লেখক : অভীক সিংহ
রবিবারের সকালটায় হাতে একটা ব্যাগ ঝুলিয়ে বাজারে এসে দরাদরি না করলে, বেগুনের পেটটা টিপেটাপে না দেখলে, নারকোলটা ঝাঁকিয়ে ভিতরে জলের আওয়াজ না পেলে, কাঁচালঙ্কার কোণা ভেঙে একটু চিবিয়ে উহ-আহ না করলে প্রাণটা কেমন যেন আইঢাই করতে থাকে। তার উপরে আবার সক্কাল সক্কাল উড়ো খবর পেয়েছি, আজ নাকি মাছের বাজারে বেশ গাবদা গাবদা পাবদা এসেছে। একে বাঙালী, তায় পাবদা, তার উপরে আবার রবিবার – ব্যাস আর যায় কোথায়? খবরটি কানে ঢোকা মাত্র জামাটি গলিয়ে স্কুটিটি বাগিয়ে ছুটেছি বাজারে। ঢুকেই সবজিপাতির দিকে একটু চোখ বুলিয়ে সোজা আক্রমণ করেছি মাছের বাজারে। আরিব্বাস! মাইরি, পাবদাগুলো দেখেই তো জিবে জল আসার উপক্রম। এ জিনিস কি ছেড়ে দেওয়া যায়? উপরওয়ালা পাপ দিলে আমাশা হয়ে যাবে যে। আর দেরী করলে চোখের সামনে দিয়েই ফুড়ুৎ হয়ে যাবে। তাই আর কালবিলম্ব না করে খোকনদাকে বললাম, “আরে জব্বর জিনিস এনেছ তো দেখছি। সক্কাল সক্কাল একেবারে দিলখুশ করে দিলে। আড়াই কিলো দিয়ে দাও দিকিনি।”
“একাই সবটা সাবড়ে দেওয়ার প্ল্যান করছ নাকি হে?” পিছন থেকে চেনা গলার আওয়াজ পেয়ে ফিরে দেখি সান্যালদা দাঁড়িয়ে, মুখে হাসি, হাতে ব্যাগ।
“আরে গুরু, তুমি তো হয় রুই নয়ত পাঁঠার জগতে বিচরণ করো জানতাম। তো আজ এদিকে পথ ভুলে নাকি?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
“আরে তোমার কোন আইডিয়া নেই, আমার মনটা কিন্তু বিশাল বড়। পাকা রুই আর কচি পাঁঠার পাশে পাবদার জন্যেও একটুখানি জায়গা বরাবর বরাদ্দ রেখে দিই।”
“তা তুমিও সক্কাল সক্কাল পাবদার খবরটা পেয়ে গিয়েছিলে?”
“সে আবার বলতে? খবরটা পেতেই সোজা এখানে।”
“তবে আর কী, আজ তো তার মানে দুপুরবেলাটা জমে যাবে।” বলে আমি খোকনদার দিকে ফিরে বললাম, “খোকনদা, চার কিলো দিয়ে দাও সান্যালদার জন্য।”
“এই, তুমি পাগল নাকি?” সান্যালদা হাঁ-হাঁ করে উঠল, “এত খাবে কে? আবার পাঁঠাও তো নিতে হবে। তুমি বরং আড়াই কিলোই বলে দাও।”
কিছুক্ষণ পরে আমি আর সান্যালদা আমাদের সফল পাবদা অভিযান সেরে মাছের বাজার থেকে বেরোলাম। বেরিয়ে এসে একটু অন্যমনস্কভাবেই সান্যালদা বলল, “আজ নাহয় পাঁঠাটা থাক, অন্য একদিন এসে নিয়ে যাব। ভাবছি, আজ দুপুরে এই পাবদাগুলোর একটু সদ্ব্যবহার করা যাক। একটু কাঁচালঙ্কা আর সর্ষেবাটা দিয়ে আর উপর থেকে একটু সর্ষের তেল ছড়িয়ে ধোঁয়া ওঠা গরম ভাতের সাথে – উফফ, ভেবেই ক্ষিদে পেয়ে গেল মাইরি।”
“তোমার কথা শুনে তো আমারও ক্ষিদে পেয়ে গেল দেখছি। চলো দেখি, এদিকটায় আজ কিছু ইস্পেশাল পাওয়া যায় কি না।” বলে সান্যালদাকে সাথে নিয়ে বাজারের অন্যদিকে এগোলাম। একটু এগিয়েই দেখি একটা দোকানে গরম ঘিয়ে আলু-ফুলকপি-বাদামের সিঙাড়া ভেজে গামলায় তুলছে, আর পাশেই তৈরী হচ্ছে আদা দিয়ে গরমাগরম চা। দেখেই যেন পেটের মধ্যে ক্ষিদেটা সটান চাগাড় দিয়ে উঠল।
“কি গুরু, হবে নাকি একটু?” আমি মুচকি হেসে জিজ্ঞাসা করলাম।
সান্যালদা পেটে হাত বুলোতে বুলোতে বলল, “সকালের জলখাবার তো এখনও পেটে পড়েনি। আর বেশিক্ষণ খালি পেটে থাকলে প্রেশারটা ফল করে যেতে পারে। তাছাড়া –”
“ব্যাস, ব্যাস, আর বলতে হবে না। বুঝে গেছি। এসো আমার সাথে।”
বলে আমরা দু’জনে দোকানের সামনের বেঞ্চিতে বসে দু’টো করে সিঙাড়া আর চা দিতে বলে দিলাম। কয়েক মিনিটের মধ্যেই শালপাতার প্লেটে লাল চাটনি সহযোগে সিঙাড়া আর কাচের গ্লাসে চা চলে আসল। সিঙাড়ার গা বেয়ে গড়িয়ে পড়া ঘি আর ধূমায়িত চায়ের সুবাস – আহা, এই না হলে রবিবার সকাল। চায়ের কাপে সশব্দে প্রথম চুমুকটা দিয়ে “আহহ” বলে একটা তৃপ্তির আওয়াজ ছাড়ল সান্যালদা। তারপরে চায়ের কাপটা পাশে রেখে সিঙাড়ায় একটা পেল্লায় কামড় বসিয়ে বেঞ্চে রাখা খবরের কাগজটা তুলে নিল।
“বেড়ে বানিয়েছে কিন্তু।” সান্যালদার গলায় ছলকে ওঠা প্রেমরসের ভাব স্পষ্ট।
“সেই জন্যই তো তোমাকে এদিকটায় আনলাম। আগে এসেছ বলে তো মনে হচ্ছে না।” আমি সিঙাড়ার গা বেয়ে গড়িয়ে পড়া ঘি-টা আঙুল দিয়ে চাটতে চাটতে বললাম।
“তা ঠিকই বলেছ। বাজারপাট নিয়ে আর কোথাও বসা হয় না। তাছাড়া তুমি আসো এই সক্কাল বেলা, আর আমি আসি একটু বেলা করে। তাই তো দেখা হয় না। আজ পাবদার জোরেই দেখাটা হয়ে গেল। আর সেখান থেকেই এই চা আর সিঙাড়া।” বলতে বলতে চায়ের কাপে আরেকটা চুমুক দিল সান্যালদা।
“তা অবশ্য খুব একটা ভুল বলনি,” আমি সিঙাড়া চেবাতে চেবাতে বললাম, “তা আজ নতুন খবর কিছু আছে নাকি?”
“ধুস, সেই একই খবর চারিদিকে। হয় মন্ত্রী চুরি করেছে, নয়ত কোন অভিনেতা বিয়ে করেছে, নয়ত কোন টেররিস্ট মারা পড়েছে।” বলে বিরক্তির নিতান্ত সাথেই সান্যালদা খবরের কাগজটা বেঞ্চের উপরে ভাঁজ করে রেখে দিল।
“কোন টেররিস্ট মারা পড়েছে নাকি?” আমি চায়ের কাপটা তুলতে তুলতে জিজ্ঞাসা করলাম।
“হ্যাঁ, কাশ্মীরে সেনাবাহিনীর গুলিতে একটা আপদ টপকেছে।”
“যাক, এরা যত মাইনাস হয়, ততই ভাল।” আমি চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে বললাম, “তবে এদের ধাওয়া করতে কিন্তু বেশ সাহস আর মনের জোর লাগে।”
“সে তো বটেই।” সান্যালদা বেশ জোরের সাথে বলল, “নিজের প্রাণের বিনিময়ে দেশের সুরক্ষার ব্যাপার, সাহস আর মনের জোর তো লাগবেই।”
“একদম খাঁটি কথা বলেছ।” আমি চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে বললাম, “এই যেমন দেখোই না, কয়েক বছর আগে আমিই তো একবার –”
“অ্যাই, একদম না মাইরি। সক্কাল সক্কাল চা-সিঙাড়া খাইয়ে ঢপের গ্যাস দিয়ে অম্বল করিয়ে দেবে।” সান্যালদা ঝাঁঝিয়ে উঠল।
“আরে শোনই না,” আমি আব্দারের সুরে বললাম।
“একদম না। মাইরি তুমি টেররিস্ট ধরতে ছুটেছিলে? পেঁয়াজি হচ্ছে?”
“বলেন কী মশাই, আপনি টেররিস্ট ধরতে ছুটেছিলেন?” বেঞ্চে আমাদের উল্টোদিকে বসে থাকা এক ভদ্রলোক বিস্ফারিত চোখে উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।
“না না, তেমন কিছু নয় –” বলে সান্যালদা ব্যাপারটা ধামাচাপা দেওয়ার উপক্রম করতেই সামনের ভদ্রলোক বলে উঠলেন, “আহা, আপনি একটু দাঁড়ান না।” তারপরে আমার দিকে চমকিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, “আপনি বলুন। এমন ঘটনা কি আর রোজ রোজ শোনা যায়।”
সান্যালদা মাথা নীচু করে ঘাড় চুলকোতে চুলকোতে মৃদুস্বরে বলল, “সে পোড়া কপাল তো আর সকলের নেই।”
“কিছু বললেন?” ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন।
“না না, উনি আপনাকে কিছু বলেননি।” আমি বললাম, “তবে গল্পটা বলতে তো সময় লাগবে। একটু চা আর সিঙাড়া হলে –”
আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই ভদ্রলোক “এই এখানে দু’টো চা আর দু’প্লেট সিঙাড়া” বলে একটা বাজখাঁই হুঙ্কার ছেড়ে আবার আমাদের দিকে হাসিমুখে তাকালেন। বলতে বলতে চলে আসল আরেক রাউণ্ড চা-সিঙাড়া। সান্যালদা বেবাক হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে। আমি মুচকি হেসে সান্যালদার দিকে চোখ টিপে চায়ের কাপটা তুলে একটা চুমুক দিয়ে শুরু করলাম।
এই গল্পটা বলতে গেলে ফিরে যেতে হবে ২০১৭ সালে। তখন হায়দ্রাবাদে বাসা বেঁধেছি। পিএইছডি করার পরে একটা স্টার্টআপ কোম্পানীতে যোগ দিয়েছিলাম। সেই কোম্পানী বিক্রি হয়ে যাওয়ার জোগাড় হওয়াতে চাকরিটা ছেড়ে যোগ দিয়েছি একটা আধা-সরকারী প্রতিষ্ঠানে। আমার বাসা থেকে বিশেষ দূরেও নয়, স্কুটি চেপে যাওয়া-আসা করতে বেশ লাগত। রোজ হুসেনসাগরের পাশ দিয়েই যাওয়া আসা করতাম। আর হায়দ্রাবাদে গিয়ে একটা অদ্ভুত শখও হয়েছিল। সেটা হ’ল বিভিন্ন জায়গার বিরিয়ানি আর ইরানি চা চেখে বেড়ানো। আর জানেনই তো, হায়দ্রাবাদ ওই দু’টো জিনিসের জন্যই বিখ্যাত। সেই কারণে সুযোগ পেলেই হায়দ্রাবাদের গলিঘুঁজি চষে বেড়াতাম। আর সেই সূত্র ধরেই হায়দ্রাবাদের জনতার ব্যাপারে একটা তথ্য আবিষ্কার করলাম। দেদার গল্প, আড্ডা, জমিয়ে খাওয়াদাওয়া, আর টাইমপাস করার সুযোগ হায়দ্রাবাদী জনতা কখনই ছাড়ে না। একেবারে নির্ঝঞ্ঝাট প্রকৃতির মানুষজন। জীবনের যাবতীয় ঝামেলাকে বিরিয়ানি আর ইরানি চা দিয়েই সামলে নিতে জানে। তো এদের নিয়ে আমার দিনগুলো বেশ কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু বিপত্তিটা বাধল একদিন।
অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে পড়ত একটা চায়ের দোকান। রোজ অফিস থেকে বেরিয়ে সেখানে বসে এককাপ ইরানি চা আর দু’টো করাচি বিস্কুট খেয়ে তারপরে বাড়ির দিকে এগোতাম। অফিস থেকে মোটামুটি সন্ধ্যে ছ’টা নাগাদ বেরিয়ে পড়তাম, সোওয়া ছ’টা নাগাদ চলে আসতাম চায়ের দোকানটায়, আর চা-বিস্কুট খেয়ে সাড়ে ছ’টা নাগাদ উঠে পড়তাম। এটা ছিল আমার একরকম বাঁধা রুটিন। এই রকমই একদিন অফিস থেকে ব্যাগপতে গুছিয়ে নিয়ে বেরোতে যাব, অফিসের ফোনটা বেজে উঠল। আমার সিনিয়র জরুরি তলব করেছেন। কী আর করা, অগত্যা ব্যাগপত্র টেবিলে রেখে গেলাম ওনার কেবিনে। একটা সরকারী প্রোজেক্টের প্রোপোজাল জমা দিতে হবে, আর সেদিনই জমা দেওয়ার শেষ তারিখ। এই প্রোপোজাল জমা দেওয়ার জন্য লাগবে একগাদা নথিপত্র, সেগুলোকে প্রোপোজালের সাথেই জমা করতে হবে। গেল মাথাটা খিঁচড়ে। দুপুরেও এই সিনিয়রটিকে দেখেছি কেবিনে বসে চেয়ারে গা এলিয়ে নাক ডাকতে। আর এই সন্ধ্যেবেলায় ওনার মনে পড়েছে এই প্রোপোজাল জমা দেওয়ার কথা। আর যেহেতু আমি সদ্য যোগ দিয়েছি, তাই আমাকে মুরগী করাটা সবচেয়ে সহজ। তার উপরে আবার প্রোবেশনে রয়েছি, তাই আমার বিশেষ কিছু বলবার যো নেই। মনেমনে ওনার ঊর্ধ্বতন চোদ্দপুরুষের মুণ্ডপাত করতে করতে ওনার কেবিন থেকে বেরোলাম নথিপত্র সংগ্রহ করতে। প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট পরে সমস্ত নথিপত্র জোগাড় করে গেলাম ওনার কেবিনে। আর গিয়ে দেখি, যথারীতি উনি এই সময়টুকুর চমৎকার সদ্ব্যবহার করছেন – নাক ডাকিয়ে। ওনাকে ডাকতেই উনি চোখ খুলে হেঁ-হেঁ করতে করতে সমস্ত নথিপত্র পরীক্ষা করা শুরু করলেন। শেষমেশ প্রায় আধঘণ্টা পরে সমস্ত পরীক্ষানিরীক্ষা শেষ করে যখন প্রোপোজাল জমা হ’ল, তখন ঘড়িতে প্রায় সাড়ে সাতটা বাজব বাজব করছে। প্রাণ তখন চা-চা করছে। এত দেরী হয়ে গিয়েছে, চায়ের দোকানটা কি আর এখন খোলা থাকবে? তখন যদি কেউ আমার মাথাটা স্ক্যান করত, তাহলে স্পষ্ট একটা সাইকোলজিক্যাল হরর সিনেমা দেখতে পেত, যেখানে অধস্তন কর্মচারী তার ঊর্ধ্বতন কর্মচারীকে উল্টো করে ঝুলিয়ে নাকের মধ্যে গরম সাঁড়াশি গুঁজে খুন করছে। মনেমনে আমার সিনিয়রটিকে একগাদা শাপশাপান্ত করতে করতে অফিস থেকে বেরিয়ে স্কুটি নিয়ে ছুটলাম চায়ের দোকানের উদ্দেশ্যে। দূর থেকে দোকানটির আলো জ্বলতে দেখে তখন আমার ক্ষ্যাপার পরশপাথর খুঁজে পাওয়ার দশা। “খোলা আছে” – এই বলে স্কুটিটিকে প্রায় উড়িয়ে নিয়ে পৌঁছলাম দোকানে। আমাকে এত দেরীতে আসতে দেখে দোকানের মালিক কী ব্যাপার জিজ্ঞাসা করলেন, আর আমিও আমার ফ্রাস্ট্রেশনের ভাণ্ডার উপুড় করে দিলাম। তারপরে যথারীতি আমার বরাদ্দ ইরানি চায়ের কাপটা নিয়ে চুমুক দিতে ওনার সাথে আড্ডায় মেতে উঠলাম।
“সবই তো ঠিক আছে, কিন্তু এর মধ্যে টেররিস্ট কোথায়?” আমার সামনে বসা ভদ্রলোক একটু উশখুশ করে উঠলেন।
“আসবে আসবে,” আমি চায়ের কাপে শেষ চুমুকটা দিয়ে পাশে নামিয়ে রেখে বললাম, “একটু অপেক্ষা করুন, টেররিস্টরা কি আর এত সহজে ধরা দেয়?”
ভদ্রলোকের অবস্থা দেখে সান্যালদা হাসি চেপে রেখে বলল, “ওই তো, ও চায়ের দোকানে পৌঁছে গিয়েছে, এবারে টেররিস্টরাও ওর পিছু পিছু চা-বিস্কুট খেতে চলে আসবে।”
“অ্যাঁ?” ভদ্রলোক ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।
আমি পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে একটা সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললাম, “টেররিস্টরা চা-বিস্কুট খায় না বুঝি?”
“না, মানে আসলে –”
“ধৈর্য্য ধরুন একটু,” আমি হাত তুলে বরাভয় দিয়ে হাসিমুখে বললাম, “এই আসল বলে।” বলে সিগারেটে আরেকটা টান দিয়ে আবার বলতে শুরু করলাম।
অন্যান্য দিনের মত সেদিনও চা-বিস্কুট নিয়ে দোকানে বসে দোকানের মালিক এবং অন্যান্য খদ্দেরদের সাথে আড্ডা দিচ্ছি, এমন সময় দোকানের সামনে দু’টো ছেলে এসে বাইক থেকে নামল। বাইকটাকে দোকানের পাশে রেখে আমার সামনের বেঞ্চে এসে বসে দু’টো চায়ের অর্ডার দিল। দু’জনেরই বয়স আন্দাজ তেইশ-চব্বিশের কাছাকাছি, রোগা-লম্বাটে গড়ন, পরণে টি-শার্ট – আপাতদৃষ্টিতে সন্দেহজনক কিছুই নয়। এই রকম ছেলেছোকরা কত খদ্দেরই তো আসে। আমিও বিশেষ পাত্তা না দিয়ে নিজের চায়ে মন দিলাম। কিছুক্ষণ পরে আমার পাশের ভদ্রলোক উঠে চলে গেলেন। আমি ওনাকে বিদায় জানিয়ে নিজের চায়ের কাপটা শেষ করে ওঠবার উপক্রম করছি, এমন সময় আমার কানে ভেসে আসল সামনের দুই মক্কেলের কিছু কথা।
“যা করার আজকেই করতে হবে কিন্তু।” প্রথমজন বলল।
“হ্যাঁ, আমি তো রেডি। কোথায় করবি?” দ্বিতীয়জন জিজ্ঞাসা করল।
“এই তো সামনের ফ্লাইওভারটায়।”
“পুলিশের ঝামেলা হবে না তো রে?”
“আরে না না। এই সময়টায় ওদিকে পুলিশ থাকে না। প্ল্যান করেই এসেছি, চট করে কাজটা সেরেই বেরিয়ে যাব।”
“অত লোকজন থাকবে –”
“সেজন্যেই তো ওখানেই কাজটা সারতে হবে। যত লোক থাকবে, ততই ভাল।” প্রথমজনের মুখে একটা হাসি ফুটে উঠল।
“তা ঠিক, বেশি লোক মানেই তো –”দ্বিতীয়জনের মুখেও একটা রহস্যময় হাসি।
“তাহলে আর বেশি দেরী করিস না, তাড়াতাড়ি চা খেয়ে নিয়ে ওঠ।”
“হ্যাঁ চল, আমার হয়ে গিয়েছে।”
কথাবার্তাটা শুনে আমার মনের মধ্যে একটা তীব্র সন্দেহের দানা বাঁধতে শুরু করল। কিসের কথা বলছে ওরা? কিসের প্ল্যান? কোন কাজ সারার কথা হচ্ছে? কী করবে ফ্লাইওভারটায়? বেশি লোক থাকলে কিসের সুবিধে হবে? ওরা কি কোন নাশকতামূলক প্ল্যান – একগাদা প্রশ্ন মাথায় গিজগিজ করে আসল। তার সাথে সাথেই একটা কথা মনে হল, “টেররিস্ট নয় তো?” ছেলেদু’টোকে আবার আগাপাশতলা ভাল করে দেখলাম, যদি সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়ে। পরমুহূর্তেই মনে হ’ল, টিভিতে, খবরের কাগজে, সোশাল মিডিয়াতে যেসব টেররিস্টদের ছবি দেখি, তাদের বেশির ভাগের বয়স তো এদের মতই। আর টেররিস্টরা কি হাতে মাইক নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় ঘোষণা করে আসে নাকি? তারা তো মিশে থাকে সাধারণ মানুষের মধ্যেই। সিনেমায় দেখা “স্লিপার সেল” কথাটা হঠাৎ মনে পড়ে যেতেই বুকের ভিতরটা ছাঁৎ করে উঠল। এরা সেই স্লিপার সেল নয়ত? নিশ্চয়ই কোন ধ্বংসাত্মক পরিকল্পনা নিয়েই এসেছে। একবার ভাবলাম, পুলিশে ফোন করি। কিন্তু সম্পূর্ণ নিশ্চিত না হয়ে পুলিশকে ডাকতে গেলে উল্টে নিজের বাটাম খাওয়ার সম্ভাবনাটাই বেশি। তাহলে উপায়? উপায় একটাই, এদের বিরূদ্ধে প্রমাণ সংগ্রহ করতে হবে। পারব তো? পারতেই হবে। দেশের সুরক্ষা বলে কথা, ভয় পেলে চলবে না। যা হবে, দেখা যাবে। আমি চুপ করে বেঞ্চে বসে ছেলেদু’টোর ওঠার অপেক্ষা করতে লাগলাম। কয়েক মিনিট পরেই চায়ের দাম মিটিয়ে ওরা দু’জন বাইরে বেরিয়ে বাইকে স্টার্ট দিয়ে এগোল। আমিও আর কালবিলম্ব না করে তৎক্ষণাৎ চায়ের দাম মিটিয়ে বাইরে এসে স্কুটি নিয়ে ওদের পিছনে ধাওয়া করলাম।
গলিপথ পেরিয়ে বাইক এসে পড়ল বড় রাস্তায়, পিছনে কিছুটা দূরত্ব রেখে স্কুটিতে আমি। একটা চাপা উত্তেজনা আর ভয় কাজ করছে মনের ভিতর। কী হবে আজ? বাড়ি ফিরতে পারব তো? এসব ভাবনাকে মন থেকে দূরে সরিয়ে দিয়ে বললাম, “যাই হয়ে যাক, আজ এদের ছাড়ব না।” দেখতে দেখতে বাইকটা রাস্তা থেকে সরে এসে উঠল ফ্লাইওভারের উপরে। আমার উত্তেজনার পারদ বাড়ছে। প্রায় মাঝামাঝি অবধি উঠে বাইকটাকে ফ্লাইওভারের পাঁচিলের পাশে দাঁড় করিয়ে ওরা দু’জনেই নেমে পড়ল বাইক থেকে। আমিও ওদের থেকে কিছুটা দূরত্ব রেখে আমার স্কুটিটাকে দাঁড় করালাম ফ্লাইওভারের উপরে। “দেখি তোরা কী করিস।” ছেলেদু’টো এদিক ওদিক দেখে এগিয়ে গেল পাঁচিলের দিকে। তারপরে হঠাৎই পাঁচিলের উপর ঝুঁকে নীচের দিকে তাকিয়ে চেঁচাতে লাগল প্রথমজন, “আরিব্বাস, কী দেখতে লাগছে রে।”
দ্বিতীয়জনও তার সাথে গলা মেলাল, “সত্যিই তো রে, ব্যাপক লাগছে।”
“কেউ এটা দেখতে পাচ্ছে না?”
“না না, কেউ দেখতে পাচ্ছে না।”
আমার এবারে একটু খটকা লাগল। এরা করছেটা কী? এভাবে চেঁচাচ্ছে কেন? টেররিস্টরা কখনও আক্রমণ করার আগে এভাবে চেঁচায় বলে তো সিনেমায় দেখায়নি। এরা তো দেখছি মুখে ফেনা তুলে চেঁচিয়েই যাচ্ছে, আর মাঝে মাঝে রাস্তার দিকে ঘুরে ঘুরে দেখছে। অদ্ভুত ব্যাপার। আমি ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করতে লাগলাম।
কয়েক মিনিট যেতে না যেতেই ওদের দু’জনকে ঘিরে এক এক করে লোক জমা হতে শুরু করল। তারাও নীচের দিকে কিছু দেখার চেষ্টা করছে। মিনিট দশ-পনের হতেই জায়গাটায় মোটামুটি ভিড় জমে গেল। প্রায় জনাকুড়ি লোক জমা হয়ে গিয়েছে। আমিও হাঁ করে দেখছি রগড়টা। একটু পরেই সেই দু’জন ভিড় ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আসল। আর ওদের হাতে – মোবাইল ফোন। বেরিয়ে এসে ওরা ফোনটা চালু করে যে কাজটা করল, সেটার জন্য আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। ওরা ফোনটা বের করে সেলফি মোডে বলতে শুরু করল, “দেখুন বন্ধুরা, এতজন এখন ফ্লাইওভারে দাঁড়িয়ে নীচের রাস্তার দিকে তাকিয়ে বসে আছে। কিন্তু কেন? চলুন জিজ্ঞেস করে নেওয়া যাক।” এই বলে একজনকে জিজ্ঞেস করাতে সে উত্তর দিল, “তা তো জানি না। দেখলাম সবাই এখানে গাড়ি থামিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তাই আমিও নেমে পড়লাম।” এই উত্তর শুনে তারা আবার ফোনটাকে সেলফি মোডে নিয়ে বলল, “কী বলেছিলাম, হায়দ্রাবাদীদের মত নির্ভেজাল টাইমপাস কেউ করতে পারবে না, সে গলিতেই হোক, বা ফ্লাইওভারের উপর। আজ এই পর্যন্তই। আবার দেখা হবে।”
এই অবধি বলে আমি থামলাম। সিগারেটটা শেষ হয়ে গিয়েছিল। আমি সিগারেটটা নীচে ফেলতেই সামনের ভদ্রলোক অকুণ্ঠ উৎকণ্ঠার সাথে বললেন, “ব্যাপারটা বুঝলাম না।”
“ওরা ছিল রেডিও জকি। হায়দ্রাবাদের জনতার টাইমপাসের উপর ভিডিও বানাচ্ছিল।”
“মানে? তাহলে আপনি যে বললেন আপনি টেররিস্ট ধরতে ছুটেছিলেন?” ভদ্রলোক এবারে একটু হতাশা এবং রাগমিশ্রিত কণ্ঠে প্রশ্নটা করলেন।
“কোথায় বলেছি?” আমি শালপাতার প্লেটটা ডাস্টবিনে ফেলতে ফেলতে বললাম, “আমি তো বলছিলাম যে টেররিস্ট ভেবে দু’জনের পিছু নিয়েছিলাম।”
সান্যালদা বাজারের ব্যাগ নিয়ে উঠতে উঠতে বলল, “তবে চা-সিঙাড়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।”
ভদ্রলোক রাগে লাল হয়ে হাঁ করে বসে রইলেন। উনি এই অ্যাণ্টিক্লাইম্যাক্সের ধাক্কাটা সামলে ওঠার আগেই সান্যালদা আমার হাত ধরে টান দিয়ে কানে কানে বলল, “চল কেটে পড়ি। যা ডোজ দিয়েছ, আজ বাড়ি গিয়ে এনার গ্যাস নিশ্চিত।”
“মানে পাকস্থলীতে বায়ুপথে টেররিস্ট অ্যাটাক বলছ?” বলে আমরা হাসতে হাসতে বাজারের ব্যাগ নিয়ে চম্পট দিলাম।
লেখক পরিচিতি : অভীক সিংহ
গল্পটির লেখক ডঃ অভীক সিংহের জন্ম পশ্চিমবঙ্গে। পেশায় অর্থনীতির অধ্যাপক এবং গবেষক, যুক্ত আছেন লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে, বর্তমান বাসস্থান চীন। তবে ভালবাসাটা আজও লেখালিখি, পেন্সিল স্কেচ, যন্ত্রসংগীত, এবং নিত্যনতুন রান্নাবান্নার সাথেই রয়ে গিয়েছে। প্রথম বই "R.E.CALL: এক Recollian-এর গল্প" প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালে। দাদুর হাত ধরে কবিতা দিয়ে লেখালিখির সূত্রপাত হলেও এখন প্রবন্ধ এবং গল্পতেই মনোনিবেশ করেছেন।