শেষে কেউ নেই

লেখক : অভি সেখ

(প্রথম পর্ব)

ঘড়িতে দু’টো পঞ্চান্ন বাজে, জানালার বাইরে শহরটা নিঃশব্দ একটা দানবের মত ঘুমিয়ে আছে, অথচ অর্ণবের মাথার ভিতর যেন কেউ হ্যান্ডসো রোলার চালাচ্ছে। চতুর্থ কাপ কফির শেষ চুমুকটা ঠোঁটে ছোঁয়ায়, কিন্তু জাগরণ আসে না। হাতে তুলি আছে, সামনে বিশাল সাদা ক্যানভাস, আর তার চোখ শূন্যে। “পাঁচটা দিন হয়ে গেল, একটা রেখাও টানতে পারিনি।” নিজেকেই ফিসফিস করে বলে সে। ক্যানভাসটা যেন তাকে নিয়ে খেলা করছে, তার না বলা সব কথা গিলে নিচ্ছে, আর কিছুই ফিরিয়ে দিচ্ছে না।

কয়েক মাস আগেও অর্ণব ছিল গ্যালারির পোস্টারবয়। নামী সমালোচকরা লিখত, তার রঙ কথা বলে, তার আঁচড়ে দেখা যায় বিষণ্ণতার নান্দনিকতা। কিন্তু তখনও কেউ জানত না, এই বিষণ্ণতা শুধু ক্যানভাসে সীমাবদ্ধ নয়—ওটা তার ফুসফুসে ঢুকে গিয়েছে, ঘুমের মধ্যে তাড়া করে ফেরে তাকে। প্রতিদিন সকালে সে ঠিক করে, আজ নতুন কিছু আঁকবে। কিন্তু যতবার তুলিতে রঙ লাগে, মনে হয় আরেকটা ভুল হবে। আরেকটা অপূর্ণ ছবি।
“তুই ব্যর্থ।”
মাথার মধ্যে একটা গলা প্রতিদিন বলেই চলে। সে গলাটা তার নিজেরই, কিন্তু কেমন যেন অচেনা। ঘরের কোণায় পড়ে আছে পুরনো সব ক্যানভাস—অর্ধেক আঁকা, ছিঁড়ে ফেলা, রঙে গন্ধময়। কিছুতে এক নারীর চোখ আঁকা, চোখের নিচে কালি। কিছুতে শুধু ছায়া। কিছুতে আবার কেবল শব্দ: “HELP”, “ENOUGH”, “WHO AM I?” একটা সময় ছিল, যখন সে নিজের শিল্পে মুক্তি পেত। এখন শিল্পটাই তার শ্বাসরোধ করছে। সেই রাতে হঠাৎ সে খেয়াল করে, জানালার পাশে দাঁড়িয়ে একটা ছায়া তাকিয়ে আছে তার দিকে।
“তুমি কে?”
ফিসফিস করে প্রশ্ন করে অর্ণব। ছায়া কিছু বলে না। শুধু ইঙ্গিত করে ক্যানভাসের দিকে। অর্ণব বুঝতে পারে, এই গল্পে সে একা নেই, কেউ বা কিছু তাকে দেখছে। হয়ত ভিতরের কোন ছায়া, হয়ত তারই মানসিক বিভ্রম। কিন্তু এখন তার আর একা থাকার সময় নেই। একটা ক্যানভাসে সে লিখে ফেলে, “শেষে কেউ নেই”। অর্ণবের চোখে ঘুম নেই, জানালার বাইরে ধোঁয়াশা, আর ঘরের ভিতরে অজস্র মুখ। না, তারা এখন নেই। তবু তারা থেকে গিয়েছে—মনে, ব্যথায়, রক্তমাখা তুলিতে।

সে চোখ বন্ধ করলে এক স্কুলের বারান্দা ভেসে ওঠে। ছোট অর্ণব, আঁকায় মন দেওয়া একটা নরম মন, রঙে ঘেরা একটা বাচ্চা। তাকে ডেকে বলা হয়েছিল, “আমাদের বার্ষিক দেওয়াল পত্রিকার কভারটা তুই আঁকবি, কেমন?” তখন মনে হয়েছিল, এটা স্বীকৃতি, সম্মান। কিন্তু পরে বুঝেছিল, এটা ছিল ব্যবহার। প্রথমে বলেছিল, “তোর নামটা রাখা হবে।” শেষ পর্যন্ত নাম দেওয়া হয় নি। আর বলেছিল, তার জন্য নাকি এটা সম্মানের ব্যাপার। তবে সেটা সম্মান ছিল না, সেটা ছিল চুরি।
কলেজে উঠে আরও একবার এমন হয়েছিল। একজন তথাকথিত লেখক একটা কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করছিলেন। প্রচ্ছদ আঁকার জন্য অর্ণবকে ডাকলেন। “তুই বন্ধু, তুই তো বুঝবি!” অর্ণব আঁকল, মন দিয়ে, গভীর চিন্তা নিয়ে। বই ছাপা হল। লেখক বললেন, “প্রচ্ছদ ভাল হয়নি। তোর নাম দিইনি, বুঝলি? আবার করাব ভাল কাউকে দিয়ে। তোর আঁকা দেখে কেউ কিনবে না বইটা।” সেদিন অর্ণব হাসতে পারেনি, চিৎকারও করতে পারেনি। শুধু বুঝেছিল এই দুনিয়ায় শিল্পীর মন নেই, আছে শুধু তার ব্যবহারযোগ্য হাত।
একবার এক প্রাইভেট স্কুলে একটা চিত্র প্রদর্শনীর জন্য তাকে ডাকা হয়েছিল। বোঝানো হয়েছিল, এটা তার জন্য এক্সপোজার। তাকে দিয়ে স্কুলের ব্যানার, ওয়াল ডিজাইন, বুকলেট, এমনকি প্রিন্সিপালের অফিস পর্যন্ত সাজানো হয়েছিল। শেষে তাকে দেওয়া হয়েছিল একটা একটা মিষ্টির প্যাকেট আর জলের বোতল।
কেউ বলে না, তার ব্রাশ কেনার টাকাটা এল কোথা থেকে। কেউ জানে না, একেকটা আঁকার পেছনে তার কত রাত না-ঘুমিয়ে কেটেছে। কেউ দেখে না, একেকটা অপমান এবং অবহেলা তাকে কতখানি নিঃস্ব করেছে।

ক্যানভাসের দিকে তাকিয়ে অর্ণব হঠাৎ নিজের হাতটা দেখল। ঝাঁকুনি খেল যেন। কতদিন ধরে ব্রাশ ধরছে সে? কেন আবার তুলছে? অথচ হৃদয়ে একটা আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে—এইবার, আর কেউ ব্যবহার করবে না তাকে। তুলিটা ক্যানভাসে ছোঁয়াল সে, শুরু করল একটা মুখ আঁকা—অপরাধীদের মুখ, যারা কখনও তার নাম বলেনি, শুধু তার রঙ চুরি করেছে। ক্যানভাসে কিছু রেখা টেনেছে অর্ণব—অস্পষ্ট, ভাঙা, যেন ব্যর্থ কোন অভিপ্রায়। সে চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করল। একঘেয়ে নীরবতা চারপাশে জমে আছে, হঠাৎই মোবাইল ফোনটা কাঁপতে শুরু করল। স্ক্রিনে নামটা দেখে বুকের ভিতর কেমন খচ করে উঠল—রোহন। পাঁচ বছর! ঠিক পাঁচটা বছর পর ফোন করল ছেলেটা। একসাথে স্কুলে পড়েছিল তারা এবং একই স্যারের কাছে আঁকা শিখত। একসাথে রাত জেগে কাজ করত, পুজোর সময় প্যান্ডেল ডেকোরেট করত, আড্ডা দিত, প্রতিদিন বিকালে সাইকেল নিয়ে ঘুরতে যেত, আউটডোরে ছবি আঁকতে যেত। কল ধরতেই ওপাশ থেকে ভেসে এল চেনা সেই গলা—“কী খবর রে অর্ণব? ভুলেই তো গিয়েছিস। কী করছিস রে এখন?”
এক মুহূর্তের জন্য অর্ণবের গলা শুকিয়ে গেল। তারপর ফিসফিস করে বলল, “বেঁচে আছি… আঁকছি…”
রোহন হেসে উঠল, “তুই এখনও আঁকিস? বাহ! দারুণ তো!” একটা নিঃশব্দ বিরতি। “আমি আর আঁকি না রে। বহুদিন ছেড়ে দিয়েছি।”
অর্ণব কিছু বলল না। রোহন নিজেই বলল, “তুই তো জানিস, কত দৌড়েছি এদিক ওদিক। শেষে আর পারলাম না। অনেক লড়াইয়ের পর শেষে হেরে গেলাম, কারণ ছবি এঁকে পেট চলছিল না। এখন একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে ডিজাইন টিমে কাজ করি। মাইনেটা ঠিক আসে, বাড়ি চলছে। মানে, বুঝলি তো… শান্তি আছে।”
অর্ণব কিছুটা হেসে বলল, “তাই নাকি? কেমন লাগে তোদের ওয়ার্কস্টেশন-শিল্প?”
রোহন একটু চুপ করে বলল, “আরে ধুর! ওটা তো আর আর্ট নয় রে, প্রেজেন্টেশন। রঙ মানে এখন ব্র্যাণ্ড কালার, ফন্ট মানে কোম্পানির গাইডলাইন। সবকিছুতে ব্রিফ, ডেডলাইন, ক্লায়েণ্ট অ্যাপ্রুভাল। কিন্তু আয় আছে, স্ট্যাটাস আছে, মা-বাবা খুশি।”
অর্ণব জানে, রোহন কষ্টে বলে এসব। সে জানে, তাদের দু’জনেই শিল্প ভালবেসে শুরু করেছিল। কিন্তু একজন হার মেনে নিয়েছে বাস্তবের কাছে, আরেকজন এখনও ক্যানভাসের দেওয়ালে মাথা ঠুকছে।
“তোর কোন এক্সিবিশন আছে সামনে?” রোহনের প্রশ্ন।
অর্ণব একটু হেসে বলল, “না। এক্সিবিশন আর এক্সিস্টেন্স একাকার হয়ে গিয়েছে।”
রোহন চুপ করে গেল। তারপর বলল, “তুই চাইলে তো আমায় কাজ পাঠাতে পারিস। আমার অফিসে মাঝে মাঝে কনট্র্যাক্ট বেসিসে প্রোজেক্ট দেয়।”
এই কথা শুনে অর্ণবের বুকের ভিতর যেন হঠাৎ একটা শূন্যতা ফেটে পড়ে। বন্ধুটাও এখন তাকে কাজ দিচ্ছে—চাকরি নয়, ‘অবসর সময়ে কিছু কর’-টাইপের টুকরো প্রোজেক্ট। সে বুঝতে পারে, তাদের মধ্যে ব্যবধান কতটা বড় হয়ে গিয়েছে।
রোহন বলল, “আচ্ছা রে, রাখি এখন। সকালে মিটিং। তুই ভাল থাকিস, কষ্ট নিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
অর্ণব ফোনটা রেখে দিল। চুপচাপ তাকিয়ে রইল শূন্য ক্যানভাসের দিকে। একটা কথা তার মাথায় ঘুরছিল। ছবি আঁকা বন্ধ করলে শান্তি আসে? সে জানে না। সে শুধু জানে, তার শান্তি মানে ক্যানভাসে একটা সঠিক রেখা, যেটা হয়ত সে আজও খুঁজে পায়নি। ফোন রেখে দেওয়ার পর অর্ণব খানিকক্ষণ স্থির বসে থাকল।
রোহনের বলা কথাগুলো মাথার মধ্যে ঘুরছিল, যেন পুরনো ক্ষতগুলো আবার চুলকোচ্ছে। “তুই এখনও আঁকিস?” “আমি ছেড়ে দিয়েছি…” কথাগুলো কেমন কুয়াশার মত জমে যাচ্ছিল ক্যানভাসের কোণায়।

হঠাৎ করেই অর্ণবের মনে পড়ল সেই দিনটার কথা। শিল্পোৎসব ২০১৭, দক্ষিণ কলকাতার এক নামী সংগঠন বিদ্যাসাগর সমিতির আয়োজন। সেদিন বড় সাজানো মঞ্চে দাঁড়িয়ে ছিল একদল নামী মুখ—চোখে চশমা, গলায় শাল, হাতে চায়ের কাপ। তারা বলছিল, “শিল্প সমাজের আয়না। একজন শিল্পী আসলে যুগের বিবেক, আমরা শিল্পীদের সর্বোচ্চ সম্মান দিতে চাই। আমরা শিল্পপ্রেমী, আমরা রবীন্দ্রপ্রেমী, আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের অহংকার…” এমন সব শব্দ, যা শুনে হাততালি পড়ে, কিন্তু যার অর্থ কিচ্ছু নেই। অর্ণবও ছিল সেই অনুষ্ঠানে, নিজের আঁকা তিনটি চিত্র নিয়ে। সেই ছবিগুলো লোকজনের নজর কেড়েছিল ঠিকই, কিন্তু কেউ কিনতে চায়নি। একজন আয়োজক এসে বলেছিল, “আমরা তো তোমার কাজ দেখে মুগ্ধ। তুমি চাইলে আমাদের শিল্পোৎসব ২০১৮-র কভারের জন্য তোমার ছবি দিতে পারো।”
অর্ণব জিজ্ঞেস করেছিল, “পারিশ্রমিকের ব্যাপারে তাহলে একদিন বসা যাক?”
লোকটা হেসে বলেছিল, “আর্ট তো ভালবাসা থেকে আসে ভাই, টাকাপয়সা তো পরে আসে।”
পরের বছর শিল্পোৎসবের থিম বানাল সে প্রায় পাঁচ মাস খেটে। আর পারিশ্রমিকের জায়গায় সে যা পেল, তাতে তার ব্যবহার করা সরঞ্জামের দামটুকুও উঠল না। এমনকি অর্ণবের নামটাও ঠিকভাবে লেখা হয়নি। কোথাও “অর্ণব সেন” হয়ে গিয়েছে “অর্ণব শেন”, কোথাও শুধু কেনার জন্য “A. Sen”। অর্ণব যে কিছু বলবে, তারও উপায় ছিল না, কারণ আয়োজকদের মাথার উপর রুলিং পার্টির বিধায়কের হাত ছিল। আর সেই দিন বিকেলে, সে যখন কিছু খাবার কেনার জন্য ক্যাণ্টিনের পাশে দাঁড়িয়েছিল, একজন সাংস্কৃতিক সম্পাদক রীতিমত বিরক্ত হয়ে বলেছিল, “আর্টিস্টদের তো আমাদের জন্যই এত সুযোগ, না হলে কে দেখত এসব?” অর্ণব সে দিন কাঁদেনি, শুধু মুখ ফিরিয়ে ক্যানভাসটা নিজের হাতে নামিয়ে আনার সময় তার মনে হয়েছিল এই মানুষগুলোই আমাদের ভাঙে, আবার মঞ্চে দাঁড়িয়ে শিল্পীর গুণগান করে।
আজ এতদিন পর, সেই সব মুখগুলো একে একে ফিরে আসছে মনে। বড় বক্তৃতা দেওয়া লোক, যে বলে, “আমরা শিল্পের প্রতি দায়বদ্ধ,” আর পর্দার আড়ালে বলে, “একটা ডিজাইন বানিয়ে দে তো, আমাদের নামে ফ্রি তে করতে হবে।” অর্ণব ধীরে ধীরে চোখ খুলে নিজের আঁকা শেষ ছবিটা দেখল। একটা অর্ধেক মুখ—অস্পষ্ট, ঝাপসা, যেন মুখ নয়—মুখোশ। সে ফিসফিস করে বলল, “তারা চায় শিল্পী থাকুক, কিন্তু শিল্পী যেন মুখ না তোলে।” ছায়া আর আলো মিলে ক্যানভাসের উপর এক অদ্ভুত ধূসরতা তৈরি করছিল। অর্ণব তাকিয়ে ছিল সেই অসম্পূর্ণ ছবিটার দিকে। হঠাৎ তার মনে পড়ল একটা মুখ। বড় বড় ঝাঁকড়া কোঁকড়ানো চুল, চোখে অদ্ভুত আলো নিয়ে তাকিয়ে থাকা মুখ।

সঞ্জয়দা একজন কবি, চিত্রশিল্পী, এবং তাদের আঁকার স্কুলের সিনিয়র। অর্ণব তখন ক্লাস সেভেনে পড়ে। স্কুলের পাশের গলিতে থাকত সঞ্জয়দা। বাড়ির বাইরেই একটা লোহার চেয়ারে বসে একা একা ছবি আঁকত। বড় বড় চুল, হাতে পুরনো তুলির দাগ, আর চোখে এমন এক দৃষ্টি—যেন চারপাশে কিছুই দেখছে না, অথচ সবকিছু দেখেও ফেলছে। অর্ণব প্রায়ই ছুটির দিনে সেখানে যেত। সঞ্জয়দা তাকে ডাকত, আঁকার খাতা দিত। একদিন বলেছিল, “শোন, অর্ণব, আঁকা মানে রং নয়, অনুভব। যে কাঁদে না, সে ক্যানভাসে কান্না আনতে পারে না।” তখন অর্ণব এসবের মানে বুঝত না। শুধু অবাক হয়ে দেখত, কিভাবে একজন মানুষ নিজের বুকের ভিতরের তোলপাড় একটা পাতায় তুলে আনতে পারে।
তবে একটা জিনিস সে লক্ষ্য করেছিল—সঞ্জয়দা অনেক সময় স্তব্ধ হয়ে যেত। চোখের সামনে ফাঁকা কাগজ, পাশে রঙ, আর সে শুধু বসে থাকত। মাঝেমাঝে ঘরের ভিতর থেকে কেউ চেঁচিয়ে বলত, “এবার এ’সব বন্ধ কর! একটা চাকরি কর তো এবার। তোর বয়স হচ্ছে, ছবি এঁকে কিছু হবে না। টাকা ইনকামের রাস্তা দেখ।”
হঠাৎ একদিন খবর এল—সঞ্জয়দা নেই। মাঝরাতে ঘর থেকে পালিয়ে রেলে মাথা দিয়েছে। সেদিন প্রায় বিকাল চারটের সময় তার দেহ নিয়ে আসা হল, রাখা হল বাড়ির উঠোনে, চারপাশে তার আঁকা অজস্র ছবি, তার মাঝখানে নিথর শরীর। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে তার আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধুরা আর তার মা পাথর হয়ে বসে আছে দরজার সামনে। অর্ণব তখন বুঝতে পারেনি। সে শুধু বাড়ি ফিরে মাকে জিজ্ঞেস করেছিল, “দাদা মরে গেল কেন?”
মা বলেছিল, “বোধহয় মাথায় কিছু সমস্যা হয়েছিল। ও’রকম লোকেদের কেউ বোঝে না।”
আজ অর্ণব বুঝতে পারছে, সঞ্জয়দার মাথায় সমস্যা ছিল না, ছিল সমাজের। একজন শিল্পীর হৃদয়ে, যখন কেউ বারবার ছুরি চালায়, “তুই কিছু করছিস না, এতে পেট চলে? আর্ট দিয়ে কি হয়?” তখন একদিন, সে আর শব্দ করে কাঁদে না, নিঃশব্দে ঝরে পড়ে। অর্ণবের চোখে জল আসে, বুক ভারী হয়ে ওঠে। সে নিজের পুরোনো স্কেচবুক খুলে দেখে—একটা পাতায় আঁকা, একটা লোক, তার চোখের সামনে এক ফাঁকা ক্যানভাস, আর চোখে সেই সঞ্জয়দার মত দৃষ্টি। অর্ণব মনে মনে বলে, “আমি জানি দাদা, তুমি হার মানোনি। তোমার চারপাশে যারা ছিল, তারাই হেরে গিয়েছে।”

বৃষ্টি থেমে গিয়েছে। জানালার কাচে গড়িয়ে পড়া শেষ জলের বিন্দুটাও শুকিয়ে গিয়েছে। অর্ণব যেন হঠাৎ ঘুমভাঙা মানুষের মত উঠে বসে। হাঁটতে হাঁটতে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। নীচে রাস্তার আলো, একঘেয়ে শহরের গতি, আর তার ভিতরে সেই চেনা ক্লান্তি। এই ক্লান্তির মধ্যেই একসময় সে নিজেকে খুঁজে পেয়েছিল। সে মনে করে তার নিজের গল্পটা, যেটা অনেক আগেই লেখা হয়েছিল—অর্থহীন কাজের চাপে ক্লান্ত একজন শিল্পীর গল্প, যে রাতে ঘুমোয় না, দিনে চোখে কালি নিয়ে ক্যানভাসের দিকে তাকিয়ে থাকে, যার প্রতিদিনের লড়াই কারও চোখে পড়ে না।
“তুই কি এখনও আঁকিস?” রোহনের প্রশ্নটা আবার কানে বাজে।
“আঁকি,” অর্ণব ধীরে ধীরে বলে ওঠে, “শুধু এখন আর তাদের জন্য নয়, যারা ভালবাসে না—শুধু দাবি করে।”
সে ওয়ার্কডেস্কে ফিরে আসে। টেবিলের ওপর ছড়িয়ে থাকা পুরনো স্কেচ, অপূর্ণ ক্যানভাস, শুকিয়ে যাওয়া তুলি—সব আবার একটু সরায়। একটি নতুন ক্যানভাস সে টেনে আনে—সাদা, ফাঁকা। তার ঠিক পাশেই সে রাখে সঞ্জয়দার একটা পুরনো স্কেচ। মনে মনে ভাবে, “দাদা, এবার আমি তোমার অপূর্ণ ছবিগুলোর ভাষা খুঁজব।” অর্ণব এবার নিজের গল্পের শেষ অধ্যায়টা নতুন করে লিখতে চায়। সে জানে না সেটা বিক্রি হবে কি না, কেউ প্রশংসা করবে কি না। কিন্তু সে জানে, সে আবার আঁকবে—নিজের জন্য, সঞ্জয়দার জন্য, তাদের জন্য, যারা অভিমান নিয়ে হারিয়ে গিয়েছে।
দূরে কোথাও একটা গান শোনা যায়। একটা ক্লাসিকাল সুর, যেটা হয়ত ক্যানভাসে রঙের মত ঢুকে পড়বে। অর্ণব চোখ বন্ধ করে। বাড়ির ভিতরের পরিবেশ এবং আলো হালকা বদলে গিয়েছে। অর্ণব খেয়াল করে, তার ডেস্কের পাশে সেই নতুন ক্যানভাসে সে একটা রেখা টেনেছে। তবে এই রেখা নিখুঁত নয়। এটা একটা কাঁপা হাতের টান, যেন বুকে জমে থাকা কথা প্রথমবার কাগজে পড়ছে। রাত প্রায় তিনটে বাজে। চারদিকে নিস্তব্ধতা, কিন্তু তার মাথার ভিতর শব্দ—চিৎকার, অপমান, ফ্রি তে কাজ করিয়ে নেওয়ার আবদার, বন্ধ দরজার শব্দ, হেসে উড়িয়ে দেওয়া কণ্ঠ—
“ভালোই তো ছবি আঁকিস, কিন্তু ইনকাম কত করছিস?”
“তুই আর্টিস্ট? আমার ছেলের স্কুল প্রজেক্টটা একটু করে দে না!”
“তুই তো আর্টিস্ট, আমাদের মেলার স্টেজের থার্মোকলের ডেকোরেশনটা করে দে না।”
“পুজোয় মণ্ডপের আলপনা আর প্যান্ডেল এর থিম তোকেই করে দিতে হবে কিন্তু এবার।”
“ফ্রি তে , ফ্রি তে , ফ্রি তে…”
এইসব কথাকে সে ক্যানভাসে রঙে রূপ দেয়। প্রথম ছবিটায় সে আঁকে একটা মুখ—অর্ধেক ঢাকা, অর্ধেক জ্বলন্ত। মুখের চোখদু’টো একদিকে তাকিয়ে, অন্যদিকে আগুন। এই সিরিজের নাম দেয়—“অদৃশ্য আর্তনাদ”।

পরবর্তী কয়েক সপ্তাহ ধরে সে এই সিরিজের দশটি ছবি আঁকে। সবগুলোই নিঃশব্দে চিৎকার করে। কেউ একটা ফ্রেমে ঠোঁট খুলে কিছু বলতে চাইছে, কেউ অন্য ফ্রেমে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে, কেউ রক্তাক্ত হাতে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। অর্ণব এবার ঠিক করে, এই কাজগুলো সে একটা এক্সিবিশনে রাখবে। কিন্তু এইবার সে চায় না কোন গ্যালারি কর্পোরেট স্টাইলে তার কাজ হ্যাণ্ডেল করুক। সে ঠিক করে একটা ছোট, ইন্ডিপেণ্ডেণ্ট স্পেসে প্রদর্শনী করবে—যেখানে ঢুকতেই একটা কাগজে লেখা থাকবে: “এই ছবিগুলো শিল্পীর ব্যক্তিগত মানসিক যন্ত্রণার দলিল। আপনি যদি এই যন্ত্রণাকে বোঝেন, তাহলে আপনি একা নন।”
শুরু হয় প্রস্তুতি। বন্ধুদের কেউ কেউ সাহায্য করে, কেউ করে না। একটা আর্ট ক্যাফের মালিক, যার সঙ্গে অর্ণব আগে একটি ফ্রিল্যান্স কাজ করেছিল, জায়গা দিতে রাজি হয়—একটা ছোট্ট হলঘর, শহরের পুরনো এক কোণায়।
তারপর আসে সেই দিন, প্রদর্শনী খোলার দিন। অর্ণব একা বসে থাকে এক কোণে। সে জানে না কেউ আসবে কি না। সে শুধু জানে, সে আর লুকিয়ে নেই। প্রথমে আসে দুই তিনজন—কেউ পুরনো বন্ধু, কেউ ক্যাফের কাস্টমার, তবে কেউ চেনা নয়। তারা ছবির সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে, কেউ চুপচাপ দেখে যায়, কেউ চোখে জল নিয়ে বলে, “এই ছবিটা যেন আমার কথা বলছে।” কেউ একজন বলে, “ভাই, এই না বলা কথাগুলোর ভাষা খুঁজছিলাম।” অর্ণব প্রথমবার বুঝতে পারে, তার ব্যক্তিগত যন্ত্রণা শুধু তার একার নয়। আর্ট একা বাঁচায় না, কিন্তু বাঁচিয়ে রাখে।
তারপর, কে জানে কোথা থেকে, সেই রাতেই সে ইনবক্সে পায় একটা মেসেজ—এক উঠতি লেখক, যে বলে, “ভাই, তোমার ছবিগুলো দেখে একটা গল্প মাথায় এল। যদি অনুমতি দাও, তাহলে তোমার ছবিকে কেন্দ্র করে লিখতে চাই।”
অর্ণব শুধু উত্তর দেয়, “লিখে ফেলো। গল্পটা ওরই প্রাপ্য, যে ছবিটায় বন্দি হয়ে আছে।”

অর্ণব কখনও ভাবেনি যে একটা ছোট গ্যালারিতে প্রদর্শনী করেই এত কিছু বদলে যাবে। তার ছবি মানুষ কেবল দেখে না, অনুভব করে। মানুষ তাকে ইণ্টারভিউতে ডাকে না শুধু তার রঙের জন্য, ডাকে তার অভিজ্ঞতা জানার জন্য—একজন শিল্পী হিসেবে নয়, একজন যোদ্ধা হিসেবে।

শেষে কেউ নেই – অন্তিম পর্ব


লেখক পরিচিতি : অভি সেখ
সঙ্গীতচর্চা করতে ভালবাসেন। গান লেখা, তার সুর দেওয়া, এবং নিজে গাওয়া এর মধ্যেই মনের তৃপ্তি খুঁজে পান। এর সাথে রং-তুলির সাথে নির্জীব কাগজের প্রেক্ষাপটে প্রাণসঞ্চার করার মধ্যেও আনন্দ খুঁজে পান।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।