ভাঙা মঞ্চের মঞ্চিনী (পর্ব – ৭ )

লেখক: দামিনী সেন

গত পর্বের লিঙ্ক এখানে

একাদশ পরিচ্ছদ

ঘর ভর্তি হই চই, কলতান, সব থেমে যায় এক লহমায়। হতবাক মুখগুলোর সবক’টি চোখের দৃষ্টি এসে জড়ো হয় একটিমাত্র শ্যামলা, বড় বড় কালো চোখ, মিষ্টি লাবণ্যময়ী মুখের উপর। তার অবাধ্য চুলগুলো যথারীতি এসে পড়েছে সামনে, ঢেকে ফেলেছে কপালের পাশ, চোখের কোণ, কানের লতিকে। কিন্তু অভ্যেস মতো ঝটকাটার আজ কোনও দেখা মেলে না; কোনও হাতও উঠে এসে ঠেলে দেয় না চুলগুলিকে কানের পিছনে। অভ্যস্ত নির্মল হাসিটারও বদলে ঠোঁটে ও চোখে শুধু দেখা যায় এক অপিরিচিত দৃঢ়ত্বের ছায়া। ঘরের সমস্ত পরিবেশটাই হয়ে ওঠে কেমন থমথমে।
অনুচ্চ স্বরে, কিন্তু কেটে কেটে কথাগুলো ফের উচ্চারণ করে অনি, “না সফিদা, আমাদের দরকার নেই এই টাকার, বিজ্ঞাপনের বা স্পনসরশিপের। ওগুলো ছাড়াই তো এতদিন চলে আসছিল আমাদের। এখনও কষ্টেসৃষ্টে ঠিক চলে যাবে।”
মুখগুলো নীরবে কেবল এ ওর দিকে চায়। কিন্তু অস্বস্তিকর নীরবতাটুকু ভাঙতে এগোয় না কেউই।
শেষপর্যন্ত কথা ফোটে সুচিরই মুখে। অপমানের জ্বালা তার প্রকাশ পায় কন্ঠস্বরে। “এ’ সব কথার মানে! তুই নিজেই তো গিয়েছিলি বাবার কাছে, বিজ্ঞাপন চাইতে। আর আজ বাবা এত কষ্ট করে অমিতেশ কাকুকেও রাজি করে এত টাকার বিজ্ঞাপনের, এমনকি কয়েকটা শো স্পনসরের টাকাও জোগাড় করে দিল, আর এখন বলছিস সে’ সব নিবি না! সবটাই তোর খামখেয়াল, তাই না?”
কিছুই বলে না অনি উত্তরে। মুখ খোলে এবার কুণালও। “সেই সে’ দিন থেকেই দেখছি, তুই এই টাকাটা নেওয়ার ব্যাপারে গাঁইগুঁই করছিস। কেন বল তো! তুই কি চাস না, আমাদের গ্রুপটা স্বাবলম্বী হয়ে উঠুক?”
সফিদাও যোগ করে এবার, “আমরা জানি তুই তোদের পাড়ার আন্দোলনটার বিষয়ে খুব জড়িয়ে পড়েছিস। তা ওখানে আমরাও তো তোদের সমর্থনে শো করে এসেছি। মিটিং’এও গিয়েছি। কিন্তু তার মানে তো এই নয় যে আমাদের নিজেদের গ্রুপের স্বার্থটা ভুলে যেতে হবে। এতদিন বাদে এত ভালো একটা সুযোগ। নিজেরা স্টেজ নিয়ে পরপর ক’ সন্ধ্যে পুরোপুরি পেশাদারীভাবে শো করতে পারলে আমরা গ্রুপ হিসেবে কতটা এগিয়ে যাব বুঝতে পেরেছিস!”
“কেন এভাবে ব্যাগড়া দিচ্ছিস! যতসব কূটকচালি। ছাড় এবার, টাকাটা কীভাবে ব্যবহার করব সেটা এবার ছকে ফেল দেখি।” বলে ওঠে অর্ক।
“আহা, ওর যদি কিছু বলার থাকে বলতেই দে না!” পারুদির বোধহয় একটু খারাপ লাগে তাদের বাড়িতে অনেকদিন পর গ্রুপের এই মিটিং’এ অনিকে এভাবে কোণঠাসা হয়ে উঠতে দেখে। সে একটু সাপোর্ট করে অনিকে। বলাইও তাকে সমর্থন জানায়।
অনি একটা নিঃশ্বাস ফেলে। তারপর ম্লান হেসে বলে, “জানি শুনবে না, কিন্তু এটা একটা ফাঁদ, খুব লোভনীয় ফাঁদ। তোমরা বিক্রি হয়ে যাচ্ছ, সফিদা।”
“তার মানে!” অপমানে ফুঁসে ওঠে সুচি। “আসলে এই নাটকটায় তোর কোনও পার্ট নেই, তাই তোর খুব হিংসে হচ্ছে, তাই না? শুনে রাখ, সুচি তোর থেকে অনেক ভালো অভিনয় করে।” কুণালের গলায় ঝরে পড়ে জিঘাংসা।
“ছি ছি অনি! তুই শেষে আমাদের হিংসে করছিস। একটা নাটকে তোকে স্টেজ দিতে পারছি না বলে এভাবে আমাদের গ্রুপটাকেই শেষ করে দিতে চাইছিস! ছি ছি! আমি কিন্তু এতটা তোর কাছ থেকে আশা করিনি অনি।” সফির গলায় ধিক্কারের ছোঁয়া।
ধীরে ধীরে সুচির দিকে ফিরে তাকায় অনি, চোখে রাখে চোখ। “তুই বিশ্বাস করিস, আমি তোকে হিংসে করি সুচি?” হঠাৎ একটা প্রবল অস্বস্তিতে চোখটা নামিয়ে নেয় সুচি। মুখ দিয়ে আর কোনও কথা সরে না তার।
কানে এসে প্রবেশ করে তার বলাই আর পারুদির শান্ত গলায় কিছু মধ্যস্থতার প্রয়াস, কুণাল অর্কদের ক্ষিপ্ত চিৎকার, সফিদার ছিছিক্কার ও শ্লেষ। শুধু অনির গলাটাই আর শুনতে পায় না সে। যেন আত্মপক্ষ সমর্থনে কিছুই বলার নেই তার। তারপর সে শুধু দেখে অনির তণ্বী শরীরটা উঠে দাঁড়ায়, ঘর ছেড়ে এগিয়ে যায় বারান্দায়, জুতোটা পায়ে গলিয়ে নেমে যায় নিচে। সুচির সাইকেলে চাপা পড়েছিল ওর সাইকেলটা। ওটা সে যত্ন করে প্রথমে একপাশে সরিয়ে রাখে, তারপর নিজের সাইকেলের চাবিটা খুলে ঠেলে ঠেলে নিয়ে বেড়িয়ে যায় দরজা দিয়ে। এই প্রথম সুচিকে ছাড়াই, একা। হঠাৎ ওকে বড় একলা লাগে সুচির।


দ্বাদশ পরিচ্ছদ


মুঠোফোনের পর্দাটা হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠতে, ভুরুটা কুঁচকে ওঠে সুজয়ের। কাজের সময়টা তার কোনওরকম ডিসটারবেন্স একদম ভালো লাগে না। কিন্তু এই মুঠোফোন আজ একরকম নেসেসারি নুইসেন্স।অত্যন্ত বিরক্তির সাথেই তাই সে হাত বাড়িয়ে তুলে নেয় ওটা।
ফোনটা হাতে তুলে কিন্তু বদলে যায় তার ভুরুর ভঙ্গিমা। বিরক্তিটা কেটে গিয়ে সেখানে তার জায়গা নেয় একটু উদ্বেগ। পর্দায় তখন ভেসে উঠেছে মেয়ের আদরের নাম, পুট্টুস।
“হ্যালো, কী হল রে পুট্টুস?”
প্রশ্নর সাথে সাথেই ওপাশ থেকে প্রায় হাউমাউ করে ওঠে সুচি। “বাবা, অনি।”
“অনি! অনির আবার কী হল?” বিস্মিত প্রশ্ন সুজয়ের গলায়।
“ওরা ওকে মেরেছে। বেদম মেরেছে। এত মেরেছে যে ও সোজা হয়েঠিকমতো দাঁড়াতেও পারছে না।” ফুঁপিয়ে ওঠে মেয়ে।
“কে মেরেছে ? কেন মেরেছে ?” কিছুই না বুঝতে পারা বিস্ময় ঝরে পড়ে সুজয়ের গলায়।
“ওদের পাড়ায়। জানি না কে মেরেছে। কিন্তু পুলিশ গিয়ে ওদেরই তুলে এনেছে। এখন হাসপাতালে। ওদের এখানে আনা হচ্ছে খবর পেয়ে আমরাই এখানে আগে চলে এসেছি। কিন্তু আমাদের দেখা পর্যন্ত করতে দিচ্ছে না।” কান্নায় এবার সত্যিই বুজে আসে মেয়ের গলা।
সুজয়ের হাতটা কাঁপতে থাকে। মুঠোফোনটা শক্ত করে চেপে ধরে সে। তারপর একটু সামলে নিয়ে বলে, “তুই এখন কোথায়?”
“হাসপাতালের সামনে। আমরা ক্লাসের অনেক বন্ধুরাই আছি। ইউনিয়নের ওরা এর প্রতিবাদে মিছিল বের করবে বলছিল। কিন্তু আমরা যাইনি। তুমিই বল, অনিকে এভাবে এখানে ফেলে রেখে কিসের মিছিলে যাব? এতদিন তো কেউ ওর পাশে দাঁড়ায়নি। আর এখন যখন সবাই এখানে চলে আসছি, তখন বলে মিছিল বের করব।” সুচির গলায় উদ্বেগের সাথেই ঝরে পড়ে একরাশ বিরক্তি।
“বুঝলাম। কিন্তু তোর মিছিলে যাওয়ারও কোনও দরকার নেই। ওখানে থাকারও কোনও দরকার নেই। সোজা বাড়ি চলে যা।” একটু কঠোরই শোনায় সুজয়ের গলা।
“বলছ কি বাবা! অনি এখানে পড়ে আছে। জান, ওকে যখন গাড়ি থেকে নামাচ্ছিল, উফফ …” আর বলতে পারে না সুচি। ওর চোখের সামনে শুধু ভেসে ওঠে দৃশ্যটা। আরও কজনের সাথেই ছেঁড়া কামিজ, ছেঁড়া সালোয়ার, চুলগুলো সম্পূর্ণ খুলে আসা, অনিকে টানতে টানতেই একপ্রকার নিয়ে যাওয়া হচ্ছে করিডোর দিয়ে। ঠিকমতো হাঁটতে পারছে না অনি, পড়ে যাচ্ছে, আর পিছনের মহিলা অফিসার মুখ দিয়ে একটা কানে আঙুল দেওয়া গালাগাল ছুঁড়ে চুলের মুঠি ধরে তুলে আনছে তাকে, সেই সঙ্গে চলছে সবুট একের পর এক লাথি।
“তোকে আমি বলেছি, ওখান থেকে চলে আসতে। আর একটাও কথা নয়, বাড়ি যা।” অবিশ্বাস্য কঠোর হয়ে ওঠে সুজয়ের গলা। সে নিজেই বুঝতে পারে। ওপাশে চুপ করে যায় সুচিও। থতমত খেয়ে যায় সেও। বাবার এত কঠিন গলা শেষ কবে শুনেছে মনে করতে পারে না সে।
ফোনটা কেটে কী একটু ভাবে সুজয়। অস্থিরতা তার প্রকাশ পায় ফোনটা নিয়ে তার আনমনে খেলায়। মনে হয় কী যেন একটা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে সে। তারপর হঠাৎ একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পেরেই যেন চোখের সামনে আবার তুলে ধরে সেটাকে। একটা নম্বর বের করে রিং করে।
“হ্যালো, অমিতেশ? কোথায় আপনি? ওহো, থানায়! – কী! অপারেশন সাকসেসফুল। বাঃ। – পাণ্ডা ক’টাকে তুলে নিয়ে যাওয়া গেছে! ভালো ভালো। – মিষ্টির দোকানের মালিকটাকে দিয়ে দোকান ভাঙচুরের একটা অভিযোগ করিয়ে দিতে বলছেন অফিসার? না না অতটা করার কী দরকার? পেটানো হয়েছে, পুলিশে তুলে এনেছে। ওতেই হবে। বেশি বাড়াবাড়ি করার দরকার নেই। – কী? যদি আবার করে? আর সাহস হবে বলে মনে হয় না। আর হলে তখন আবার কিছু একটা দেখা যাবে। আসলে খবর পেলাম কলেজেও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। ইউনিয়নের ছেলেরাও মনে হচ্ছে ঠিকঠাক ম্যানেজ করতে পারছে না। এবারের মতো ছেড়ে দেওয়াই ভালো। – হ্যাঁ হ্যাঁ, একটু ভয় টয় দেখিয়ে দিন। সব অস্ত্র একসাথে ব্যবহার না করে একটু রয়েসয়েই করা ভালো। তাতে অস্ত্রের কার্যকারিতা থাকে।”
ফোনটা নামিয়ে রেখেপ্রথমে চশমাটা খুলে নেয় সুজয়। তারপরউপরে দেওয়ালে লাগানো এসিটার দিকে চোখ তুলে তাকায় একবার। কই, ওটা তো ঠিকই চলছে ! পকেট থেকে রুমালটা বের করে কপালের রগ বেয়ে গড়িয়ে নামতে শুরু করা ঘামটাকে ঘষে ঘষে ভালো করে মোছে সে। তারপর চশমাটা আবার পড়ে নিয়ে গিয়ে দাঁড়ায় ড্রয়িং বোর্ডটার সামনে। কিন্তু পুরো ড্রয়িংটাই কেমন যেন ঝাপসা লাগে তার। রিডিং গ্লাসটা খুলে ভালো করে মুছে আবার চোখে চড়ায় সে। নাঃ, একইরকম। হতাশ হয়ে কাজের মুহূর্তে সাধারণত টেবিল থেকে দূরে এককোণায় অবহেলে পড়ে থাকা নিজের রিভলভিং চেয়ারটাকেইটেনে নিয়ে বসে পড়ে সে। ইন্টারকমটা তুলে নির্দেশ পাঠায় তারপর, “কাকলি, এক গ্লাস জল।”

আগামী পর্বের লিঙ্ক এখানে

অলংকরণ – শর্মিষ্ঠা দেবযানী


লেখক পরিচিতি: দামিনী সেন
গত শতাব্দীর শেষ পাদে জন্ম। ছেলেবেলা কেটেছে মফস্‌সলে। সেখানেই পড়াশুনো — স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন। ঘুরতে ভালোবাসেন, আর ভালোবাসেন পড়তে। জানেন একাধিক বিদেশি ভাষা। আগ্রহ বহুমুখী, কলমের অভিমুখও। কবিতা, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস — সাবলীল তাঁর কলমের গতি। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ইতিমধ্যেই প্রকাশিত বেশ কিছু কবিতা, প্রবন্ধ, ছোটগল্প। কাব্যগ্রন্থ “ভাঙা সে সাম্পান” প্রকাশের পথে। ধারাবাহিক উপন্যাস “ভাঙা মঞ্চের মঞ্চিনী”-র মধ্য দিয়েই ঔপন্যাসিক হিসেবে তাঁর প্রথম আত্মপ্রকাশ।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।

লেখা আহ্বান - বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন