লেখক : অভি সেখ
(তৃতীয় পর্ব)
তারপর…
এক মুহূর্তের জন্য শুধু নিঃস্তব্ধতা। শ্বাস নিতে নিতে সে পিছনের ঠাণ্ডা দেওয়ালে হেলান দিল। অরিন্দম দরজার পাশে হেলান দিয়ে হাঁপাচ্ছিল। তার হৃদস্পন্দন এখনও স্বাভাবিক হয়নি। বাইরে থেকে শোনা যাচ্ছে—
“গ্যা-আ-আ-আ-আ!”
মিউট্যান্টগুলো দরজা ধাক্কাচ্ছে, কিন্তু সেটা ভাঙতে পারছে না।
“এখান থেকে বেরোতে হবে… কিন্তু কীভাবে?”
এই করিডর অন্ধকার, বাতাসে পচা, ভেজা কাপড়ের গন্ধ। সে তার টর্চ জ্বালিয়ে সামনের দিকে তাকাল। দুই পাশে কয়েকটা দরজা, ছাদের পাইপ থেকে জল পড়ছে, মেঝেতে রক্তের দাগ! অরিন্দম ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগল। এই জায়গাটা আগের করিডর থেকে আলাদা। এটা হাসপাতালের পুরনো অংশের মতো লাগছে—দেওয়ালে ছোপ ছোপ দাগ, কিছু জায়গায় প্লাস্টার খসে পড়েছে, আর জানালাগুলো বন্ধ। তবে সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার, এখানে কোন সাইরেনের আওয়াজ নেই। শুধু নিঃস্তব্ধতা। আর সেই নিঃস্তব্ধতার মাঝেই…
একটা দরজার পাশ দিয়ে যেতে যেতেই অরিন্দম থমকে গেল। কাচের দরজার ওপাশ থেকে কেউ তাকিয়ে আছে! অরিন্দম দ্রুত পিছিয়ে এল, টর্চের আলো ফেলল কাচের ওপরে! কিন্তু… কিছুই নেই।
“ভ্রম হচ্ছে? নাকি সত্যিই কিছু ছিল?”
সে দরজার হ্যান্ডেলটা ধরে ধাক্কা দিল…
“খট!”
সে আবার চলতে শুরু করল। এখনও হাসপাতাল থেকে বেরনোর কোন রাস্তা সে খুঁজে পায়নি। অরিন্দম করিডরের অন্ধকার পথ ধরে এগিয়ে যেতে থাকল। তার চারপাশে ফাটা দেওয়াল, ছোপ ছোপ রক্তের দাগ, আর পাইপ থেকে টপটপ করে জল পড়ছে।
হঠাৎ করিডর শেষ হয়ে গেল, সামনে দু’টো পথ। “মেল ওয়ার্ড” – বাঁ দিকে, আর “ফিমেল ওয়ার্ড” – ডান দিকে। দু’টো পথই সমান অন্ধকার, সমান ভয়ঙ্কর। এখন কোন দিকে যাবে? বাঁ দিকের করিডর থেকে ধাতব কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ এল। ডান দিকের করিডর থেকে একটা ফিসফিসানি ভেসে এল। অরিন্দম এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল। বাঁ দিক থেকে ধাতব কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ, আর ডান দিক থেকে অস্বাভাবিক ফিসফিসানি। তার শ্বাস ভারী হয়ে আসছে। এই হাসপাতালের প্রতিটি করিডর যেন একেকটা ফাঁদ। সে কি ভুল পথে যাচ্ছে? নাকি যে কোন দিকেই মৃত্যু অপেক্ষা করছে? সে পিছনে তাকাল। ফেরার পথও অন্ধকারে ঢেকে গিয়েছে।
“ফিরে যাওয়ার উপায় নেই… একটা দিক বেছে নিতেই হবে।”
সে ধীরে ধীরে ডান দিকের করিডরে—ফিমেল ওয়ার্ডের দিকে এক পা বাড়াল। কিন্তু ঠিক তখনই…
“থাপ!”
তার পায়ের নিচে কিছু চটচটে জিনিস পড়ল। সে টর্চ ফেলে দেখল—গাঢ় লাল রক্ত, যেটা করিডরের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছে। আর সেই রক্তের উৎস? একটা খোলা দরজা… যার ভিতর থেকে কেউ তাকে দেখছে! সে ধীরে ধীরে মাথা ঘুরিয়ে দরজাটার দিকে তাকাল। ভিতরে অন্ধকার। কিন্তু… অন্ধকারের মাঝেও দু’টো ছায়া নড়ছে! সে টর্চের আলো ফেলল। একটা হাত দ্রুত দরজার ভিতর থেকে সরে গেল! আর সেই মুহূর্তে… করিডরের বাতি একটা বিকট চিঁ চিঁ শব্দ করে জ্বলে উঠল! বাতির আলোয় করিডরের গভীরে—কেউ দাঁড়িয়ে আছে!
বাতির ঝলকানি থেমে গিয়েছে। করিডর নিঃস্তব্ধ, শুধু দূরে একটা ভাঙা ভেন্টিলেশন ফ্যানের ঘষটানির শব্দ আসছে। কিন্তু… অরিন্দম একা নেই।
“বাহ, বাহ! তুমি তো বেশ ধৈর্য্যশীল দেখছি।”
একটা গভীর, কাঁপিয়ে ওঠানো কণ্ঠস্বর করিডরে প্রতিধ্বনিত হ’ল। অরিন্দম টর্চের আলো ফেরাল—একটা সাদা কোট পরা লোক করিডরের শেষে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু, এটা কি সত্যিই লোক? সে ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে আসছে, তার লম্বা, রোগা চেহারার ছায়া দেওয়ালে কাঁপছে। ডাক্তারের মুখে একটা বিকৃত হাসি লেগে আছে। তার গায়ে রক্তের দাগ, হাতে একটা বিশাল অস্ত্রোপচারের ছুরি, আর চোখে পাগলামির আগুন!
“তোমাকে নিয়ে গবেষণা করা যাবে,” ডাক্তার বিড়বিড় করল।
অরিন্দম এক ধাপ পিছিয়ে গেল। “আমি… রোগী নই!”
ডাক্তার এবার বিকটভাবে হেসে উঠল। “এই হাসপাতালের সবাই রোগী!”
আর তারপর… সে দৌড় দিল অরিন্দমের দিকে! অরিন্দম সেকেণ্ডের ভগ্নাংশে বুঝতে পারল—পালাতে হবে! ডাক্তার ছুটে আসছে, বিশাল অস্ত্রোপচারের ছুরিটা তার হাতে চকচক করছে। তার হাঁটার ভঙ্গি স্বাভাবিক নয়—একটা কাঁপানো উন্মাদনা আছে তাতে, যেন সে উপভোগ করছে এই তাড়া করা!
“তোমার দেহ খুলে দেখতে চাই, বুঝতে চাই কীভাবে তুমি এতদিন বেঁচে আছ!”
ডাক্তারের কণ্ঠস্বর করিডরজুড়ে প্রতিধ্বনিত হ’ল, যেন দেওয়ালগুলোও তার উন্মাদনার অংশীদার! অরিন্দম পেছোতে লাগল, কিন্তু তার পায়ের নিচে রক্ত আর জল মিশে এক ধরণের পিচ্ছিল আস্তরণ তৈরি করেছে। হঠাৎ পা পিছলে গেল, মাটিতে ধপ করে পড়ে গেল সে, আর টর্চটা হাত থেকে গড়িয়ে দূরে চলে গেল।
অন্ধকার। শুধু শোনা যাচ্ছে—
“টিক… টিক… টিক…”
ডাক্তারের জুতোর শব্দ। আরেকটু এগিয়ে এল… আরেকটু… কিছুক্ষণের মধ্যেই সে অরিন্দমের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে! অরিন্দম তাড়াতাড়ি মেঝের ওপর হাত চালিয়ে কিছু ধরার চেষ্টা করল… কিছু একটা আছে! একটা ধাতব বস্তু—কাঁচের সিরিঞ্জ!
“হয় মরব, নয় মারব!”
ঠিক যখন ডাক্তার তার ছুরিটা নামিয়ে আনতে গেল, অরিন্দম সিরিঞ্জটা তুলে তার গলায় গেঁথে দিল। ডাক্তার চিৎকার করে উঠল।
“গ্যা-আ-আ-আ-আ!!”
তার শরীর হঠাৎ কাঁপতে লাগল, যেন সে ভয়ানক যন্ত্রণায় ছটফট করছে। তার হাত থেকে ছুরিটা খট করে পড়ে গেল। অরিন্দম সময় নষ্ট না করে এক লাফে উঠে দৌড় দিল করিডরের দিকে। পিছনে এখনও শোনা যাচ্ছে ডাক্তারের উন্মাদ চিৎকার।
“তুমি… পালাতে পারবে না… আমি তোমাকে খুঁজে বের করব!”
করিডরের শেষ প্রান্তে একটা দরজা! এটাই একমাত্র পথ! অরিন্দম দরজাটা ধাক্কা দিল—এটা খোলা! সে দ্রুত ভিতরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করল… আর তারপর…
পুরো হাসপাতাল আবারও স্তব্ধ হয়ে গেল। অরিন্দম দরজার ওপারে প্রবেশ করল, তার বুক ধড়ফড় করছে। সে কোথায় এসেছে? অন্ধকার ঘরের ভিতর একটা তীব্র দুর্গন্ধ… পচা মাংসের গন্ধ! তার হাত থেকে টর্চ প্রায় পড়ে যাচ্ছিল। বেড… চারপাশে অসংখ্য বেড সারি সারি রাখা। কিন্তু এগুলো সাধারণ বেড নয়! প্রত্যেকটা বেডে বাঁধা আছে অমানবিকভাবে কাটা-ছেঁড়া করা দেহ! কেউ নেইমপ্লেটহীন রোগী, কারও হাতের জায়গায় জোড়া লাগানো হয়েছে ধাতব হুক, কারও শরীরের অর্ধেক মাংস নেই—শুধু হাড় বের হয়ে আছে। কেউ কেউ এখনও শ্বাস নিচ্ছে… কেউ হালকা নড়ছে…
“আমাকে… বাঁচাও!”
অরিন্দম হঠাৎ ঘুরে তাকাল। একটা রোগী—তিন নম্বর বেডে শুয়ে আছে। তার এক চোখ নেই, শরীরে সেলাইয়ের দাগ, মুখের একপাশ গলে গিয়েছে।
“তোমাকে এখানে আসতে বলা হয়নি… পালাও…”
আরেকটা রোগী—নয় নম্বর বেডে, ফিসফিস করে বলল। তার মুখে কোনও চামড়া নেই, শুধু রক্ত মাখানো দাঁত আর ফাঁকা মাংসপেশি দেখা যাচ্ছে। অরিন্দমের মনে হ’ল দেওয়ালগুলোও শ্বাস নিচ্ছে। এখান থেকে দ্রুত বেরোতে হবে, কিন্তু কোন দিকে যাবে? সে পিছনে তাকাল, দরজাটা এখন আর খোলা নেই। তখনই একটা হাড় হিম করা শীতল বাতাস ঘরের মধ্যে বয়ে গেল। আর তার পরেই…
“তারা আসছে…!”
নয় নম্বর বেডের বিকৃত রোগীর শেষ ফিসফিসানি কানে আসার আগেই অরিন্দম শুনতে পেল—একটা ধাতব কিছু ঘষটানোর শব্দ, ধাতু মেঝের ওপর আঁচড় কাটছে। আর তার সাথেই একটা পরিচিত গলায় বিকট হাসি!
“হাহাহাহা! এত তাড়াতাড়ি পালানোর চেষ্টা? তুমি কি জানো, এই হাসপাতালের করিডরগুলো আমার শিরার মত! আমি এখানে তোমার রক্তের গন্ধ পাই!”
অরিন্দমের শিরদাঁড়া দিয়ে আবার একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল। ডাক্তার ফিরে এসেছে!
টিক… টিক… টিক…
জুতোর শব্দ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। করিডর থেকে ধাতব কিছুটা আঁচড়ানোর আওয়াজ—হ্যাঁ, ওই অস্ত্রোপচারের ছুরিটাই! অরিন্দম দ্রুত মাথার ওপরের লাইটের দিকে তাকাল—একটা মাত্র হলদে আলো জ্বলছে, আর পুরো ওয়ার্ডটাই আধো অন্ধকার। একটা লুকনোর জায়গা চাই! কিন্তু কোথায়? বেডের নিচে? নাহ, সেগুলো অনেক নিচু। পর্দার পিছনে? ডাক্তার হয়ত সেগুলো এক এক করে সরিয়ে দেখবে…
“আমি জানি তুমি এখানে আছো!”
ডাক্তার এবার আরেকটু সামনে এসেছে। তার ছুরির ফলা মেঝেতে টেনে নিয়ে আঁচড় কাটছে, যেন আতঙ্ক ছড়িয়ে দিতে চায়।
“তুমি কি জানো, এই রোগীদের কী করা হয়েছে? আমি তাদের নতুন জীবন দিয়েছি! নতুন শরীর দিয়েছি! এদের মধ্যে আর নারী পুরুষ ভেদাভেদ নেই।”
অরিন্দম বুঝতে পারল, আর মাত্র কয়েক মুহূর্ত আছে! কোথাও যেতে হবে, এখনই! তার চোখ আটকাল ওয়ার্ডের শেষ কোণে একটা ওষুধের ক্যাবিনেটে! দরজা আধখোলা, ভিতরে জায়গা আছে! একটু ভুল হ’লেই মৃত্যু নিশ্চিত!
“বাহ, বেশ চুপচাপ হয়ে গেলে! ভয় পাচ্ছ?”
ডাক্তারের কণ্ঠস্বর ঠিক পিছনেই! অরিন্দম নিঃশব্দে দৌড়ে গিয়ে ক্যাবিনেটের দরজা খুলল, নিজেকে গুটিয়ে ভিতরে ঢুকল, আর ধীরে ধীরে দরজা টেনে দিল। ঠিক তখনই—ডাক্তার প্রবেশ করল ওয়ার্ডে! তার ছুরির ফলায় ওয়ার্ডের হলদে আলো প্রতিফলিত হচ্ছে। তার বিকৃত হাসি এখনও ঠোঁটে। আর তার চোখ…সেগুলো যেন মানুষের চোখ নয়।
অরিন্দম ক্যাবিনেটের ভিতরে বসে নিঃশ্বাস আটকে রাখল। বাইরে ডাক্তার ধীর পায়ে হেঁটে চলেছে…
টিক… টিক… টিক…
তার ভারী বুটের শব্দ মেঝেতে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। আর… শড়াশড় শব্দ… তার বিশাল অস্ত্রোপচারের ছুরিটা ধাতব মেঝের ওপর টেনে আনছে।
“হাহাহাহা…”
ডাক্তারের ফিসফিসানিতে বিদ্রূপ, উন্মাদনা!
“তুমি কি ভেবেছ, আমি তোমাকে খুঁজে পাব না?”
তার ভারী শ্বাস… গন্ধটা যেন ক্যাবিনেটের ভিতরেও ঢুকে পড়ছে! গলিত রক্তের গন্ধ! অরিন্দম ঠোঁট কামড়ে রইল। একটা শব্দও করা যাবে না। একটু আওয়াজ হ’লেই মৃত্যু অবধারিত!
“এই যে… ডাক্তার বাবু…”
তিন নম্বর বেডের রোগী কর্কশ কণ্ঠে বলল, “আমি ওকে দেখেছি, ও এখানে এসেছিল!”
অরিন্দমের বুক ধড়ফড় করে উঠল! বেইমান! ডাক্তারের পায়ের শব্দ থেমে গেল। সেই বিকৃত হাসি…
“ওহ! তুমি ওকে দেখেছ?” ডাক্তার এবার তার ছুরিটা হাতে ঘোরাতে লাগল। “হুমম, তাহলে তো তোমার পুরস্কার পাওয়া উচিত!”
সশশশ… ছাক!
গড় গড় গড় গড়…
তিন নম্বর বেডের লোকটার কাটা গলার ভিতর থেকে রক্তের ঝর্ণা ছুটল! বেচারা কেবল কুঁকড়ে উঠল… তারপর নিঃস্তব্ধ! ডাক্তার এবার উন্মাদ গলায় ফিসফিস করল,
“সত্যি বললেই সবাই পুরস্কার পায় না, বন্ধু!” তারপর সে আবার ধীর পায়ে হাঁটতে শুরু করল।
টিক… টিক… টিক…
অরিন্দম নিজের গলা চেপে ধরে আছে, যেন তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। এখান থেকে বেরোতে হবে, কিন্তু কিভাবে? ডাক্তার ধীরে ধীরে বেডের চারপাশ ঘুরছে, মাঝে মাঝে পর্দা সরাচ্ছে। যদি সে ক্যাবিনেটের দিকে চলে আসে? হঠাৎ, একটা বিকট ধাক্কা! অরিন্দম দেখল, নয় নম্বর বেডের বিকৃত রোগী লাফিয়ে পড়েছে ডাক্তারের ওপর!
“তোকে মেরে ফেলব… তোকে মেরে ফেলব!”
ডাক্তার প্রথমে একটু পিছিয়ে গেল, তারপর মৃদু হাসল। “ওহ, আমায় মারবে? কাটা-ছেঁড়া করেছিলাম বলেই রেগে আছ, তাই না?” সে ধীরে ধীরে ছুরিটা তুলল। “তাহলে এটা একটু বেশি গভীর করে করি!”
ছাক!
রোগীর গলা ভেদ করে ছুরিটা পিছন দিয়ে বেরিয়ে গেল! অরিন্দমের চোখের সামনে রোগীটা কেঁপে উঠল, তারপর নিথর হয়ে গেল। এটাই সুযোগ! ডাক্তার যখন পাগলের মত হাসছে, তখনই অরিন্দম ক্যাবিনেটের দরজা খুলে ধীরে ধীরে পিছিয়ে গেল। দরজার দিকে যেতে হবে। কিন্তু…
ডাক্তারের হাসি হঠাৎ থেমে গেল। তার চোখ সরাসরি ক্যাবিনেটের দিকে! তার ঠোঁটে সেই চিরাচরিত উন্মাদ হাসি…
“তুমি কি ভেবেছ, আমি জানতাম না তুমি এখানে আছ?” তার ছুরির ফলা অন্ধকারে চকচক করল, “তোমাকে আসতে বলেছি? না! কিন্তু এখন তোমাকে বিদায় জানাব। চলো, অপারেশন শুরু করি!”
পায়ের শব্দ যেন পিছন থেকে তাড়া করে আসছে। ডাক্তার খুব কাছাকাছি…
“দৌড়ও, দৌড়ও! কিন্তু বেশিক্ষণ পারবে না!”
অরিন্দম পাগলের মত ছুটছে। সামনের করিডরে আলো কম, অনেক জায়গায় শুধু লাল এমার্জেন্সি লাইট জ্বলছে। আর পিছনে ডাক্তার উন্মাদ হেসে ধেয়ে আসছে, ছুরিটা হাতে চকচক করছে!
“হাহাহাহা! তুমি জানো, আমি কখনও শিকার হারাই না!”
একটা মাত্র ভুল, আর ছুরিটা গলায় বসবে! হঠাৎ…
ঢুপ!
পায়ের শব্দ থেমে গেল। একটা থপথপে আওয়াজ। অরিন্দম মুহূর্তেই পিছনে তাকাল। ডাক্তার মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে! কান্নার মত একটা কর্কশ শব্দ করছে, তার শরীর কাঁপছে।
“কি… হচ্ছে… এটা…!”
তার হাত-পা হঠাৎ ছটফট করে উঠল, পুরো শরীর খিঁচুনি খাচ্ছে! মুখ দিয়ে ফেনা বেরোচ্ছে, চোখগুলো উল্টে যাচ্ছে।
“না… এটা… সম্ভব… না!”
অরিন্দম থমকে দাঁড়িয়ে গেল। ডাক্তার অদ্ভুতভাবে মোচড়াচ্ছে, একবারে মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। তার হাত পা বাঁকা হয়ে যাচ্ছে, এমনভাবে কাঁপছে যেন তার শরীরের নিয়ন্ত্রণ নেই!
“আআআআরঘহহ!”
তার মেরুদণ্ড ভেঙে যেতে শুরু করেছে! একটা বিকট “ক্র্যাক!” শব্দ হ’ল… ডাক্তারের শরীর যেন দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে, কংকাল ভিতর থেকে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে! তার হাতদু’টো অসম্ভব কোণে বেঁকে গিয়েছে, হাড়গুলো চামড়ার নিচ থেকে উল্টে বেরিয়ে আসছে! কিন্তু কেন? কী হচ্ছে এটা? অরিন্দম এবার খেয়াল করল, ডাক্তারের গলায় একটা কাটা দাগ! সেখানে গাঢ় কালচে নীল দাগ ছড়িয়ে পড়ছে, যেন শরীরের ভিতরে কিছু ছড়িয়ে পড়েছে!
“বিষ! এটা বিষ!”
ডাক্তার শেষবারের মত আর্তনাদ করে উঠল, তার চোখ ফেটে গেল, কালো তরল বেরিয়ে এল! তারপর সে নিস্তেজ হয়ে গেল। সবকিছু নিঃস্তব্ধ। শুধু লাল আলো জ্বলছে আর নিঃস্তব্ধতা কানে বাজছে। ডাক্তার মারা গিয়েছে। কিন্তু কীভাবে? কে তাকে বিষ দিল? অরিন্দম বুঝতে পারল, হাসপাতালের এই উন্মাদনার মাঝেও আরেকজন আছে, যে তাকে সাহায্য করছে। কিন্তু কে সে?
এখন আর দাঁড়িয়ে থাকার সময় নেই। ডাক্তারকে ফেলে রেখে অরিন্দম করিডরের দিকে ছুটতে শুরু করল। তাকে বের হতে হবে, যেভাবেই হোক! অরিন্দমের দৌড়নোর শব্দ পুরো হাসপাতালজুড়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। তার হৃদস্পন্দন এত জোরে চলছে, যেন সেটা কানে শোনা যাচ্ছে। করিডরের শেষে বিশাল একটা দরজা আর সামনে রিসেপশন! এটাই হাসপাতালের মূল প্রবেশদ্বার। এখান থেকেই আসা-যাওয়া হয়! আর ঠিক তার সামনে বাইরের মেইন গেট! দরজা আধখোলা! সেখানে অন্ধকার রাতের রাস্তা, বাতাস বইছে। অরিন্দম গেটের দিকে দৌড় দিচ্ছিল। তার শরীর বিধ্বস্ত, মাথা ঝিমঝিম করছে, রক্তাক্ত হাত ধরে দৌড়চ্ছে সে। আর মাত্র কয়েক কদম! হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যাবে! কিন্তু ঠিক তখনই অরিন্দম আচমকা অনুভব করল, তার শরীরটা থমকে গিয়েছে! একটা ভয়ঙ্কর শক্তি তাকে পিছন থেকে টেনে ধরল! সে ছটফট করে উঠল, কিন্তু কোন লাভ নেই! হাত-পা নাড়ানোর শক্তিটুকুও নেই যেন! চারপাশটা ঘোলা হয়ে যাচ্ছে, তার কানের কাছে কেউ যেন ফিসফিস করে বলছে—
“শশশশ… তুমি কোথাও যাচ্ছ না।”
তারপর… একটা তীব্র যন্ত্রণা! মাথার পিছনে প্রচণ্ড আঘাত! চোখ ঝাপসা হয়ে এল অরিন্দমের। একটা হুইল চেয়ারে বসিয়ে তাকে কারা যেন ধীরে ধীরে মেইন গেট থেকে দূরে নিয়ে যাচ্ছে। চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে গেল…
কতক্ষণ কেটে গিয়েছে, কে জানে? অরিন্দমের চোখ ধীরে ধীরে খুলল। তার কপাল ঠাণ্ডা ভেজা কিছুতে ঠেকে আছে। চারপাশটা কেমন যেন পচা গন্ধে ভরা। তার মাথা ঝিমঝিম করছে। সে ধীরে ধীরে উঠতে চাইল, কিন্তু হাত-পা যেন ভারী হয়ে গিয়েছে। তখনই চারপাশে তাকিয়ে দেখল— সে এখন একটা ছোট্ট ভেজা সেলে বন্দী! চারপাশে অসংখ্য লোহার শিকল ঝুলছে, মেঝেতে পচা জল জমে আছে। সামনে এক বিশাল হলঘর, আর তার ওপারে আরও শত শত জেলখানা! ঠিক তখনই একজন রোগা, হাড় জিরজিরে পাগল ছুটে এসে তার দরজা খুলে দিল! সে হাঁপাচ্ছে, তার চোখ রক্তবর্ণ, পুরো শরীর ক্ষতবিক্ষত! সে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল—
“পালাও! পালাও! সে আসছে!”
তারপর চিৎকার করতে করতে ছুটে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল! তার চিৎকার ধীরে ধীরে হারিয়ে গেল করিডরের অন্ধকারে—
“সে আসছে! সে আসছে!”
অরিন্দমের দেহ শিউরে উঠল। কে সে? সে কি সেই দানব? চারপাশে নিঃস্তব্ধতা। কিন্তু মৃদু, ভারী পায়ের শব্দ ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে! অরিন্দম বুঝতে পারল— এই হাসপাতালের নরকের খেলা এখনও শেষ হয়নি! একটা বিকট শব্দ, চারপাশে অন্ধকার, তীব্র ব্যথা—তারপর সবকিছু নিঃস্তব্ধ হয়ে গেল।
লেখক পরিচিতি : অভি সেখ
সঙ্গীতচর্চা করতে ভালবাসেন। গান লেখা, তার সুর দেওয়া, এবং নিজে গাওয়া এর মধ্যেই মনের তৃপ্তি খুঁজে পান। এর সাথে রং-তুলির সাথে নির্জীব কাগজের প্রেক্ষাপটে প্রাণসঞ্চার করার মধ্যেও আনন্দ খুঁজে পান।