লেখক : শুভাশিস দাস
আমি এক অতি সাধারণ লোক
অথবা যাকে ব্যঙ্গ করে বলাই যায় “অ-সাধারণ!”
নিতান্ত সাদামাঠা ছোটবেলা – ম্যাড়ম্যাড়ে, সাদা-কালো।
সেই “সুবোধ বালক”কে মনে আছে?
যার গল্প শুনে সবাই বলে “আহা! ছেলেটা কি ভাল!”,
যার কথা লেখা আছে বইয়ের পাতায়,
আর বাস্তব জীবনে যার দেখা পেলে
হাঁদারাম আর ক্যাবলা বলে তাকে ডাকা হয়।
আমি সেই ছেলেটা ছিলাম ছোটবেলায়।
বইয়ের সেই সুবোধ বালকের বড়বেলার কথা কেউ লেখে নি,
লেখার মত কিছু ছিল না তো!
যখন চেনা শরীরে অচেনা অনাগত যৌবনের আঁকিবুঁকি
ধরা পড়ছে হালকা গোঁফের রেখা, আর বদলাতে থাকা কণ্ঠস্বরে,
তখন সব ছেলেদের মনে নিষিদ্ধতার উঁকিঝুঁকি,
কানে কানে ফিসফাস, চোখে চোরা চাহনি, তারা ইঙ্গিতে কথা বলে।
সুবোধ বালক তখন সেই ঝড়ের সমুদ্রে
প্রাণপণ বিধিনিষেধের দাঁড় বেয়ে চলে।
বন্ধুত্ব ধীরে ধীরে আলগা হয়ে আসে,
শুধু পড়ে থাকে পড়ার নোটসের আদান প্রদান।
সমবয়সীদের জীবনে আসছে নতুন বান্ধবী আর আমার তখন
বন্ধু হারানোর দিন, শুরু এক নিঃসঙ্গ জীবন।
একদিন শিক্ষা শেষ হযে ছেলেটা নিজের পায়ে দাঁড়ায়।
অবশেষে তার মনে বসন্তের কোকিল ডেকে ওঠে –
“ওরে জাগ, এসেছে দিন বদলের সময়”
এমনি করে শুরু হয় তার অপেক্ষায় দিন গোনা –
সঙ্গিনী হয়ে কেউ কি আসবে না?
কিন্তু যে জন্ম থেকে মুখচোরা,
বীরভোগ্যা বসুন্ধরা তাকে ধরা দেয় না।
নিষ্ফল প্রতীক্ষায় কেটে যায় বিবর্ণ যৌবনের দিন।
চারিপাশের রঙিন দুনিয়া এতো চাকচিক্যময়,
বড়ো বেমানান লাগে আমার নিজেকে,
মুখ ফেরাই, হয়ে নিজের মধ্যে তন্ময়।
হতাশা কাটিয়ে ছেলেটা আরো বেশি করে কাজে মন দেয়।
বড় হতে হবে তাকে, অনেক বড়!
একটা অন্তত খুব বড় সাফল্য সে পেতে চায়।
যাকে দেখে লোকে বলবে, মিথ্যা লেখা নেই বইয়ের পাতায় –
জয় সে পাবেই,
যার জীবনে আছে ন্যায়, নীতি, সততা আর অধ্যাবসায়।
হায় রে মূর্খ! কাজই শুধু শিখলাম, কাজের দাম বুঝে নিতে শিখলাম না!
আমার দক্ষতা যারা কাজে লাগাল,
কাজের দামটুকুও তারাই নিয়ে গেল।
আমি শুধু শুকনো হাততালি কুড়োলাম!
তবুও একদিন ঘর বাঁধলাম – আমার ক্ষণিক সুখের ঘর।
কিন্তু নিয়ম ভেঙ্গে যারা সুবিধা কেড়ে নিতে জানে না,
সংসারে তাদের নেই কোন কদর।
নিয়ম মেনেই তাদের ঘরে অ-সুখ একদিন বাসা বাঁধে।
ঘরের মানুষরাও তো রক্তমাংসে গড়া –
না পাওয়ার যন্ত্রণায় তারা গুমরে গুমরে কাঁদে।
আমার বুকভরা কষ্ট – মুখ ফুটে কত কিছু বলতে চায়,
কিন্তু সে কথা চাপা পড়ে সংসারের কোলাহলে।
নিজেকে বোঝাতে পারি না – সে ব্যথা আমায় কুরে কুরে খায়।
আমি মুক্তি চাই, চাই একটু খোলা হাওয়ায় শ্বাস নিতে,
কিন্তু আমার পা শিকলে বাঁধা – সংসারের ঘানি টেনে চলে
অবিরাম, কেউ কি পাচ্ছ আমার কথা শুনতে?
আপনি, তুমি, তোমরা বা আপনারা –
জীবনের এই ব্যস্ত পথচলার মাঝে যদি কখনও দেখা পাও তার,
যে কিনা আমারই মতো কোন অকর্মণ্য মুখচোরা,
আমাকে তার খবর দিতে যেন ভুলো না!
তাকে নিয়ে যাব আমি, কোন এক নির্জন সমুদ্র সৈকতে
মুখোমুখি কিছুক্ষণ বসব দুজনা,
বুক ভরে শ্বাস নেব, ভাগ করে নেব যত মনের ব্যথা।
ঢেউয়ের গর্জন ঢেকে দেবে আমাদের সেই বার্তালাপ –
ফালতু লোকের ফালতু কথা।
লেখক পরিচিতি : শুভাশিস দাস
তথ্য প্রযুক্তি সংস্থায় কর্মরত। অবসর সময়ে বাংলায় লেখার চর্চা। প্রিয় লেখক শরৎচন্দ্র, প্রিয় উপন্যাস শ্রীকান্ত।