চতুর্থ তরঙ্গ

লেখক : অভি সেখ

চতুর্থ তরঙ্গ – প্রথম পর্ব

(দ্বিতীয় পর্ব)

করিডর এখন নিঃস্তব্ধ। মাত্র কয়েক মুহূর্ত আগেও এখানে ছিল গোলাগুলি, চিৎকার, মৃত্যুর আতঙ্ক। কিন্তু এখন—শুধু রক্তের গন্ধ আর মৃতদেহের স্তূপ পড়ে আছে। জন্তুটি তাদের হত্যা করার পর, আর এক মুহূর্তও সময় নষ্ট না করে ছায়ার মত করিডর পেরিয়ে কোথাও অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। অরিন্দম ধীরে ধীরে ভেন্টের ভিতর থেকে উঁকি দিল। চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে ছিন্নভিন্ন লাশ—গার্ডদের কেউ মাটিতে চেপ্টে গিয়েছে, কারও শরীরের কিছু অংশ অদৃশ্য, হয়ত ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। দেওয়ালজুড়ে লাল রক্তের ছোপ, মেঝেতে রক্তের গাঢ় দাগ—কিছু জায়গায় পা পিছলে যেতে পারে। বাতাসে এখনও পচা মাংসের গন্ধ, গরম বারুদের গন্ধ, আর এক ধরণের অদ্ভুত ধাতব গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, করিডরের বাতাস অস্বাভাবিক ভারী লাগছে, যেন এখানকার মৃত্যুর ভয় এখনও বাতাসে রয়ে গিয়েছে।

অরিন্দম কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। কোন শব্দ নেই। তবে কি সে একা? সে ভেন্ট থেকে আস্তে আস্তে বেরিয়ে এলো, তার জুতো রক্তের ওপর পড়তেই একটা চপচপ শব্দ হ’ল। তারপরও কোন প্রতিক্রিয়া নেই। কিন্তু…তার মনে হ’ল, কেউ বা কিছু ওকে দেখছে। অরিন্দম যত দ্রুত সম্ভব করিডর পেরিয়ে বেরিয়ে যেতে চাইল,
কিন্তু…
বিস্ফোরণের ধ্বংসস্তূপ! সামনের পথ পুরোপুরি ব্লক হয়ে গিয়েছে—ধ্বংসস্তূপের নিচে পড়ে আছে অগ্নিদগ্ধ লাশ, বিদ্যুতের তার থেকে স্ফুলিঙ্গ ঝরছে, আর কোথাও কোথাও এখনও আগুন জ্বলছে। এদিকে বেশি দেরি করলে হয়ত নতুন বিপদ আসবে। অরিন্দম দ্রুত চারপাশে দেখল। একটা মাত্র বিকল্প পথ খোলা আছে—একটি সংকীর্ণ সার্ভিস করিডর, যা হয়ত হাসপাতালের অন্য কোন উইংয়ে নিয়ে যাবে। তার হাতে সময় নেই। সে সেই পথ ধরেই ছুটতে শুরু করল। এই করিডরটা আগের চেয়ে অনেক অন্ধকার আর সরু। কোথাও কোথাও দেওয়ালে পুরনো রক্তের দাগ শুকিয়ে আছে, মনে হয় এখানে আগে কোন ভয়ঙ্কর কিছু ঘটেছে। বাতাস ভারী, যেন অক্সিজেন কমে আসছে। চারপাশে শুধু তারের ঝুল, পুরনো ফাইল, আর ভাঙা হাসপাতালের সরঞ্জাম। হঠাৎ করেই…

ঠক ঠক ঠক…
অরিন্দম থমকে গেল। কেউ হাঁটছে? না, একজন নয়… একাধিক! সে দ্রুত পাশের একটা দরজার দিকে তাকাল—পুরনো স্টোররুম। দরজাটা আধখোলা ছিল, আর ভিতরে এক ঝলক অন্ধকার। অরিন্দম দ্রুত করিডর পেরিয়ে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই…
“এই যে! তুমি… ওখানে…”
অরিন্দম চমকে পিছনে তাকাল। একজন বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে আছে করিডরের ছায়ার মধ্যে। তার পরনে নোংরা হাসপাতালের পোশাক, লম্বা সাদা চুল ও দাড়ি জট পাকিয়ে গিয়েছে। চোখের নিচে কালি, কিন্তু তার দৃষ্টিতে ছিল এক অদ্ভুত তীক্ষ্ণতা।
“তুমি নতুন, তাই না?” বৃদ্ধ নিচু স্বরে বলল।
অরিন্দম কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল, তারপর বলল, “আপনি কে?”
বৃদ্ধ ধীর পায়ে এগিয়ে এল। “আমি? আমি এখানে অনেক বছর ধরে আছি।”
অরিন্দম বুঝতে পারল, এই লোক হয়ত হাসপাতালের কোন পুরনো রোগী বা স্টাফ। কিন্তু তার ভিতর কেমন একটা অদ্ভুত শীতলতা ছিল।
“তুমি পালানোর রাস্তা খুঁজছ, তাই না?” বৃদ্ধ মৃদু হেসে বলল।
অরিন্দম সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাল, “আপনি কীভাবে জানেন?”
বৃদ্ধ তার দিকে ঝুঁকে এসে ফিসফিস করে বলল, “এখানে সবাই পালাতে চায়, কিন্তু সবাই পারে না।”
অরিন্দম শ্বাস নিল, চারপাশে তাকাল। “আপনি কি সাহায্য করতে পারবেন?”
বৃদ্ধ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল, তারপর বলল, “হয়ত… যদি তুমি বেঁচে থাকার মত সাহস দেখাতে পার।”
“আমি কি আপনাকে বিশ্বাস করতে পারি?” অরিন্দম চাপা গলায় বলল।
বৃদ্ধ হাসল, কিন্তু সেই হাসির মধ্যে এক রহস্যময়তা ছিল। অরিন্দম এক মুহূর্ত ভাবল। কে এই বৃদ্ধ? কেন সে সাহায্য করতে চাইছে? কিন্তু এখন তার হাতে বিকল্প কিছুই নেই। অন্ধকার করিডর, লাশের স্তূপ—এমন অবস্থায় কেউ যদি সাহায্যের হাত বাড়ায়, সেটা ধরে নেওয়াই ভাল।
“ঠিক আছে। কোথায় যেতে হবে?”
বৃদ্ধ তার হাত দিয়ে ইশারা করল, “আমার সঙ্গে এসো, চুপচাপ। ওরা শুনতে পেলে বাঁচবে না তুমি। ওই যে জন্তুটা দেখলে, ওটা একটা মিউট্যান্ট। এরকম আরও অজস্র মিউট্যান্ট এখন পুরো হাসপাতাল জুড়ে ঘুরছে।”
অরিন্দম সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাল, “মিউট্যান্ট?”
বৃদ্ধ আর কিছু বলল না, শুধু সামনে হাঁটতে শুরু করল।

করিডরটা ছিল সরু, যেন হাসপাতালের পুরনো কোন অংশ, যা কেউ বহু বছর ব্যবহার করেনি। পায়ে ধুলো জমেছে, দেওয়ালে পুরনো ছোপ ছোপ রক্তের দাগ, আর বাতাসে এক ধরণের পচা গন্ধ। হঠাৎ…
ঠক ঠক… ঠক ঠক…
পায়ের আওয়াজ! অরিন্দম থমকে গেল। বৃদ্ধ ফিসফিস করে বলল, “চুপ! একদম শব্দ করো না।”
তারা দেওয়ালের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে গেল। করিডরের ওপাশ থেকে আসছে অদ্ভুত এক ছায়া… অরিন্দম নিঃশ্বাস আটকে রাখল। একটি ভয়ঙ্কর জন্তু ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছে করিডরের ঠিক অপর প্রান্ত দিয়ে। তার লম্বা, অস্বাভাবিক হাত মাটিতে টেনে টেনে চলেছে। তার শরীর কাটা-ছেঁড়া, পাঁজরের কিছু অংশ বাইরে বেরিয়ে আছে, আর তার হাঁটাচলা যেন কোন মৃতদেহের মত টলমল। সে থেমে গেল। ঘাড় কাত করে করিডরের দিকে তাকাল। বৃদ্ধ অরিন্দমের দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় বুঝিয়ে দিল—একদম নিঃশব্দ থাকতে হবে। অরিন্দম অনুভব করল, তার হৃদস্পন্দন এত জোরে হচ্ছে, যে সেটা শুনে ফেলবে। কয়েক সেকেণ্ড পরে জন্তুটা ধীরে ধীরে অন্যদিকে চলে গেল।
বৃদ্ধ একটা লম্বা শ্বাস নিল, তারপর ফিসফিস করে বলল, “ওরা আমাদের খুঁজছে। তাই আমাদের দ্রুত বের হতে হবে!”
অরিন্দম ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল, “আপনি কি জানেন এখান থেকে বের হওয়ার রাস্তা?”
বৃদ্ধ আবার সেই রহস্যময় হাসি দিল। “আমি জানি… কিন্তু সেই পথে গেলেও তুমি কি সত্যি বাঁচবে?”
অরিন্দম বুঝতে পারল, এই বৃদ্ধ হয়ত শুধু একজন সাহায্যকারী নয়, তার নিজেরও কিছু গোপন উদ্দেশ্য আছে। অরিন্দমের মন বলছিল—এই বৃদ্ধ রহস্যময়, তার উপর ভরসা করা ঠিক হবে কি না, সে জানে না। কিন্তু এখন তার সামনে দুটি পথ—এক, বৃদ্ধকে অনুসরণ করা, আর দুই, নিজের মত পালানোর রাস্তা খোঁজা। অরিন্দম কিছুক্ষণ বৃদ্ধের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকল।
“আপনি এতদিন এখানে কীভাবে বেঁচে আছেন?”
বৃদ্ধ ম্লান হেসে বলল, “বেঁচে থাকা মানে শুধু দৌড়নো নয়, নিজেকে লুকিয়ে রাখতেও হয়, কখনও কখনও…” সে থেমে গেল, “…নিজেকেই হারিয়ে ফেলতে হয়।”
অরিন্দম বুঝতে পারল, এই লোক এখানে অনেকদিন ধরে বন্দী। “আমরা কি একসাথে বেরোতে পারি না?”
বৃদ্ধ ধীরে মাথা নাড়ল, “তোমার পথ আলাদা। আমার পথ আলাদা।”
হঠাৎ একটা বিকট গর্জন হাসপাতালের অন্য দিক থেকে ভেসে এল! বৃদ্ধ তাড়াতাড়ি করিডরের বাঁ দিকে ইশারা করল, “ওদিক দিয়ে যাও! ওই পথে গেলে হয়ত বেঁচে যাবে!”
অরিন্দম এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল, তারপর দ্রুত হাঁটতে শুরু করল। শেষবারের মত পেছনে তাকাতেই দেখল—বৃদ্ধ সেই অন্ধকার করিডরের ছায়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে… আর অরিন্দম একা, সম্পূর্ণ একা এই মৃত্যুফাঁদ থেকে বেরোনোর চেষ্টা করছে। অরিন্দম দ্রুত করিডর ধরে এগিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু এটা যেন শেষই হচ্ছে না। পথ ঘুরে ঘুরে যাচ্ছে, একটা করিডর শেষ হতে না হতেই আরেকটা শুরু হচ্ছে। হাসপাতালটা যেন একটা জীবন্ত গোলকধাঁধায় পরিণত হয়েছে। চারপাশের দরজাগুলো ভাঙা, ভিতরে উঁকি দিতেই দেখা যায়—পরিত্যক্ত বেড, ছিন্নবিচ্ছিন্ন পর্দা, কখনও শুকনো রক্ত, কখনও শুধু ফাঁকা অন্ধকার। শ্বাস ভারী হয়ে আসছে, বুকের মধ্যে চাপা একটা ভয় কাজ করছে। এই জায়গাটা স্বাভাবিক নয়।

একসময় অরিন্দম টের পেল সে কোথায় আছে, সেটা আর বুঝতে পারছে না। হাসপাতালের কোন ম্যাপ এখানে নেই, চারপাশের দেওয়ালগুলো সব একইরকম, সে একটা অসীম লুপের ভিতরে আটকে গিয়েছে কিনা, সেটাও বোঝা যাচ্ছে না। তার মাথা ঝিমঝিম করছে। ঠিক তখনই সে টের পেল মেঝের নিচ থেকে একটা ভিজে শব্দ আসছে।
চপচপ… চপচপ…
সে আরও একটু এগোতেই বুঝতে পারল—মেঝে ভিজে! এবং হঠাৎ…
সে পা বাড়াতেই হাঁটুর নিচ পর্যন্ত ডুবে গেল! অন্ধকার করিডর শেষ হয়ে গিয়েছে, এবং সে এখন একটা বিশাল জলের গহ্বরে দাঁড়িয়ে। পুরো হাসপাতালের নিচতলার এই অংশটা জলে ডুবে গিয়েছে। কিন্তু, এই জল স্বাভাবিক নয়। এটার রং কালচে সবুজ, এর ভিতর থেকে মাঝে মাঝে বুদবুদ উঠছে, আর কোথাও কোথাও লালচে দাগ—যেন রক্তের সঙ্গে মিশে গিয়েছে। এখানে একটা বিশাল পাইপলাইন ভেঙে গিয়েছে বলে মনে হচ্ছে, কিন্তু এই জল কোথা থেকে এসেছে? আর সব চেয়ে ভয়ের ব্যাপার, জলের নিচে কিছু একটা আছে। অরিন্দম দেখল, একটা বিশাল ছায়া ধীরে ধীরে নড়ছে। সে জানে না এটা কী। কিন্তু সে নিশ্চিত, এটা কিছু একটা, এবং ওর উপস্থিতি টের পেয়েছে! অরিন্দম ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগল, জলের ভিতর পা ফেললেই একটা অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা অনুভূতি হচ্ছিল। এই জল স্বাভাবিক নয়, যেন তার নিচে কিছু একটা লুকিয়ে আছে। চারিদিক এতটাই অন্ধকার, যে নিজের হাত পর্যন্ত ভালভাবে দেখা যাচ্ছে না। শুধু মাঝেমধ্যে জলের ওপরে ছাদের ভাঙা পাইপ থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। অরিন্দম জানে, সে যদি এখানে বেশি শব্দ করে, তাহলে বিপদ ডেকে আনবে। তাই সে ধীরে, নিঃশব্দে হাঁটতে থাকল। তার পায়ের নিচে কখনও নরম কাদা, কখনও শক্ত কিছু লাগছে—”হয়ত ভাঙা ইট-পাথর।” কিন্তু পরের মুহূর্তেই কিছু একটা তার পায়ের ঠিক নিচে নড়ল! শিরদাঁড়া দিয়ে ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল! সে সাথে সাথে থেমে গেল।
“জলের নিচে কিছু একটা আছে!”
তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে, চারপাশ শুনশান নিঃস্তব্ধ। শুধু সেই চাপা শব্দ…চপচপ… কিছু একটা জলের নিচে আস্তে আস্তে নড়ছে।
অরিন্দম আর নড়ল না। সে ধীর শ্বাস নিয়ে স্থির দাঁড়িয়ে থাকল, যেন নিজেকে জলের একটা অংশ করে নিল। তার ঠিক সামনেই একটু দূরে বেশ কয়েকটা সিঁড়ি উঠে গিয়েছে উপরের দিকে, যেখানে একটা পুরনো ধাতব দরজা।
“হয়ত এটাই বেরনোর রাস্তা!”
কিন্তু সিঁড়ির ঠিক আগেই একটা মৃতদেহ জলের মধ্যে আধা ডুবে আছে! তার শরীর ফুলে গিয়েছে, মুখটা বিকৃত, আর কুৎসিত এক গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। অরিন্দম জানে, এই দেহটা নড়বে না। কিন্তু জলের নিচে যা আছে, সেটা যে কোন মুহূর্তে আক্রমণ করতে পারে! তাকে একেবারে নিঃশব্দে এই জল পেরোতে হবে। শ্বাস আটকে রেখে, সে ধীরে ধীরে এগোল, নিঃশব্দে এগিয়ে চলল। জল ঠাণ্ডা, ভেজা পোশাক তার শরীরের সাথে লেপ্টে গিয়েছে। অন্ধকার এতটাই ঘন, যে সামনের রাস্তা বোঝাই যাচ্ছে না। তার কানে শুধু শুনতে পাচ্ছে—চপচপ…ফোঁট ফোঁট… জলের উপর কিছুর অদ্ভুত নাড়াচাড়া। এই জায়গাটা যেন একটা বিশাল ধ্বংসস্তূপ, যেখানে স্রেফ জল আর মৃত্যু আটকে আছে। চারপাশে দেওয়াল ছুঁয়ে চলার চেষ্টা করল অরিন্দম, কিন্তু দেওয়াল এতটাই ভেজা আর এত শ্যাওলা জমে আছে, যে হাত পিছলে যাচ্ছে। কোথাও কোথাও জল আরও গভীর হয়ে যাচ্ছে।
“যদি কোমর পর্যন্ত ডুবে যাই, তাহলে সমস্যা হবে!”
সে জানে না এই জলের নিচে আসলে কী আছে। বাঁ দিকে যেখানে দেওয়ালটা ধসে পড়েছে, কিন্তু খানিকটা ফাঁক দিয়ে যাওয়া যেতে পারে। এমন সময় জলের নিচ থেকে কিছু একটা আচমকা তার পা ধরে ফেলল!
চপাৎ!
শরীর হিম হয়ে গেল তার! সে পায়ের নিচে তীব্র টান অনুভব করল, যেন কিছু একটা তাকে জলের গভীরে টেনে নিতে চাইছে! সে শক্ত করে ব্যালেন্স ধরে রাখল, হাত বাড়িয়ে পাশে থাকা ভাঙা পাইপটা চেপে ধরল। কিন্তু সেই মুহূর্তে…
গা ঘিনঘিনে, বিকৃত চেহারার কিছু একটা জলের ভিতরে নড়ছে। জলের ওপর ফেনা উঠছে, আর… লালচে রঙ মিশে যাচ্ছে! হঠাৎ একটা পচা, বিকৃত হাত উঠে এল, তারপর একটা বিকৃত মাথা। সাদা, ফুলে ওঠা চোখ, গলিত চামড়া, আর পচা দাঁত বের করা মুখ!
“শি-ই-ই-ই-ই-গ!”
একটা বিকট আওয়াজ তুলে জলের মিউট্যান্ট এক ঝটকায় উঠে এল! তার পেছনেও আরও কয়েকটা ছায়া নড়ছে! অরিন্দম বুঝতে পারল, এই জল শুধু ময়লা নয়, এই জল মৃত্যু নিয়ে এসেছে! সে দ্রুত পাইপটা ছেড়ে পেছনে সরে গেল, কিন্তু জলের আরেকটা হাত তার জামা চেপে ধরল! অরিন্দম এক ধাক্কায় ওটা সরানোর চেষ্টা করল, কিন্তু এই মিউট্যান্টদের শক্তি অস্বাভাবিক! জলের নিচ থেকে আরও দেহ উঠে আসছে, তারা সবাই বিকৃত, তারা সবাই ভয়ঙ্কর!
“নাহ! এখানে বেশি দেরি করলে বাঁচব না!”
বাঁ দিকের সংকীর্ণ ফাঁক দিয়ে যাওয়া অসম্ভব, কারণ সেখান থেকে বেরনোর আগেই এরা তাকে ধরে ফেলবে! বাকি থাকে ডান দিকের করিডর, কিন্তু সেটা নিচের দিকে যাচ্ছে! অরিন্দম নিজের শরীরের সব শক্তি দিয়ে এক ঝটকায় জলের মিউট্যান্টদের হাত সরিয়ে ফেলল, আর প্রাণপণে দৌড় দিল ডান দিকের করিডরের দিকে! অরিন্দম জলের ছপছপ শব্দ তুলে দৌড় দিল করিডরের দিকে, কিন্তু এই জল তাকে ধীর করে দিচ্ছে। তার পিছনে জলের বিকৃত দেহগুলো হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসছে, তাদের হাঁটু-পঁচা শরীর থেকে মাংস ঝুলে পড়ছে।
“গা-আ-আ-আ-র!”
তারা গর্জন করছে, তাদের গলা দিয়ে অস্বাভাবিক, বিকৃত, গলিত আওয়াজ বের হচ্ছে! অরিন্দম কাঁপতে থাকা হাতে পকেট থেকে তার টর্চ বের করল। সে দ্রুত ফ্ল্যাশ অন করতেই দেখতে পেল তার সামনের করিডরটা সিঁড়ির মত নিচের দিকে নেমে গিয়েছে, আর সেই সিঁড়ির নিচে—জল আরও গভীর! এখানে ঢুকলে কোমর অবধি ডুবে যাবে! অরিন্দম পিছন ফিরে দেখল, মিউট্যান্টরা খুব কাছেই চলে এসেছে! এই জলই তাদের এলাকা, তারা এখানে স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে দ্রুত চলে! তাই আর কোন উপায় নেই। সে এক ঝাঁপ দিল নিচের জলের গভীরে! জলের নিচে এক মুহূর্তের জন্য সব নিঃস্তব্ধ হয়ে গেল। কেবল তার শ্বাস আটকে আসছে, চারপাশ ঘুটঘুটে অন্ধকার, আর কোথাও যেন একটা অদ্ভুত গুমোট শব্দ হচ্ছে। সে হাত বাড়িয়ে কিছু ধরার চেষ্টা করল, কিন্তু কিছুই পাওয়া গেল না। সে বুঝতে পারছে না, এই জলের নিচে সে একা আছে, নাকি অন্য কিছু তাকে দেখছে? তার শ্বাস নেওয়ার সময় ফেনা উঠতে লাগল, তখনই সে টের পেল—জলের গভীর থেকে একটা বিশাল ছায়া উঠে আসছে! এটা আগের মিউট্যান্টদের চেয়ে বড়, অনেক বড়…
আর হঠাৎ!
অরিন্দমের চোখের সামনে জলের নিচে লাল, জ্বলন্ত চোখ খুলে গেল! তার চারপাশের জল যেন হঠাৎ আরও ঠাণ্ডা হয়ে গেল, যেন ভয় নিজেই তাকে আঁকড়ে ধরছে। তার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। এখানে বেশি সময় থাকলে সে নিজেই ডুবে যাবে, বা হয়ত… এদের খাবারে পরিণত হবে! জলের গভীর থেকে ছায়াটা ধীরে ধীরে নড়ছে। বড়… বিশাল… অস্বাভাবিক… তার আগে দেখা মিউট্যান্টদের চেয়েও অনেক ভয়ঙ্কর কিছু! অরিন্দম নিজের শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে জলের নিচে দ্রুত সাঁতার কাটতে লাগল, উপরের দিকে উঠতে হবে! কিন্তু সেই মুহূর্তে একটা বিশাল হাত নিচে তাকে চেপে ধরল!
বুম!
সে ধাক্কা খেল, চারপাশে ছোট ছোট বুদবুদ উঠল, আর সবকিছু ঘোলাটে হয়ে গেল! শরীরটা যেন পাথরের মত ভারী হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু হাল ছাড়ার সুযোগ নেই! সে দ্রুত কোমরের কাছ থেকে ছোট্ট ছুরি বের করল, তারপর একটা বিকট গর্জনের সাথে সেই বিশাল মিউট্যান্ট তাকে এক ধাক্কায় দেওয়ালে ছুঁড়ে মারল! অরিন্দমের শরীর ধাক্কার চোটে কেঁপে উঠল, কিন্তু সে সময় নষ্ট না করে হাতের ছুরিটা দিয়ে সেই বিকৃত চামড়ার দেহে একটা প্রবল আঘাত করল! কালচে লাল রক্ত ছড়িয়ে গেল জলে! মিউট্যান্টটা এক মুহূর্তের জন্য কেঁপে উঠল, সেই সুযোগে অরিন্দম নিজেকে ছাড়িয়ে নিল! সে দ্রুত উপরের দিকে উঠতে লাগল, তার ফুসফুসে আর অক্সিজেন নেই!
“আর একটু দেরি হ’লে ডুবে যাব!”
তার হাত কিছু একটা ধরল—একটা ধাতব পাইপ! সে এক ঝটকায় নিজেকে জলের ওপরে টেনে তুলল! গভীর শ্বাস! অরিন্দম হাঁপাতে লাগল, চারপাশে ছড়িয়ে থাকা কালো, পচা জল থেকে মিউট্যান্টরা উঠে আসছে! এখনই পালাতে হবে! সে দ্রুত আশেপাশে তাকাল—একটা জরুরি বেরনোর দরজা আগের দরজাটার মতই বেশ কয়েক ধাপ উপরে! কিন্তু সেটা বন্ধ! অরিন্দম দেরি না করে একটা ভাঙা লোহার রড হাতে তুলে নিল এবং এক শক্তিশালী আঘাত করল দরজায়। পিছনে মিউট্যান্টরা দৌড়চ্ছে! আরও একটা আঘাত—
“ধড়াম!”
দরজাটা হালকা ফাঁকা হল…আরেকটা আঘাত—
“বুম!”
দরজা ভেঙে খুলে গেল! অরিন্দম এক ঝাঁপ দিয়ে দরজার ভিতরে ঢুকে গেল, সঙ্গে সঙ্গেই দরজাটা টেনে লাগিয়ে দিল! মিউট্যান্টরা দরজার ওপাশ থেকে চেঁচাচ্ছে, দরজা ধাক্কাচ্ছে! অরিন্দম কাঁপতে থাকা হাতে দরজার লক আটকে দিল…

চতুর্থ তরঙ্গ – তৃতীয় পর্ব


লেখক পরিচিতি : অভি সেখ
সঙ্গীতচর্চা করতে ভালবাসেন। গান লেখা, তার সুর দেওয়া, এবং নিজে গাওয়া এর মধ্যেই মনের তৃপ্তি খুঁজে পান। এর সাথে রং-তুলির সাথে নির্জীব কাগজের প্রেক্ষাপটে প্রাণসঞ্চার করার মধ্যেও আনন্দ খুঁজে পান।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।