম করতে করতে আসছেন, সমগ্র পরিবেশ নির্মল পবিত্র হয়ে আছে। গৃহদ্বারে স্বর্ণময় রথ, দেখে তাঁরা ভাবলেন অক্রুর বোধহয় ফিরে এসেছেন, তাঁরা অক্রুরকে পছন্দ করতেন না, কারণ অক্রুরই কৃষ্ণ-বলরামকে তাঁদের কাছ থেকে কেড়ে মথুরায় নিয়ে গেছেন।

এরপর তাঁরা উদ্ধবকে দেখতে পেলেন, তাঁকে দেখতে তো একদম তাঁদের কৃষ্ণ। পীতবসন, দীর্ঘবাহু, পরম সুন্দর, বুঝলেন ইনি কৃষ্ণ-ভক্ত। আবার যখন শুনলেন কৃষ্ণের বার্তা নিয়ে এসেছেন, তাঁরা তাঁকে ঘিরে ধরলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, “কৃষ্ণ কেমন আছেন, জানি আপনি কৃষ্ণের অন্তরঙ্গ, তাই কৃষ্ণ তাঁর মা বাবাকে সান্ত্বনা দেবার জন্য আপনাকে পাঠিয়েছেন। কিন্তু আমরা যাঁদের কৃষ্ণ ছাড়া আর কিছুই নেই, তাঁদের কথা কৃষ্ণ কি ভাবে কখনো! দাবানলের পর বন তৃণশূন্য হলে হরিনাদি পশুরা বন ত্যাগ করে। কৃষ্ণ আমাদের সেই রকম ত্যাগ করে চলে গেছেন।”
তাঁরা কাঁদতে শুরু করলেন। বৃন্দাবনে আর কৃষ্ণের কাজ নেই। নানাভাবে কৃষ্ণকথা বলে উদ্ধব তাঁদের শান্ত করছেন। বলছেন, “হে পরম ভক্ত কৃষ্ণ প্রাণগতা গোপিনীগণ – কৃষ্ণ আপনাদের ছেড়ে থাকেননি, তিনি সর্বত্র বিরাজ করছেন। আপনাদের অন্তরে তিনি আছেন। আপনারা সর্বদা কৃষ্ণ ভাবনায় দিন কাটান, যা আপনারা অন্তরে অনুভব করেন শ্রীকৃষ্ণ এর জন্য। সেখানে শ্রীকৃষ্ণ ও গোপিনীরা অভিন্ন ।এক আত্মা, সেখানে বিচ্ছেদ নেই। কৃষ্ণ বিরহই হচ্ছে নিত্য কৃষ্ণ সম্বন্ধের পূর্ণতার সোপান। জীবাত্মা সরাসরি ভগবানের অংশ। শুধু গোপিনীরা নয়, সমগ্র জীবকুল সর্ব অবস্থায় শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে অচ্ছেদ্য ভাবে যুক্ত। শুধু জ্ঞানচক্ষু খোলেনি বলে মানব বুঝতে পারে না। হে কৃষ্ণপ্রিয় গোপিনীগণ, আপনারা কখনো কৃষ্ণ হতে বিচ্ছিন্ন নন। আজ ভগবৎ চিন্তার পরম সিদ্ধির স্তরে আপনারা আছেন। জয় শ্রীকৃষ্ণ।”

(সমাপ্ত)


লেখকের কথা: মিত্রা হাজরা
আমি মিত্রা, লেখালেখি করতে ভালোবাসি, কবিতা, ছোটগল্প লিখি মাঝে মাঝে। বই পড়তে ও গান শুনতে ভালোবাসি। পড়ি শংকর এর লেখা, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর লেখা, আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প আমার খুব প্রিয়। জীবনানন্দ দাশ, রুদ্রমুহম্মদ শহিদুল্লা, সুনীল, বিষ্ণু দে এর কবিতা পড়তে ভালোবাসি। আমার লেখা পড়ে আপনাদের ভালো লাগলে বা খারাপ লাগলে অবশ্যই জানাবেন।

4 Comments

  1. NIRMAN PAL

    মিত্রা দেবী সাহিত্যকে মিত্র করতে পেরেছেন এর জন্য আপনার প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাই। আপনার ‘কৃষ্ণগত প্রাণ’ লেখাটি পড়ে বড় প্রীত হলাম ।
    ধন্যবাদান্তে –
    নির্মাণ পাল।

  2. অজ্ঞাতনামা কেউ একজন

    আপনার লেখা পড়তে পড়তে কৃষ্ণ ভক্ত হয়ে গেলাম।
    আমার একটি ছোট প্রশ্ন , কৃষ্ণ কি ভগবান বা ঈশ্বর?না কৃষ্ণ ভগবান বা ঈশ্বরের দূত?
    জানালে উপকৃত হবো।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।

রুচিশীল ও বিষয়ভিত্তিক আলোচনার জন্য ক্লিক করুন এখানে

sobbanglay forum