ঈশ্বরের ইতিবৃত্ত : ঈশ্বরের একাকিত্ব

লেখক: রুবাই শুভজিৎ ঘোষ

ঈশ্বর নিয়ে আমার আগ্রহ সেই ছোট থেকেই। আমি ঈশ্বরে বিশ্বাসী হলেও ঠিক যেভাবে ধর্মরক্ষকেরা ঈশ্বরকে ব্যাখা করে, তার সাথে আমি সহমত নই। আমার মতে তিনি বিজ্ঞানেও আছেন, নির্বোধের মধ্যেও আছেন। তাঁকে যেমন আমি ব্যাখ্যা করি নিজের মত করে, আমি তাঁকে খুঁজিও নিজের মত করে, আবার তাঁকে নিয়ে আবার অভিযোগগুলোও নিজের মত করে। তাঁকে নিয়ে আমার চিন্তাভাবনা গুলোই এখানে তুলে ধরছি “ঈশ্বরের ইতিবৃত্ত” লেখায়। এই লেখাতে আমি ঈশ্বরের একাকিত্ব এবং মানবজীবনে তার প্রভাব নিয়ে কথা বলব।

ঈশ্বরের একাকিত্ব নিয়ে বলবার জন্য নিজের লেখা একটা কবিতা আপনাদের সাথে শেয়ার করে নিতে চাই। ঈশ্বরের একাকিত্ব এই ধারণার ওপরেই ২০০৯ সালে এই কবিতাটা লিখেছিলাম।

।। একা ।।

কাল সুনামি এসেছিল –
ওদের নিয়ে গেছে ডেকে –
বাকিরা বোধহয় তোমায় ডাকছিল দূর থেকে –

প্রায় পাঁচযুগ আগে –
দুটো নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণে –
বিচ্ছিন্নতার বিক্রিয়া ঘটেছিল আমার দেহমনে –

তাই আমি একা –
আর ওরাও বোধহয় –
আর তোমার একাকিত্ব তো কখনও ঘোচবার নয় –

ভগবান তোমার এই স্ক্রিপ্ট –
দরকার নেই কোনও –
আমি তোমার সাথ দিতে পারি কিন্তু এখনও –

এই কবিতাটার ধারণা আমার আসে ঈশ্বরের ব্যাপারে মানুষের প্রচলিত একটা ধারণা থেকে। ছোটবেলায় আমায় কেউ একজন বলেছিল নিজের ভালো কাজের জন্য ক্রেডিট নেওয়া উচিত না, কারণ আমি কাজটা করিনি, ঈশ্বরই নাকি আমায় দিয়ে করিয়েছেন। তখন সেই বয়োজ্যেষ্ঠকে জিজ্ঞেস করে একটা প্রচলিত ধারণার সাথে পরিচিত হই যে আমরা যাই করি না কেন, তা ঈশ্বরই আমাদের দিয়ে করান। এক্ষেত্রে যাই করি না বলতে আমি কিন্তু ভালো মন্দ সব কাজকেই বুঝেছিলাম। কিন্তু আমার মনে প্রশ্ন এসেছিল খারাপ কাজগুলো ঈশ্বর করাবে কেন? অনেক ভেবেছিলাম। অনেককে জিজ্ঞেসও করেছিলাম। কিন্তু মনের মত জবাব পেলাম না। বরং এসব প্রশ্নের কারণে ধমক পেয়েছিলাম অনেক। তারপর একদিন খেয়াল হল ঈশ্বর বিষয়ক অন্য একটি বিশ্বাস বা ধারণার মধ্যেই লুকিয়ে আছে এর উত্তর। যদিও এই বিশ্বাসটা অনেকদিন আগে থেকেই জানতাম। কিন্তু হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করি (বা বলা ভালো ঈশ্বর আমার মাথায় এই উত্তরটা ভরে দেয়) আমার প্রশ্নের উত্তর। কী সেই বিশ্বাস বা ধারণা ?

ধারণাটা হল ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়। তার মানেই কিন্তু তিনি একা অর্থাৎ সঙ্গীহীন। আর একমাত্র সঙ্গীহীন মানুষই জানে সঙ্গীহীন হওয়ার দুঃখ। প্রতি মুহূর্তে নিঃসঙ্গতা বা একাকিত্ব সেই মানুষটিকে কুরে কুরে খায়। বিশেষ করে বয়স্ক মানুষদের এটা একটা অন্যতম প্রধান সমস্যা। বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানুষেরা তাদের বন্ধুদের থেকে আলাদা হতে শুরু করে বা বন্ধুদের হারাতে শুরু করে। তখন তাদের পক্ষে নতুন বন্ধুত্বও শুরু করা কঠিন । কারণ অবশ্যই জেনারেশন গ্যাপ। তাদের মানসিক অবস্থাটা বুঝতে পারলেই ঈশ্বরের একাকিত্ব কিছুটা হলেও বুঝতে পারবেন। মানুষ তো মোটামুটি জীবনের শেষের কিছু বছর সঙ্গীহীন থাকতে পারে। ঈশ্বরের ক্ষেত্রে ভাবুন তো! অনন্তকাল ধরে তিনি একা। অবশ্য আমরা অনন্তকাল ভাবলেও হতেই পারে ঈশ্বরের আয়ুও আমাদের মতই। শুধু আমাদের দুজনের সময়কালের সংজ্ঞা আলাদা। এটা সম্ভব হবে যদি তিনি ব্ল্যাকহোলে বা তার কাছাকাছি থাকেন। এই নিয়ে আমি আগেই লিখেছি এবং পাঠক চাইলে এখানে পড়তে পারেন। তবে তাঁর আয়ু আমাদের মত একশবছরই হোক বা অনন্তকালই হোক তিনি একাই। এবং এই একাকিত্ব তাঁর সারাজীবন জুড়ে।

এবং আমার ধারণা ঈশ্বর তাঁর একাকিত্ব দূর করতে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন সবসময়। এই জন্যই দরকার আমাদের। আমরা পুরোটাই তাঁর ইচ্ছেতেই চলি। ভালো কাজ খারাপ কাজ সব তাঁর ইচ্ছেতেই হয়। ভালো কাজ করলে তাঁকে ধন্যবাদ জানাই; সকলে না জানালেও প্রচুর মানুষ জানায়। আবার কেউ খারাপ কাজ করলে তাতে যদি কারও ক্ষতি হয় সে নিজেকে বাঁচাতে ঈশ্বরকে স্মরণ করে। শুধু নিজেকে বাঁচাতেই কেন, ছোটোখাটো বিপদ থেকে শুরু করে বড় সড় সব বিপদেই তাঁকে আমরা স্মরণ করি। পরীক্ষার রেজাল্ট বেরনোর আগে ছাত্রছাত্রীরা তাঁকে স্মরণ করে, চাকরির পরীক্ষা দিতে যাওয়ার আগে চাকুরীপ্রার্থীরা তাঁকে স্মরণ করে, কেউ শারীরিকভাবে কোন সমস্যায় ভুগলে মুক্তি পেতে তাঁকে স্মরণ করে আবার কিছু ডাক্তারকেও দেখেছি অপারেশনে যাওয়ার আগে আত্মীয়কে বলে তারা যেন তাঁকে স্মরণ করে। এভাবে আমাদের সমস্যা এবং সেগুলো সমাধানের মধ্যেই ঈশ্বর ব্যস্ত থাকেন। আর এভাবেই কেটে যায় ঈশ্বরের একাকিত্ব ।


শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।