শেষে কেউ নেই

লেখক : অভি সেখ

শেষে কেউ নেই – প্রথম পর্ব

(অন্তিম পর্ব)

একটি আন্তর্জাতিক অনলাইন আর্ট ম্যাগাজিন “The Silent Hue” তার কাজ নিয়ে একটি ফিচার করে। শিরোনাম হয়: “The Artist Who Painted Pain — And Found Peace”। সেখান থেকে শুরু। ইতালি, জার্মানি, জাপান, এমনকি বাংলাদেশের ঢাকার এক আর্ট কালেক্টর তার কাজ কিনে নেয়। তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয় ঢাকায়, মুম্বাইয়ে, তারপর সিঙ্গাপুরের এক শিল্প উৎসবে। অর্ণব, যে একসময় রিক্সায় করে স্কুলে গিয়ে খালি হাতে ফিরত—আজ তার জন্য এয়ারপোর্টে গাড়ি দাঁড়ায়। তার জন্য মঞ্চে তালি পড়ে।
তবু সে বদলায় না। এক আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে দাঁড়িয়ে যখন এক সাংবাদিক জিজ্ঞেস করে, “আপনার প্রেরণা কী?” অর্ণব একটু থেমে শুধু বলে, “যারা শিল্পকে বুঝতে পারেনি, তাদের অবহেলাই আমার প্রেরণা। আর যারা বুঝেছে, তারা আমার শ্রোতা।” সে আজকাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও যায়, তরুণ আর্টিস্টদের সঙ্গে কথা বলে। সে বলে, “তোমার কষ্টটাও শিল্প। লুকিও না।”
একদিন সে একটি পুরনো স্কুলে যায়, যেখানে একসময় তার ছবি ফ্রি তে নিয়ে ব্যবহার করিয়ে নেওয়া হয়েছিল। সেই স্কুলে এখন এক নতুন প্রজন্ম তাকে ফুল দেয়,
প্রিন্সিপাল নিজে এসে বরণ করে। অর্ণব শুধু হাসে। সে ক্ষমা করতে শিখেছে, কিন্তু ভুলে যায়নি।

তার নতুন আর্ট সিরিজের নাম হয় “ছায়ার দেশে আলো”। এটি এমন সব মানুষের মুখ নিয়ে, যারা নিজেদের হারিয়ে ফেলেছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত উঠে দাঁড়িয়েছে। এই সিরিজ লন্ডন আর নিউ ইয়র্কে প্রদর্শিত হয়। দেশে-বিদেশে অর্ণবের নাম ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু তার কাছে সবচেয়ে বড় পুরস্কার একদিন তার ইনবক্সে আসা একটি মেসেজ—“দাদা, আপনার ছবিগুলো দেখে আমি আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্তটা ফিরিয়ে নিয়েছি। আপনাকে কখনও দেখা হয়নি, কিন্তু আপনি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছেন।” সেই মেসেজ পাওয়ার পরের দিন অর্ণব আর কিছু আঁকে না। সে শুধু জানালার পাশে বসে, এক কাপ চা হাতে নিয়ে বাইরে তাকায়। সে জানে, এইটুকুই সার্থকতা। বাকিটা কেবল রঙ আর কাগজ।

জার্মানির বার্লিন শহরে আয়োজিত হয়েছিল এক আন্তর্জাতিক শিল্প সম্মেলন—“Art & Inner Voice: The Healing of Humanity”। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে নির্বাচিত পঁচিশজন শিল্পী, কবি, আর থেরাপিস্ট এসেছিলেন সেখানে। ভারত থেকে একমাত্র প্রতিনিধি অর্ণব। হলঘরের একদিক দিয়ে ঢুকেই সে থমকে দাঁড়ায়। বিপুল মাপের একটি স্ক্রিনে ভেসে উঠছে তার আঁকা ছবিগুলি —ফাটা ঠোঁটের মেয়ে, শূন্য চোখের বৃদ্ধ, বৃষ্টির মাঝে বসে থাকা একটি ভাঙাচোরা লোহার চেয়ার। মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়াতে গিয়ে তার মনে পড়ে যায় সব—স্কুলের প্রোজেক্টে তার ছবি কেটে নেওয়া, এক বন্ধুর মা’র সেই অপমান, সঞ্জয়দার আত্মহত্যা,
সঞ্জয়দার হাসি, সঞ্জয়দার সাদা কাপড় জড়িয়ে শুয়ে থাকা। অবহেলা, চোখের জল, বিনামূল্যে করে দেওয়া কাজ… অর্ণব বলে, “শিল্প মানে ক্যানভাস না, শিল্প মানে হাঁটা—অন্ধকার গলির মধ্যে, আলো না থাকলেও পথ খোঁজার চেষ্টা।” তার বক্তৃতা নীরব করে দেয় সারা ঘর।
এই পর্যন্ত বলার পর হঠাৎ চোখ পড়ে প্রথম সারিতে। তার মুখ শুকিয়ে যায়। সে চিৎকার করতে চায়, কিন্তু তার গলা দিয়ে কোন শব্দ বের হয় না। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে একদল মানুষ। পুরনো, চেনা মুখ। একজন স্কুলের সেই শিক্ষক, যিনি তাকে খুব মেরেছিলেন স্কুলের বেঞ্চে পেন দিয়ে ছবি আঁকার জন্য। একজন কবি, যে তার ছবি ফ্রি তে নিয়ে বইয়ের প্রচ্ছদে ছাপিয়েছিল, কিন্তু পরে নামও দেয়নি। একজন স্থানীয় রাজনীতিক, যে অর্ণব দারুণ আঁকে বলে নিজের দেওয়াল-পোষ্টারে তার আঁকা ব্যবহার করত, বিনা পারিশ্রমিকে। একজন পুজো কমিটির কাকু, যে প্রত্যেক বছর বিনামূল্যে আলপনা এবং থিম করিয়ে নিত। তারা হাসছে, হালকা কৌতুক মিশিয়ে। মনে হচ্ছে যেন তারা মজা পাচ্ছে এই দৃশ্য দেখে—অর্ণব এখন এক আন্তর্জাতিক শিল্পী, কিন্তু তারা এখনও নিজস্ব আত্মতৃপ্তির খাঁচায় আটকে।আর সবার মাঝে, দাঁড়িয়ে আছে একজন—সঞ্জয়দা। লম্বা চুল নেই আর, চোখে আগের মত সেই পাগলপ্রায় দীপ্তি নেই। শুধু একরাশ চুপচাপ দৃষ্টি। অর্ণব থেমে যায় এক মুহূর্তের জন্য। সঞ্জয়দা যেন তাকে দেখে না—দেখছে অতীতকে। হয়ত তার চোখে তখন আন্তর্জাতিক শিল্পী অর্ণব নেই, আছে সেই ছেলেটা, যে তাকে একদিন “দাদা” বলে আঁকার খাতা দেখাত।
সবাই হাসছে, কিন্তু সঞ্জয়দা দাঁড়িয়ে থাকে, শান্তভাবে। তার চোখে যেন এক অদ্ভুত অনুশোচনা। হয়ত সে বোঝে, আজকের অর্ণব হয়ে উঠেছে অনেক না-পাওয়ার মাটি থেকে—সেই মাটিতে, যেখানে একসময় সঞ্জয়দাও দাঁড়িয়েছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভেঙে পড়েছিলেন। অর্ণব আর একবার মাইক ধরে বলে, “শিল্পীর আত্মা ভাঙে তখনই, যখন তার যন্ত্রণাকে কেউ খোঁজে না, শুধু তার কাজকে ব্যবহার করে। সঞ্জয়দা সেই যন্ত্রণাকে সহ্য করতে পারেনি। আমি পেরেছি, শুধু এই কারণেই আজ দাঁড়িয়ে আছি।”

তখনই খুব জোরে মেঘ ডাকল, হয়ত বাজ পড়ল কোথাও খুব কাছে। অর্ণব চোখ খুলে দেখে, সে তার ডেস্কে ঘুমিয়ে পড়েছিল। কখন, কিভাবে ঘুমিয়ে পড়েছিল, তার কোন ধারণাই নেই। সামনে তাকিয়ে দেখে সাদা ক্যানভাসে একটাও রঙের আঁচড় নেই। গাঢ় অন্ধকারে যেন মনের গভীরে ছায়ার মত কিছু ছিল, যা তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। সে উঠে বসে, মাথায় হাত দিয়ে নিজেকে সস্তা অনুভূতিতে ডুবিয়ে দেয়। এটা কী হচ্ছে তার? অর্ণব স্বপ্ন দেখছিল আন্তর্জাতিক সম্মান, খ্যাতি, প্রতিষ্ঠা—আসলে সে তার ডেস্কে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিল। এক মুহূর্তের জন্য সে নিজেকে ছিঁড়ে ফেলতে চায়, কারণ সে জানে না, এটাই কি তার সব কিছু? শুধু সাজানো অস্থায়ী সাফল্য? সব কিছু হারানোর ভয় কি তাকে শেষ পর্যন্ত এখানে নিয়ে এসেছে? বিরক্তির শ্বাস নিয়ে ডেস্কের কাগজগুলোর দিকে তাকায়। সেখানে তার পুরনো ছবি, একটি গ্যালারি প্রদর্শনী, যেখানে সে প্রথমবার তার ক্যানভাসগুলো উপস্থাপন করেছিল। অনেক প্রশংসা পেয়েছিল, তবে ভিতরে কোথাও একটা খালি জায়গা ছিল। আজও আছে। সে নিজেও জানে, সেসব সাফল্য তার জন্য কোনও অর্থ রাখে না। এই শূন্যতা তার পিছনে, হঠাৎ করেই ফিরে আসে, নিঃশব্দে। তার মনের অন্ধকারে শোনা যায় এক ভয়ংকর শব্দ—“তুমি কি জানো, যা তুমি দেখে এসেছ, সব কিছুই আসলে শুধুই এক স্বপ্ন?” সে চোখ বন্ধ করে নেয়, যেন কোন অদৃশ্য ভয় তাকে আঁকড়ে ধরছে। সবার সামনে সে যা প্রদর্শন করেছিল, তার কোনটাই আসল ছিল না। সে মানুষের সংবর্ধনা, প্রশংসা, ভালবাসা—সব ছিল মিথ্যা। শুধু এক শীতল খালি প্রাসাদ, যে প্রাসাদে সে কখনও প্রবেশ করতে পারেনি। তার বুকের মধ্যে যে চাপ অনুভূত হচ্ছে, তা কখনও অনুভব করেনি। একটি ভয়ংকর সাইলেন্স, যা সমস্ত অর্জনকে এক ঝটকায় মুছে দিচ্ছে। এই অনুভূতি, যেন পৃথিবীটা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, আর সে একা দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। তবে সে জানে না, এটা কোন এক দৃশ্য নয়। এটা তার মনের অবস্থা। বিষাদ, হতাশা, আত্মবিশ্বাসের অভাব—এগুলো তার সঙ্গী হয়ে গিয়েছে।

দেখতে দেখতে কয়েকটি ঘণ্টা চলে যায়। অর্ণব একরাশ হতাশায় নিমজ্জিত, মাটিতে হাত রেখে বসে থাকে। তার সমস্ত সাফল্য, তার সংগ্রাম—সব ছিল কি? এটাই কি তার সাফল্যের মূল্য? একটি বসন্তের মত উড়ে যাওয়া স্বপ্ন? আবদ্ধ সত্তা, নিজের প্রতি ঘৃণা, তার কল্পনাশক্তি—সব কিছু একে একে খুলে দেয় তার মন থেকে।
সে ভাবতে থাকে, একজন শিল্পী যদি সত্যিই স্বাধীন হয়, তবে কেন তাকে পৃথিবীর সামনে প্রমাণ দিতে হয়? কেন তাকে নিজের কষ্টগুলো ফেলে নিজের ছবির মধ্যে ভরিয়ে রাখতে হয়? তার সাফল্যের স্তম্ভগুলোর সব কিছুই যেন এক মুহূর্তে চূর্ণ হয়ে গেল। সে এখন শুধু এক নিঃশব্দ পৃথিবী, যার চারপাশে কোনও অনুভূতি নেই।
শুধু একটা ফাঁকা ক্যানভাস—যা তার সমস্ত জীবনের প্রতিফলন ছিল, কিন্তু এখন তা কিছুই নেই। এটা কি তার শেষ? কীভাবে আবার শুরু করবে সে? তবে, কিছু সময়ের জন্য, তার চোখ বুজে আসে, যেন এই অন্ধকারে সে নিজের রাস্তাটা খুঁজে পাবে, অথবা, হয়ত সে আজীবন নিঃশব্দে হারিয়ে যাবে এই অন্ধকারে।

রাত আরো গভীর। অর্ণব নিজের স্টুডিওর জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। সামনে কুয়াশাচ্ছন্ন রাস্তা, আলো-আঁধারির খেলা। হঠাৎ তার চোখ চলে যায় সেই পুরোনো ক্যানভাসটার দিকে—যেখানে সে কোনওদিন কাজ শেষ করতে পারেনি। একটা মুখ আঁকা ছিল—আধা-আঁকা, চোখদু’টো ফাঁকা, আবেগহীন। হয়ত এটাই তার প্রতিচ্ছবি। এই কয়েক বছরে অর্ণব যা পেয়েছে, সেটা কাগজকলমে সাফল্য, কিন্তু মনের ভিতরে যে শূন্যতা জমে আছে, সেটার হিসাব কেউ রাখে না। সে চেয়েছিল নিজেকে প্রমাণ করতে, সমাজের চোখে একটা ‘নাম’ হতে। কিন্তু সেই নাম যখন আসে, তখন অর্ণব বুঝতে পারে—এই নামের পেছনে যে মূল্য দিতে হয়, সে প্রস্তুত ছিল না তা দিতে। বন্ধুদের বিশ্বাসঘাতকতা, আত্মীয়দের চাহিদা, সমাজের অবহেলা—সব মিলিয়ে সে যেন একটি পাথরের নিচে চেপে গিয়েছে। সঞ্জয়দার কথা বারবার মনে পড়ে। মনে পড়ে কার্ট কোবেন, চেস্টার বেনিংটন এর কথা। গম ক্ষেতে দাঁড়িয়ে ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের নিজেকে গুলি করার কথা। হয়ত তারাও এই শূন্যতার গহ্বরে ডুবে গিয়েছিলেন, আর কেউ তাদের টানেনি উপরে। আজ অর্ণব নিজেও জানে না, সে কোথায় দাঁড়িয়ে। সব কিছু যেন খুব পরিধির বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে—নিজের জীবন, নিজের সংগ্রাম, নিজের শিল্প। তার টেবিলে রাখা আছে একটা চিঠি। অর্ধেক লেখা, অর্ধেক ফাঁকা। শিরোনাম “শেষে কেউ নেই”। সে জানে না চিঠিটা শেষ করতে পারবে কি না। জানে না, সেটা নিজের কাছে রেখে দেবে, না আগুনে পুড়িয়ে ফেলবে। জানে না, আগামীকাল সূর্য ওঠার সময় সে বেঁচে থাকবে কি না। কেননা এই মুহূর্তে তার মনে হচ্ছে, কিছুই তেমন জরুরি না।

একটা মোবাইল বেজে ওঠে। কোন নাম নেই, শুধু লেখা—“তুই কেমন আছিস, অর্ণব?” সে ফোনটা হাতে নেয়। এক মুহূর্তের জন্য বুকটা কেঁপে ওঠে। সে জানে না, উত্তর দেবে কি না। জানালার কাচে তার প্রতিচ্ছবি—চোখ ফাঁকা, ক্লান্ত, কিন্তু হঠাৎ যেন একটু নড়েচড়ে ওঠে। আলোর মাঝে ছায়া, ছায়ার মাঝে আলো। বাইরে হালকা বৃষ্টি পড়ছে। অর্ণব ক্যানভাসটার দিকে ফিরে তাকায়। তুলিটা আবার হাতে নেয়।


লেখক পরিচিতি : অভি সেখ
সঙ্গীতচর্চা করতে ভালবাসেন। গান লেখা, তার সুর দেওয়া, এবং নিজে গাওয়া এর মধ্যেই মনের তৃপ্তি খুঁজে পান। এর সাথে রং-তুলির সাথে নির্জীব কাগজের প্রেক্ষাপটে প্রাণসঞ্চার করার মধ্যেও আনন্দ খুঁজে পান।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।