অমৃত কুম্ভ: ইতিহাস, পুরান, মিথ, সর্বোপরি বিশ্বাস

লেখক : দেবাত্রেয়ী গুহ

“সেই সত্য যা রচিবে তুমি/ঘটে যা তা সব সত্য নহে”!

কথিত আছে দেবতা ও দানব একসঙ্গে সমুদ্র মন্থন করেছিলেন, তখন ১৪টি মূল্যবান ধন বেরিয়েছিল, যার মধ্যে একটি ছিল অমৃত কলশ। সমুদ্র মন্থনের প্রাথমিক উদ্দেশ্যই ছিলো এই অমৃত প্রাপ্তি। অবশেষে যখন অমৃত কলসের আবির্ভাব হলে দেবতা ও অসুরদের মধ্য বিরোধ দেখা দেয়। অসুরদের হাত থেকে অমৃত রক্ষা করতে ইন্দ্র পুত্র জয়ন্ত মতান্তরে গরুড় সেই কলস নিয়ে পালিয়ে যায়। অসুররাও তাকে তাড়া করে। পালিয়ে যাওয়ার সময় পৃথিবীর চারটি স্থানে অমৃতের ফোঁটা পড়েছিল: উজ্জয়িনী, হরিদ্বার, নাসিক এবং প্রয়াগরাজ। এই স্থানগুলি তাই পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র স্থান হিসাবে বিবেচিত হয়।

কুম্ভ মেলা চারটি পবিত্র স্থানে অনুষ্ঠিত হয়: ১৩ই জানুয়ারি ২০২৫ থেকে মহাকুম্ভ উত্তর প্রদেশের প্রয়াগরাজে অনুষ্ঠিত হবে এবং ২৬ শে ফেব্রুয়ারি ২০২৫ এ শেষ হবে।

এটা বিশ্বাস করা হয় যে কুম্ভ মেলার সময় এই স্থানে নদীগুলির জল ঐশ্বরিক অমৃতের মতো গুণাবলীর দ্বারা পরিপূর্ণ হয়, যা তাদের আধ্যাত্মিক শুদ্ধি এবং আশীর্বাদের জন্যে পবিত্র করে তোলে।

দীর্ঘ ১২ বছর পর এবার প্রয়াগরাজে অনুষ্ঠিত হচ্ছে পূর্ণ কুম্ভ, পাশাপাশি পশ্চিমবাংলায় গঙ্গাসাগর মেলা ও মকর স্নান। আর এই পুণ্যক্ষেত্রের অন্যতম আকর্ষণ নাগা সন্ন্যাসীগণ। ‘নগ্ন’ থেকে এসেছে ‘নাগা’ শব্দটি। এই বিশেষ সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসীরা পোশাকহীন থাকেন। সারা গায়ে ভস্ম মাখা, মাথায় জটা, এই রূপ সন্ন্যাসীদের সাধারণত অন্য সময় দেখা যায় না। লোকদৃষ্টির অন্তরালে থাকবার কারণে এদের নিয়ে সাধারণ মানুষের কৌতুহল প্রচুর। নাগা সন্ন্যাসী সহজে হওয়া যায় না। নাগা সাধু হতে গেলে ১২ বছরের কঠোর তপস্যার প্রয়োজন। এই ১২ বছরের তপস্যা কালে তারা শুধু কৌপীণ ধারণ করে থাকেন। কুম্ভ মেলায় স্নান করে সেই কৌপীন বিসর্জন দিয়ে নাগা সন্ন্যাসীর জীবনযাপন করবার শপথ নেন । নাগা সন্ন্যাসী হওয়ার এই সাধনা অত্যন্ত কঠিন। নাগা সন্ন্যাসীদের প্রথম শিক্ষা হচ্ছে ব্রহ্মচর্য পালন। এই পরীক্ষায় সফল হলে নিজের যজ্ঞোপবীত বা পৈতে বিসর্জন দিতে হয়। এরপর নিজের পরিবারের পিন্ডদান করতে হয়। তারপর নিজের পিণ্ডদান করতে হয়। এই প্রক্রিয়া ‘বিজওয়ান’ নামে পরিচিত। কারণ নাগা সন্ন্যাসী হওয়ার পর এদের কাছে পরিবারের মৃত্যু হয় এবং পরিবার ও সমাজের কাছে এদের মৃত্যু হয়।

কোন দেশের সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণের থেকেও কঠিন এদের সাধনার পথ।‌ এরা শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা অর্থাৎ বারোমাস শয্যা ত্যাগ করে শুধুমাত্র খালি মাটিতে শুয়ে থাকেন। ভিক্ষে করে আহার্য সংগ্রহ করেন। কিন্তু একদিনে মাত্র সাতটি বাড়িতে এরা নিয়মানুসারে ভিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন। তবে ভিক্ষা সংগ্রহ না হলে ঐদিন অভুক্ত থাকতে হয়। আমাদের দেশে নাগা সন্ন্যাসীদের ইতিহাস অনেক প্রাচীন। মহেঞ্জোদারোর মুদ্রাতেও নাগা সাধুদের ছবি পাওয়া যায়। তাদের এখানে মহাদেবের উপাসক রূপে চিহ্নিত করা হয়েছে। সাধু দিগম্বর অখিলেশপুরীর মতে, ‘আমাদের লিঙ্গ অকেজো করে দেওয়া হয়। আমাদের কোন কামনা বাসনা নেই। যারা যৌন কামনার প্রবল বেগকে সামাল দিতে পারে তারাই নাগা। কাম ক্রোধ লোভ — সেই সিদ্ধিলাভ করে, যে যৌন বাসনার বিরুদ্ধে জয়ী হয়।’

নাগা সাধুরা হচ্ছে ধর্মের সৈনিক।‌ অধ্যাপক যোগেশ্বর তিওয়ারির মতে, বিধর্মীদের দ্বারা সনাতন ধর্ম আক্রান্ত হলে তার প্রতিরোধের ভূমিকা পালন করে এই নাগা সাধুরা। গুরু শংকরাচার্য সনাতন ধর্ম রক্ষার্থে একটি খারু গঠন করেন। এই সংঘের মাধ্যমে নাগাদের পত্তন হয়। শাস্ত্র ও অস্ত্র উভয় জ্ঞানের দ্বারাই এরা বিধর্মী তথা মুসলিম আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে একাধিকবার তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। সারা বছর এরা দৃশ্যমান না হলেও পুণ্য তীর্থ কুম্ভক্ষেত্রের মূল আকর্ষণ ভারতবর্ষের প্রাচীন সম্প্রদায় এই নাগা সন্ন্যাসীগণ।

লেখক পরিচিতি : দেবাত্রেয়ী গুহ
আমি একজন লেখিকা। ভালোবেসে লিখি। বাংলা সাহিত্যে মাস্টার্স ও বি এড করেছি।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।