লেখক : অভি সেখ
(প্রথম পর্ব)
রাত গভীর। রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা হাতে গোনা, বাতাস ভারী হয়ে আছে শীতের ঝাপটায়। শহরের শেষ প্রান্তে, অন্ধকারে ঢাকা একটি সুবিশাল ভবন দাঁড়িয়ে আছে—রেইভেনউড সাইকিয়াট্রিক ইনস্টিটিউট। এটি বাইরে থেকে সাধারণ মানসিক হাসপাতালের মত দেখালেও, ভিতরের সত্যটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। ডিটেকটিভ অরিন্দম ঘোষ আজ এখানে এসেছেন একজন ‘প্রবেশকারী’ হিসেবে। তার কোন পুলিশি ব্যাজ নেই, নেই কোন অনুমতি। আজ থেকে তিনদিন আগে অরিন্দম একটা অজানা মেইল পেয়েছিল এবং তারই তদন্ত করতে সে এসেছে।
তার গন্তব্য হাসপাতালের সেই গোপন ওয়ার্ড, যেখানে সরকারের ছায়ায় পরিচালিত এক অন্ধকার গবেষণা চলছে। সে গাঢ় রঙের পোশাকে মোড়ানো, মাথায় হুড তোলা। এই হাসপাতালে ঢোকার একমাত্র নিরাপদ উপায় হ’ল ছদ্মবেশ—এবং ছদ্মবেশের জন্য সে বেছে নিয়েছে হাসপাতালের এক জুনিয়র টেকনিশিয়ানের পরিচয়।
প্রবেশের তিনটি পথ। প্রধান ফটক, যেখানে সেনা প্রহরীরা ২৪ ঘণ্টা পাহারা দেয়। সার্ভিস গেট, যেখানে শুধুমাত্র অনুমোদিত ডাক্তার এবং গবেষকরা প্রবেশ করেন। অবৈধ প্রবেশপথ, যা হাসপাতালের পুরনো বর্জ্য নিষ্কাশন টানেল দিয়ে সংযুক্ত। অরিন্দম তৃতীয় পথটি বেছে নিয়েছে।
টানেলটি একসময় হাসপাতালের বর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য ব্যবহৃত হতো, কিন্তু সেটি বহুদিন আগে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। যে মেইল পেয়ে অরিন্দম এখানে এসেছে সেই মেইলে এই রাস্তার বর্ণনা ছিল। সে হাসপাতালের পিছন দিকে গিয়ে ঝোপঝাড়ের মধ্যে লুকনো কংক্রিটের ঢাকনাটি সরাল। নীচে নামার জন্য সিঁড়ির মত ছোট ধাপ ছিল, যা পিচ্ছিল এবং ভেজা। টানেলের ভিতর দিয়ে গন্ধ বের হচ্ছিল, যেন বহুদিনের পচা কিছু লুকিয়ে আছে। সে হাতের টর্চ জ্বালাল না। কারণ, আলো মানেই ধরা পড়ার ঝুঁকি। অন্ধকারের ভিতর দিয়ে এগোতে এগোতে সে দেওয়ালের চিহ্ন অনুসরণ করল। তার সূত্র জানিয়েছিল, টানেলের শেষে একটি পুরনো দরজা আছে, যা সরাসরি হাসপাতালের নিচতলার পুরনো স্টোররুমে খোলে।
হঠাৎই সে থমকে গেল। সামনে কোথাও সামান্য শব্দ হ’ল—যেন কেউ নিঃশব্দে নড়াচড়া করছে। অরিন্দম নিঃশ্বাস আটকে দাঁড়িয়ে রইল, হাতে ধরা ছোট ছুরিটি শক্ত করল। অন্ধকারে সে কিছু দেখতে পাচ্ছিল না, তবে কানের অনুভূতি বলে দিচ্ছিল—কেউ আছে। তিন সেকেন্ড… পাঁচ সেকেন্ড… দশ সেকেন্ড কেটে গেল। কোন সাড়া নেই। সে ধীরে ধীরে আবার হাঁটা শুরু করল।
দরজার কাছে পৌঁছে তালা পরীক্ষা করল। সূত্রের কথা সত্যি—এটি ভিতর থেকে বন্ধ করা ছিল না। ধীরে ধীরে হাতল ঘুরিয়ে দরজাটি ঠেলে খুলল। একটা পিচপিচে গন্ধ প্রথমেই আঘাত করল। হাসপাতালের স্টোররুমের বাতাস ঘন এবং গুমোট। এখানে হয়ত পুরনো ওষুধ বা রাসায়নিক রাখা হত। অরিন্দম ধীরে ধীরে স্টোররুম থেকে বেরিয়ে করিডরে পা রাখল। চারদিকে শুনশান নীরবতা। হাসপাতালের এই অংশটি হয়ত সচল নেই, অথবা ইচ্ছাকৃতভাবেই ফাঁকা রাখা হয়েছে। দেওয়ালের হলদেটে রঙ চটে গিয়েছে, ছাদ থেকে মাঝেমাঝে জল টপটপ করে পড়ছে।
সে শ্বাস নিয়ন্ত্রণ করল। তাকে খুব সতর্ক থাকতে হবে। মেইলে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী এই ভবন শুধুমাত্র হাসপাতাল নয়, এটি সরকারের গোপন গবেষণাগার, যেখানে জেলের বন্দীদের উপর ভয়ংকর পরীক্ষা চালানো হয়। কারও চোখে পড়া মানেই নিশ্চিত মৃত্যু। তার গন্তব্য ছিল হাসপাতালের ‘ক্লিনিকাল ট্রায়াল সেকশন’। সেখানে কী ঘটে, তার কিছুই বাইরে জানা যায় না। কিন্তু ওই মেইল অনুযায়ী, সেখানে মানুষের মস্তিষ্ক নিয়ে ভয়ংকর পরীক্ষা চলে।
করিডরটি সরু, দুই পাশে পুরনো দরজাগুলো বন্ধ। মাঝেমধ্যে একটা-দু’টো টিউবলাইট টিমটিম করে জ্বলছে, যা আরও ভয়ানক পরিবেশ তৈরি করেছে।
হঠাৎ সে কানের কাছে এক শব্দ শুনতে পেল—খচ খচ খচ…। কার পায়ের আওয়াজ? সে দ্রুত পাশে এক পুরনো আলমারির পিছনে লুকিয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ড পরেই একটি সিকিউরিটি গার্ড ধীরে ধীরে হেঁটে এল। হাতে অটোমেটিক রাইফেল, চোখজোড়া যেন সন্দেহে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে সবকিছু। অরিন্দম নিঃশ্বাস বন্ধ করে রইল। গার্ড কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থেকে চারপাশে তাকাল, তারপর ধীরগতিতে আবার সামনে এগিয়ে গেল।
অরিন্দম জানত, তার জন্য সময় খুবই সীমিত।
সে করিডরের বাঁক ঘুরে দ্রুত ‘ক্লিনিকাল ট্রায়াল সেকশন’-এর দিকে এগোল। সেখানে ঢোকার একমাত্র বৈধ উপায় ছিল হাসপাতালের স্টাফদের আইডি কার্ড। কিন্তু তার কাছে সেটি ছিল না। তবে, সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, রাত তিনটে থেকে তিনটে দশের মধ্যে এই দরজা আনলক করা হয়, কারণ গবেষণাগারের ভিতরের কিছু টেকনিশিয়ান শিফট পরিবর্তন করে। তার এখনও দুই মিনিট সময় আছে। দরজার কাছে গিয়ে সে গা টান টান করে দাঁড়াল। আশেপাশে কোন ক্যামেরা নেই, এটা তার পক্ষে ভাল।
ঠিক তিনটে বাজতেই দরজাটা সামান্য বিপ শব্দ করে খুলে গেল, ভিতর থেকে একজন কর্মচারী বেরিয়ে এল। অরিন্দম এক সেকেন্ডও নষ্ট করল না। দ্রুত সেই লোকের পিছনে ঘেঁষে দরজার ফাঁক দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ল। ভিতরের বাতাস ঠাণ্ডা, কিন্তু গন্ধ ছিল ভয়ংকর—ক্লোরোফর্ম আর কাঁচা মাংসের সংমিশ্রণ। অরিন্দম জানত, সে এখন আরেকটি জগতে প্রবেশ করেছে—একটি অন্ধকার জগত, যেখানে বিজ্ঞান ও মানবতার সীমা চিরতরে ভেঙে গিয়েছে। এখন তাকে যা করতে হবে, সেটাই নির্ধারণ করবে সে বেঁচে ফিরবে কিনা। অরিন্দম জানত না, সে যা করতে যাচ্ছে, তা কেবল একটি ষড়যন্ত্র ফাঁস করা নয়—এটি হতে যাচ্ছে তার জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর সত্যের মুখোমুখি হওয়া।
তিনদিন আগে, সে একটি অজানা মেইল আইডি থেকে একটি ইমেইল পেয়েছিল।
“আমি জানি, আপনি সত্যের সন্ধানে থাকেন। আমি জানি, আপনি দুর্নীতির বিরূদ্ধে দাঁড়াতে পারেন। কিন্তু আপনি কি সত্যিই প্রস্তুত? রেইভেনউড হাসপাতালের নিচে যা ঘটছে, তা অমানবিকতার চরম সীমা অতিক্রম করেছে। আমি এখানে কাজ করি, কিন্তু আমি আর নীরব থাকতে পারছি না। জেলের আসামীদের ধরে এনে তাদের উপর অমানবিক এক্সপেরিমেন্ট চালানো হচ্ছে।
এটি শুধুমাত্র একটি মেডিকেল গবেষণা নয়—সরকার একটি সুপার সোলজার প্রোজেক্ট চালাচ্ছে। যদি আপনি সত্য জানতে চান, তাহলে আপনাকে হাসপাতালে প্রবেশ করতে হবে। কিন্তু সাবধান, একবার ঢুকে গেলে ফিরে আসা কঠিন হবে।”
অরিন্দম প্রথমে ভেবেছিল এটি হয়ত কোন মিথ্যা খবর। কিন্তু সে যখন হাসপাতাল সম্পর্কে আরও খোঁজখবর নেয়, তখন বুঝতে পারে সরকারি নথিতে হাসপাতালের নিচতলার কোন অস্তিত্ব নেই, অথচ সেখানে নিয়মিত বিশাল পরিমাণ সরঞ্জাম প্রবেশ করছে। এবং আজ, সে এই হাসপাতালের ভিতরে।
ভিতরের করিডরটি ছিল আগের চেয়ে আরও নিঃস্তব্ধ। এখানে আসার পর থেকেই অরিন্দমের মনে হচ্ছিল, কেউ যেন তাকে অনুসরণ করছে। তবে সে জানত, ভয় পেলে চলবে না। সে তার সূত্রের দেওয়া মানচিত্র অনুযায়ী ক্লিনিকাল ট্রায়াল ওয়ার্ডের দিকে এগিয়ে চলল। সামনে একটি লাল দরজা, যার উপর লেখা: “AUTHORIZED PERSONNEL ONLY.” অরিন্দম দরজার পাশে দাঁড়িয়ে শুনতে চেষ্টা করল। ভিতর থেকে অদ্ভুত সব শব্দ ভেসে আসছে—একজন মানুষের গোঙানির শব্দ, সঙ্গে ধাতব কিছু সরানোর আওয়াজ। সে জানত, একবার ঢুকলে হয়ত আর সহজে বের হওয়া যাবে না। কিন্তু সত্য জানতে হ’লে তাকে এই দরজা পার হতেই হবে। অরিন্দম জানত, এই দরজা একবার পার হ’লে পিছনে ফেরার পথ থাকবে না। সে পকেট থেকে ছোট একটি পকেট-মিরর বের করল এবং দরজার ফাঁক দিয়ে ভিতরের প্রতিফলন দেখার চেষ্টা করল। একটা ঘোর অন্ধকার ঘর, একপাশে পুরনো স্ট্রেচারে বাঁধা একজন মানুষ কাঁপছে। পাশে দাঁড়িয়ে আছে দু’জন ব্যক্তি—একজন ডাক্তার, অন্যজন সিকিউরিটি গার্ড।
“ডোজ বেশি হয়ে গিয়েছে। সাবজেক্ট ১২৩ রেসপণ্ড করছে না!” ডাক্তারটি উত্তেজিত কণ্ঠে বলল।
গার্ডটা মাথা নাড়িয়ে কিছু বলল, কিন্তু তার কথা অরিন্দম শুনতে পেল না। তবে তার চোখ নিচের দিকে আটকে গেল। রক্ত। ফ্লোরে তাজা রক্ত জমে আছে, লম্বা দাগ টেনে কেউ যেন কিছু টেনে নিয়ে গিয়েছে। অরিন্দম বুঝল, এখানে কিছু ভয়ানক চলছে। সে গভীর নিঃশ্বাস নিল। দরজা খুলতে হবে, কিন্তু কোন আওয়াজ করা যাবে না। পকেট থেকে সরু মাল্টিটুল বের করে লক তুলতে লাগল।
ক্লিক!
দরজার লক খুলে গেল। সে ধীরে ধীরে দরজাটা ঠেলে দিল। ভিতরের বাতাস ছিল ঠাণ্ডা, তবু ঘামে ভিজে গেল সে। কোন শব্দ না করেই সে ভিতরে ঢুকল। দরজার পাশেই একটা বড় স্টোরেজ কেবিনেট ছিল, সে দ্রুত সেটার পিছনে লুকিয়ে পড়ল। ভিতরে ডাক্তার ও গার্ডের কথা শোনা যাচ্ছে।
“সব সাবজেক্ট ঠিকভাবে টিকে থাকছে না। কিছু ভয়ংকর হয়ে যাচ্ছে।”
“তাহলে ফেজ থ্রি শুরু করব?”
“আমাদের কোন উপায় নেই। আমরা সরকারের কাছে দায়বদ্ধ। ওরা চাইলে আমরা চালিয়ে যাব।”
অরিন্দম বুঝতে পারল, ফেজ থ্রি মানে হতে পারে সবচেয়ে ভয়ানক কিছু। অরিন্দম জানত, সময় খুবই সীমিত। তার এখানে আসার কথা কেউ জানে না—অন্তত সে তাই মনে করছে। সে স্টোরেজ কেবিনেটের আড়াল থেকে ধীরে ধীরে মাথা বের করল। ঘরের বাঁ দিকে আরও একটা দরজা খোলা ছিল, যেখানে হলুদ আলো জ্বলছিল। সেই দরজার ওপাশে একটা বড় কাচের ঘর দেখা যাচ্ছিল, যেন ল্যাবরেটরির ভিতরের অংশ। ডাক্তার আর গার্ড ব্যস্ত ছিল সাবজেক্ট ১২৩-কে নিয়ে। সাবজেক্টের শরীর ভয়ানকভাবে কাঁপছে, মুখ দিয়ে ফেনা বের হচ্ছে। শরীরের চামড়া ফেটে গিয়েছে কয়েক জায়গায়, আর শিরাগুলো অস্বাভাবিকভাবে ফুলে উঠেছে।
“শরীর এটাকে গ্রহণ করছে না। নিউরাল এনহ্যান্সমেন্ট ব্যর্থ হচ্ছে!”
ডাক্তার দ্রুত কিছু ইনজেকশন বের করে শরীরে প্রবেশ করাল, কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই সাবজেক্টটা থেমে গেল। মৃত? না। পরের মুহূর্তেই দেহটা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল।
সেই মুহূর্তে, অরিন্দম দ্রুত সামনে এগিয়ে গেল, আরেকটি সরু করিডরের দিকে। এটি ছিল হাসপাতালের সেই গোপন অংশ, যা সরকারি নথিতে নেই। করিডরটি ছিল অন্ধকার, দেওয়ালের গায়ে ছোপ ছোপ দাগ। কিছু জায়গায় হাতের ছাপ লেগে আছে—রক্তাক্ত হাতের ছাপ। এগোতে এগোতে সে বুঝতে পারল, এই প্রোজেক্টটা শুধুই জেলের কয়েদিদের উপর চালানো এক্সপেরিমেন্ট নয়। এখানে আরও গভীর কিছু ঘটছে। হঠাৎ করিডরের এক জায়গায় সে দাঁড়িয়ে গেল। ঠিক তখনই, তার পিছনে একটা শব্দ হ’ল—
“তুমি এখানে কী করছ?”
অরিন্দম জমে গেল। কেউ তাকে দেখে ফেলেছে। অরিন্দম ধীরে ধীরে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল। সামনেই দাঁড়িয়ে আছে একজন সিকিউরিটি গার্ড। তার হাতে কালো রঙের ট্রাঞ্জিক স্টান বেটন, যা হালকা বিদ্যুৎচমকের মত শব্দ করছে। গার্ডের চোখে ছিল কিছু একটা ধরে ফেলার তীব্র আগ্রহ, কিন্তু সন্দেহ মিশ্রিত।
“তুমি কে?”
অরিন্দম জানত, ভুল উত্তর দিলেই বিপদ। “আমি… ডাক্তার রায় আমাকে পাঠিয়েছেন।”
গার্ড এক পা এগিয়ে এল। “ডাক্তার রায়? ওনার তো আজ শিফট নেই।”
তার মিথ্যে ধরে ফেলতে বেশি দেরি নেই। গার্ড আরেক পা এগিয়ে এলো, এবার তার হাতে থাকা স্টান বেটনটা একটু ওপরে তুলল। অরিন্দম জানত, এখন পালাতে না পারলে এই জায়গা তার শেষ গন্তব্য হতে পারে। সে এক সেকেন্ডের বেশি অপেক্ষা করল না। অরিন্দম গার্ডের মুখে সজোরে ঘুষি বসিয়ে দিল। গার্ড এক মুহূর্তের জন্য দুলে উঠল, কিন্তু পুরোপুরি পড়ল না। গার্ড সঙ্গে সঙ্গে স্টান বেটন চালিয়ে দিল, অরিন্দম এক ঝটকায় সরে গিয়ে পাশের করিডরে ঢুকে পড়ল।
“সতর্ক থাকো! একজন অনুপ্রবেশকারী!” গার্ড ওয়াকিটকিতে বলে উঠল।
সতর্ক সংকেত বাজতে শুরু করল। করিডরের লাল আলোগুলি ফ্ল্যাশ করতে লাগল। এখন শুধু সময়ের ব্যাপার, যখন পুরো হাসপাতালের সিকিউরিটি তাকে খুঁজতে আসবে। সে ছুটতে শুরু করল। সামনে দু’টো রাস্তা—একটা ডান দিকে, আরেকটা বাঁ দিকে। বাঁ দিকে অন্ধকার, ডান দিকে দূরের ঘরগুলোতে হালকা আলো জ্বলছে। সে জানত, আলো মানেই বিপদ। সে বাঁ দিকে দৌড় দিল। করিডরে অদ্ভুত একটা গন্ধ ছিল। একটা দরজার কাছে পৌঁছেই সে দেখল, দরজার ওপাশে কয়েকটা স্ট্রেচারে মানুষের মত কিছু বাঁধা রয়েছে। কিন্তু তারা কি মানুষ? একজনের চোখ ফাঁকা, মুখ ফেটে গিয়েছে, আরেকজনের হাত দু’টো অস্বাভাবিক রকমের বড়, যেন অস্বাভাবিক কোন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গিয়েছে। এক্সপেরিমেন্টের ফলাফল? অরিন্দম বুঝল, সে ভুল জায়গায় এসে গিয়েছে।
ঠিক তখনই, পিছনে থাপ থাপ শব্দ শোনা গেল। কেউ আসছে। না, কেউ না—অনেকজন! অরিন্দম জানত, ভিতরে ঢুকলে সে হয়ত আর বেরোতে পারবে না। সে দ্রুত করিডরের দিকে ছুটে গেল, পাশের একটা ছোট স্টোররুমের দরজা খোলা দেখে তাড়াতাড়ি ঢুকে পড়ল। দরজাটা একটু ফাঁক রেখে বাইরে উঁকি দিল।
থাপ! থাপ! থাপ! কমপক্ষে চার-পাঁচজন লোক দৌড়ে এল। তারা সাধারণ সিকিউরিটি গার্ড ছিল না—তাদের মুখ ঢাকা ছিল, শরীর শক্তপোক্ত বর্মে ঢাকা, হাতে ভারী অস্ত্র।
“এইদিকে গিয়েছিল!” একজন বলল। অরিন্দম নিঃশ্বাস বন্ধ করে লুকিয়ে রইল।
গার্ডগুলো করিডরে ছড়িয়ে পড়ল, তারা প্রত্যেকটা দরজা খুলে দেখছিল। শালা, ধরা পড়লে মরতে হবে!
স্টোররুমটা ছিল ছোট—পুরনো ফাইলের র্যাক, ভাঙা চেয়ারের স্তূপ, আর এক কোণে একটা কাঠের বাক্স। অরিন্দম তাকিয়ে দেখল—পিছনের দেওয়ালে একটা এয়ার ভেন্ট আছে! এটাই তার একমাত্র সুযোগ। সে আস্তে আস্তে কাঠের বাক্সের উপর উঠে ভেন্টের ঢাকনা খুলল। ঠিক তখনই—
“এই রুমটা চেক করেছ?”
অরিন্দমের হৃদস্পন্দন বন্ধ হওয়ার মত অবস্থা। একজন গার্ড দরজার ঠিক সামনে এসে দাঁড়িয়েছে! অরিন্দম কোনমতে নিজেকে টেনে ভেন্টের ভিতর ঢুকিয়ে নিল, আর অন্ধকারের মধ্যে শরীর চেপে রাখল। গার্ড দরজা খুলল। অরিন্দম নিঃশ্বাস বন্ধ করে রইল। গার্ড ভিতরে ঢুকে তাকাল, চারপাশ দেখল, তারপর বিড়বিড় করে বলল, “হয়ত অন্যদিকে গিয়েছে…”
আর ঠিক তখনই, কিছু একটা নিচে পড়ে গেল। একটা পুরনো ফাইল, যা অরিন্দমের হাত লেগে র্যাক থেকে নিচে পড়েছে! গার্ডের চোখ মুহূর্তের মধ্যে চঞ্চল হয়ে উঠল।
“কে ওখানে?”
সে বন্দুক তুলে র্যাকের দিকে এগিয়ে গেল। ঠিক যখন গার্ড বন্দুক তুলে অরিন্দমের লুকনোর জায়গার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, তখনই—একটা উচ্চস্বরে সতর্কতা অ্যালার্ম বাজতে শুরু করল, পুরো হাসপাতালজুড়ে লাল আলো জ্বলে উঠল।
“সিকিউরিটি ব্রিচ! সিকিউরিটি ব্রিচ! সমস্ত ইউনিট প্রস্তুত হও !”
গার্ড থমকে গেল, ওয়াকিটকিতে কিছু বলতে গেল—কিন্তু ঠিক তখনই, দূর থেকে ভেসে এলো একটা বিকট চিৎকার। কোন মানুষের কণ্ঠস্বর না, বরং যেন কোন জন্তুর গর্জন! তারপর… ধপ! ধপ! ধপ! একটার পর একটা ধাতব দরজা ধাক্কায় ভেঙে পড়ছে! অরিন্দম ভেন্টের মধ্যে থেকে দেখতে পেল—গার্ডের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছে। সে দ্রুত ওয়াকিটকিতে চিৎকার করে বলল, “ও বাইরে এসেছে! ‘ও’ বাইরে এসেছে! সবাই দ্রুত প্রস্তুতি নাও!”
করিডরের অন্য দিক থেকে পায়ের শব্দ ভেসে আসছে। না… শুধু পায়ের শব্দ না, বরং দৌড়ে আসার শব্দ! তারপর…
বিস্ফোরণের মত এক চিৎকার! একটা বিশাল আকৃতির ছায়ামূর্তি করিডরের শেষ মাথায় হাজির হ’ল। লম্বায় প্রায় আট ফুট, অস্বাভাবিক বিশাল শরীর, দু’টো হাত মানুষের তুলনায় অনেক লম্বা, এবং তার শরীরের চামড়া ছিল যেন মাংসপিণ্ডের মত ফাটা-ফাটা, রক্তমাখা। সে দাঁড়িয়ে ছিল, ধীরে ধীরে মাথা ঘুরিয়ে চারপাশ দেখছিল, যেন শিকার খুঁজছে। গার্ডদের মধ্যে একজন চিৎকার করল—”ওকে থামাও! থামাও!”
“বিপ! বিপ! বিপ!”
বন্দুকের ট্রিগার টানা হ’ল, হাসপাতালের দেওয়ালে বুলেটের ঝড় বয়ে গেল। কিন্তু কিছুই কাজে আসল না। সেই জন্তু শুধু এক ঝটকায় প্রথম গার্ডটাকে তুলে ছুঁড়ে মারল, সে করিডরের এক মাথায় গিয়ে ধাক্কা খেল।
অরিন্দম নিঃশ্বাস নিতে পারছিল না। এই জিনিসটার সামনে পড়লে তারও একই পরিণতি হবে! সে আর দেরি করল না, ভেন্টের ভিতর হামাগুড়ি দিয়ে সামনে এগোতে লাগল, অন্ধকারের ভিতর লুকনোর চেষ্টা করল। তার মনে হচ্ছিল, তার পিছনেই কিছু আছে। এই জায়গাটা সাক্ষাৎ মৃত্যুপুরী। এখন অরিন্দমের লক্ষ্য একটাই—বেঁচে থাকা!
লেখক পরিচিতি : অভি সেখ
সঙ্গীতচর্চা করতে ভালবাসেন। গান লেখা, তার সুর দেওয়া, এবং নিজে গাওয়া এর মধ্যেই মনের তৃপ্তি খুঁজে পান। এর সাথে রং-তুলির সাথে নির্জীব কাগজের প্রেক্ষাপটে প্রাণসঞ্চার করার মধ্যেও আনন্দ খুঁজে পান।