গৌ গাবৌ গাবঃ

লেখক : সর্ব্বোত্তম বন্দ্যোপাধ্যায়

আজ কাল প্রাথমিক ইস্কুলের ছাত্র ছাত্রীদের আর গরুর রচনা লিখতে হয় কিনা জানি না, আমাদের সময় হত। পাঠ্যক্রমে রচনার বিষয় ছিল হাতেগোনা কিছু, উৎসব মানে দূর্গাপূজা, মেলা বলতে রথ ও চরক, কাল বলতে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, শীত ও বসন্ত, হেমন্ত নিয়ে কখনো রচনা লিখেছি বলে মনে পড়ে না, ভ্রমণ হল রেলগাড়ী, আর গৃহপালিত পশু বলতে বিড়াল, কুকুর আর গরু। সাহিত্য অনুরাগী ছাত্র ছাত্রীদের বিষয়ের ব্যাপ্তি একটু বেশি ছিলো বৈকি, বাদবাকিদের তালিকা মোটামুটি ওই, থোড় বড়ি খাড়া, আর খাড়া বড়ি থোড়।

সীমিত বিষয় সূচী অনেক সময় বিপত্তির কারণ হয়ে উঠত। একবার শুনেছিলাম এক ছাত্র নাকি মায়ের রচনায়, মায়ের দুটি চোখ, দুটি কানের সাথে একটি ল্যাজও জুড়ে দিয়েছিলো। ছাত্রটি আর কি কি লিখেছিলো, তা আমার জানা নেই। ঘটনাটির কাল্পনিক হওয়ার সম্ভবনা কিছু কম নয়, হতে পারে কোনো উর্বর মস্তিকের সৃষ্টি। যাই হোক, ঘটনাটিতে যে গরুর রচনার একটা ইঙ্গিত আছে তা মোটামুটি স্পষ্ট। যুক্তিবাদী মন প্রতিবাদী সুরে বলতেই পারে, এটা অন্য যে কোনো পশুর রচনার প্রভাবও হতে পারে। হতেই পারে কিন্তু তার সম্ভবনা বড়ই ক্ষীণ। একে ওই হাতে গোনা কয়টি বিষয়, আর তারপর গরু হল গিয়ে গোমাতা।

গোমাতা, তার মানে এরে বাছুর আমাদের ভাই, আর বকনা বাছুর আমাদের বোন। এই ভাই আবার কিছুদিন পরে হয়ে যায় ধর্মের ষাড় বা কলুর বলদ আর বোন হয়ে যায় গোমাতা। বড়োই গোলমেলে সম্পর্ক। দিন কাল যা পড়েছে, গোলমেলে না বলে, সার্বজনীন বলাই ভালো। এমন সার্বজনীন সম্পর্ক আমাদের অনেকই আছে, যেমন চাঁদমামা, বাপু, চাচা নেহেরু, মোদী কাকা, দাদা, দিদি ইত্যাদি। কি করে যে এই সম্পর্কগুলো সৃষ্টি হয়েছে, তা আমার জানা নেই, ইতিহাসবিদরা হয়তো এর উত্তর দিতে পারেন। যাই হোক গরুদের মনে হয় এই সব সম্পর্ক নিয়ে কোনো মাথা ব্যাথা নেই। আচ্ছা, গরুকে আমরা গোমাতা বলি কেন? গরুর দুধ পান করি বলে? তা আমরাতো ছাগলের, মোষের, উঠের, অনেকেরই দুধ পান করি, এমন কি সোয়াবীনেরও, কই, তাদেরতো মাতৃতুল্য ভাবি না।  

গরুর রচনায়, গরুর উপকারিতা বলে একটা অংশ থাকতো, যাতে প্রধানত উল্লেখিত থাকত গরুর দুধের উপকারিতা ও ব্যবহার। গরুর হাড়, শিঙ, চামড়ার উল্লেখও থাকত, কিন্তু বড়োই সীমিত, তার কারণ মনে হয় সেই ব্যবহার গুলি গরুর ইহকাল ত্যাগ করার পরেই বস্তুত সম্ভব, আমাদের সন্তানতুল্য মনোভাব তাতে বোধহয় পীড়িত হয়। এখন তো আবার গৌরক্ষক সমিতি আছে, তারা গরুর পরকালের ব্যাপারে বড়োই সংবেদনশীল। গোহত্যার খবর পেলে তারা ধুন্ধুমার কান্ড ঘটিয়ে ফেলে, আইন শৃঙ্খলা নিজেদের হাতে তুলে নিতে, এমনকি আইনরক্ষকদেরও পরলোকে পাঠাতে পিছপা হয় না। একি গরুপ্রীতি নাকি রাজনীতি?

গরুপ্রীতি ভাবতে সংশয় হয়। সত্যি যদি শ্রদ্ধা, প্রীতি ও ভালোবাসা থাকতো তাহলে কি এই সব তথাকথিত গৌরক্ষক ও গোসন্তানেরা গরুর প্রতি অত্যাচার মেনে নিত? গরুর প্রতি অত্যাচার? একি সম্ভব? এন্টেনায় বসা কাকের দিকে তাকিয়ে অবাক হওয়ার মতো কিছু নেই। অত্যাচারকে অত্যাচার না ভেবে অধিকার ভাবলেই আর কোনো অসুবিধে নেই। আমরা আমাদের সুবিধা মতো ঠিক করে নিই, কোনটা অত্যাচার, কোনটা অধিকার আর কোনটা অপরাধ। গোমাংস ভক্ষণ করাটা অপরাধ কিন্তু গরুর দুধ তার বাছুরটিকে পান করতে না দিয়ে যে নিজেরা ভক্ষণ করছি, সেটা অধিকার। মাতৃদুগ্ধে বায়োলজিক্যাল সন্তানের অধিকার নেই, অধিকার মানব সন্তানদের। আশ্চৰ্য বিধান। শিব ঠাকুরের একুশে আইনের থেকেও বিচিত্র।

গোমাতা বলা বা না বলা, অধিকাংশ মানুষই গরুর দুধ পান করছেন বা গরুর দুধ দিয়ে তৈরী কিছু ভক্ষণ বা অন্য কোনোভাবে ব্যবহার করছেন। যজ্ঞে ঘি ঢালছেন, মাথায় ঘোল ঢালছেন, রসগোল্লা, সন্দেশ, দরবেশ এর আস্বাদে তৃপ্ত হচ্ছেন। কিন্তু কখনো কি মনে হয়েছে যে এটা অত্যাচারের ফলাফল? তা যদি মনে না হয়ে থাকে, তার কারণ হয়তো অজ্ঞতা বা আপেক্ষিক দৃষ্টিভঙ্গি। আমরা কি প্রতিবাদ না করে মেনে নেবো, যদি দেখি একটা মানব শিশুর মুখের খাবার কেউ কেড়ে নিচ্ছে, নিজের রসনা তৃপ্তির জন্য? তাহলে কিভাবে আমাদের মনে কোনো প্রতিবাদ জন্মায় না যখন একটা বাছুরকে তার হকের খাদ্য থেকে বঞ্চিত করে তা মানব জাতির ভোগের জন্য সংগৃহিত করা হয়? একটি মানব শিশুকে যদি তার মাতৃদুগ্ধ থেকে বঞ্চিত করা অভাবনীয় অপরাধ হয়, তবে একটি বাছুরের ক্ষেত্রে কেন সেটাই বাস্তব? 

অধিকাংশক্ষেত্রে বাছুরের উৎপত্তিও অত্যাচারের কারণে। জোর করে একটি গরুকে গর্ভবতী করা হয়। সম্ভব হলে প্রত্যেক বছর। গরুর ইচ্ছা অনিচ্ছার কোনো বালাই নেই। তর্কালঙ্কারবাবু হয়তো বলবেন কুকুরের বেলায় ভাদ্রমাস আর গরুর বেলায় সর্বনাশ! আদতে কি তাই নয়? একটি ঐচ্ছিক আর একটি জবরদস্তি।

বাণিজ্যিক গোশালায় গরুদের অবস্থা আরও খারাপ, অত্যাচার-এর শেষ নেই। ইনজেকশন দিয়ে গরুর দুধের উৎপাদন বাড়ানো হয়। যান্ত্রিক সাহায্যে, দিনে কমপক্ষে চার বার দুধ দোহন করা হয়। অত্যাধিক দোহনের ফলে গরুর বাট ফেটে অসহ্য পীড়ার কারন হয়ে ওঠে। সেখানকার একটি গরুর জীবনকাল বছর পাঁচ, তার বেশি নয়। এরপর এই গরুদের স্থান বাণিজ্যিক কসাইখানা, সেখানে উহার ইহকাল আর মাত্র অল্প কিছু দিনের। অত্যাচারে জীবন শুরু, অত্যাচারেই শেষ।

আমাদের ঠিক বেঠিক সবই আপেক্ষিক, ক্ষেত্র বিশেষ। একটি আচরণ যা এক ক্ষেত্রে অত্যাচার, অন্য ক্ষেত্রে সেটাই অধিকার। তাই হয়তো সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।


লেখক পরিচিতি : সর্ব্বোত্তম বন্দ্যোপাধ্যায়
অং বং চং

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

4 Comments

    • সর্ব্বোত্তম বন্দ্যোপাধ্যায়

      অনেক অনেক ধন্যবাদ অরণ, লেখাটি পড়ার জন্য ও আপনার মন্তব্য জানানোর জন্য

  1. প্রমিত রায়

    এটি খুবই যুক্তি ও ন্যায়সঙ্গত লেখা। আমি পূর্ণমতে সমর্থন করি যে গরু বা কোনো পশুর উপরেই এহেনো অত্যাচার করার আমাদের কোনো অধিকার নেই। এক কালে মনে হত যে যারা লাক্টোজ ইন্টলারেন্ট তারা কতই দুর্ভাগা কিন্তু পরে বুঝতে শিখেছি যে তারাই আদর্শ। সৌভাগ্য বসত আমাদের সামনে এখন অনেক উদ্ভিদ-ভিত্তিক বিকল্প আছে। আশা করি এই লেখা অনেক যুক্তিবাদী মানুষের সামনে আসবে ও এই চেতনা ছড়িয়ে পড়বে।

    • সর্ব্বোত্তম বন্দ্যোপাধ্যায়

      অনেক অনেক ধন্যবাদ প্রমিত, লেখাটি পড়ার জন্য এবং যথাযত মন্তব্য প্রকাশ করার জন্য।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।