মুখোশ

লেখক : ড. বিশ্বজিৎ বাউনা

স্কুলের প্রার্থনার পর অম্লানবাবুর অনুপস্থিতিতে প্রভিশনাল রুটিন তৈরির দায়িত্ব পেয়ে কাঞ্চনবাবু চেয়ার টেনে নিয়ে টেবিলের উপর ঝুঁকে বসলেন। সকাল দশটা পঞ্চাশের পর চক-ডাস্টার আর প্রেজেন্টের খাতা হাতে নিয়ে যে যার রুটিনমাফিক নির্ধারিত ক্লাসের দিকে শিক্ষক শিক্ষিকারা রওনা দিলেন। ঘন্টা দিয়ে চুপচাপ বসে থাকা জয়দাকে কাঞ্চন বাবু বললেন, “জয়দা, দেখুন তো আর কোন খাতা পড়ে আছে কিনা?”
জয়দা আলনা থেকে অষ্টম শ্রেণীর ক বিভাগের খাতা নিঃশব্দে এগিয়ে দিলেন টেবিলের দিকে। রুটিনে দ্রুত চোখ বুলিয়ে বুঝতে পারলেন যে ওই ক্লাসটি আছে অমৃতবাবুর। ইংরেজি ক্লাস। তিনি যে আসবেন না তাও তিনি আজ স্কুলের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে জানাননি। ঘড়িতে তখন দশটা বেজে ছাপান্ন মিনিট।

প্যান্টের বাঁ পকেট থেকে ফোন বের করে ডায়াল করলেন অমৃতবাবুকে। প্রয়োজনীয় কথোপকথনে তিনি কনফার্ম হয়ে গেলেন যে তিনি আজ স্কুলে আসছেন না। স্টাফ রুমে তিন-চারজন স্যার বসে আছেন। কাঞ্চনবাবু চোখ বুলিয়ে তন্ময়বাবুকে দেখতে পেলেন। উনিও ইংরেজির শিক্ষক। দ্রুত রুটিন চেক করে দেখে নিলেন ওনার ক্লাস আছে সেই তৃতীয় পিরিয়ডে। দশম শ্রেণীতে। তাই নির্দ্বিধায় এই প্রথম পিরিয়ডে ওনাকে পাঠানো যাবে, এই ভেবে উনি বললেন, “তন্ময়বাবু, ক্লাস এইটে যান তো। অমৃতবাবু আসতে পারছেন না।”
“ঠিক আছে স্যার, খাতাটা দিন,” এই বলে প্রেজেন্টের খাতাটা টেবিল থেকে সংগ্রহ করে দ্রুত উপায়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলেন স্টাফ রুম ছেড়ে।

ছেড়ে দিয়ে উঠে তিনতলায় করিডরে পৌঁছে ডানদিকে পশ্চিমদিক বরাবর পর পর দুইটি শ্রেণীকক্ষ অতিক্রম করে তিন নম্বর শ্রেণীতে অষ্টম শ্রেণীর ক্লাস ক বিভাগের হেঁটে যাওয়ার সময় প্রথম কক্ষ পেরোতে গিয়ে নেহাত কৌতূহলবশত তন্ময়বাবু খোলা দরজায় উঁকি দিয়ে দেখলেন, শশাঙ্কবাবু চেয়ারে বসে ক্লাস নিচ্ছেন। যখন ওই রুম পেরিয়ে যাচ্ছেন, তখন তিনি উপলব্ধি করলেন যে শশাঙ্কবাবু বাঁহাতে থাকা ঘড়িটার দিকে কটাক্ষচোখে তাকালেন যেন।

টিফিন পিরিয়ডের পর প্রদীপদার স্কুল ক্যান্টিনে চায়ের আসর বেশ জমে উঠেছে। উপস্থিত শশাঙ্কবাবু হঠাৎ বিকৃত স্বরে বললেন, “কি আর বলি বলুন, এই সময়ের শিক্ষকদের বলার আর কিছুই নেই। আজ তো তন্ময়কে দেখলাম ক্লাসে যাচ্ছে ক্লাস শুরুর দশ মিনিট পরে। তাও আবার হাতে চক-ডাস্টার নেই। কিছু বলার নেই। আর ঠিক এদের জন্যই পরে গার্ডিয়ান মিটিংয়ে শুনতে হয় যে ক্লাসে টিচাররা সময়ে পৌঁছোন না।”
লাইব্রেরিয়ান পলাশ বলে উঠল, “এই জন্যই আজকাল সবাই শিক্ষককে গালাগাল দেয়।”
সেই চা-বৈঠকে উপস্থিত কাঞ্চনবাবু বললেন, “চক-ডাস্টার না নিয়ে ক্লাসে এরা যায় কি করে? ক্লাস করা যায়?” উষ্মা ঝরে নামল গলা থেকে।
তার কথা শেষ হতে না হতেই স্কুল বিল্ডিংয়ের ঠিক পাশেই থাকা একটি গ্রামীণ কো-অপারেটিভ ব্যাংকের সহকর্মী বলে উঠলেন, “এখনকার দিনে টিচারদের দেখলে আর সেই শ্রদ্ধা আসে না। সব কেমন যেন ফাঁকিবাজ টাইপের।”

এমন কটু সমালোচনামূলক কথা চলাকালীন পঞ্চম পিরিয়ড শেষ হয়ে আরও মিনিট দশ-বারো অনায়াসে কেটে গেল। ভিড় পাতলা হয়ে গেলে শশাঙ্কবাবু বললেন, “কাঞ্চনবাবু, আর আপনার ক্লাস আছে নাকি?”
“হুম, আছে। এই নিচের একতলায়। চলুন।”
“হুম, আমারও আছে, চলুন।”

ক্যান্টিন পিছনে ফেলে দুইজন হাঁটতে হাঁটতে একতলার করিডরে পৌঁছে যে যার নিজের ক্লাসের দিকে এগিয়ে গেলেন। আবার সিঁড়ি বেয়ে উঠে স্টাফ রুমে ঢুকে চক-ডাস্টার নিয়ে এসে ক্লাসে ঢুকলে দেরি হয়ে যাবে ভেবে অংকের ক্লাসে ঢুকে পড়লেন শশাঙ্কবাবু।


লেখক পরিচিতি : ড. বিশ্বজিৎ বাউনা
জন্ম ১৯৮৬। পশ্চিম মেদিনীপুরে। পিংলায়। ২০১০-এ বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এমএ (ফার্স্ট ক্লাস/সিলভার মেডেলিস্ট), বি. এড., পিএইচডি। পেশা: শিক্ষকতা। মূলত কবিতা লেখেন। উল্লেখযোগ্য প্রকাশিত বই: ডুলুং পাহাড়ে রহস্য, ঈশ্বরীকে হলুদ সনেট, আত্মক্ষরণের ফসিল, অক্ষরের কালকেতু, ধুনুরি তফাৎগুচ্ছ, লুণ্ঠন শেষের শূন্যতা, বেতাল রহস্য, বিরসা মুন্ডা: উলগুলানের সনেটগুচ্ছ, পীড়াপর্বে একলব্য ইত্যাদি। পেয়েছেন 'দ্বৈরথ সাহিত্য সম্মান', 'চূনী কোটাল স্মৃতি সম্মান','বিভূতিভূষণ স্মৃতি পুরস্কার' ও কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচী স্মৃতি পুরস্কার।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।