আমি শুধু ভালোবাসা নই

কবি: গৌতম চট্টোপাধ্যায়

অতিনীল পৃথিবীহীন গূঢ়তায় ডুবে আছি আমি–
আমি পাখী নই, নই সক্রেটিস, ব্রাউনিং কিম্বা
নব্বই’এর সাহিত্য-নোবল্ অক্টোভিও পাজ–,
আমি কুলগামে গুম-খুন;
আমি সন্ত্রস্ত সুন্দর কাশ্মীরের অলিতে গলিতে
আর দন্তেবাড়ার নকশালীতে ঘেরা ঘন জঙ্গল;
বা সেনার নিঃশব্দ প্রতিশোধের
বিনিদ্র শীত-পদচারণা !
আমি তারুণ্যের মধ্যিখানে
রুক্ষ উৎকন্ঠ চুল কড়া-ঘাম!
আমার সৌরভ নেই–, পৌরুষত্ববোধ?
তাও বুঝি নেই!
আমার ভালোবাসা রক্ত, সিগারেট,
মেয়েদের শরীরী-গন্ধ আর মদের নেশালাগা
রঙীন পানীয় বা অবৈধ সঙ্গম-সুখ!
মাতাল করেছে বিষণ্ণতা!
হায়! আমার কাছে ভালোবাসা
তোমার কাছে জল!
জলের দাগ মুছে যায় –কিন্তু কেন?
কেন আমার সকাল শিথিল?
দুপুর কেন হয় না উদ্দাম !
বা আমার বিকেল সোনালী!
কেন আমার স্বপ্নিল রাতের
সব দরজা জানালা বন্ধ!
গুমঘর বিশ্রী গন্ধ!
আমি পাখী নই, নই পাবলো নেরুদা বা লরেন্স,
নই আমি “মেয়েদের মন জয় করা যায় কী করে”
শীর্ষক লেখার ডেল কার্নেগী!
স্বপ্নবাসবদত্তা, কোয়ান্টম থিয়োরী বা
রাগপটদীপ ইত্যাদি !
আমি স্বপ্নে চেঁচিয়ে বলি না
হায়রে হায় ফ্লামেনকো–
ডাকি না সেভিল, কাদিজ, করদোবা’কে!
আমি ঘুম বিছানায় লাফিয়ে উঠি–
চিৎকার করে ডাকি–
হায়রে হায় “ইয়েমন ইয়েমন”,
আমি পাঁজর গোনা ছেলের মুখে
ছিবড়ে দুধহীন স্তন!
আর আমি একমুঠি শুভ্রতার মাঝে
ঘুরপাক খাওয়া হাওয়া নই!
কিম্বা শায়ার মাঝে ঘূর্ণিস্রোত তুলে
হেঁটে যাওয়া দুটি পা!
বেশ্যাদের লালচে ফ্যাকাশে হাই;
অন্ধজনের শীর্ণ হাত;
অসহায় গরীব শিশুর আদুল শরীর!
অপরিচিত, অপেক্ষারত বাসী-বাস-যাত্রীদের
দিকে বাড়ানো এক কাপ গরম চা’এর নোংরা হাত!
আমি এ সমাজে বর্হিভূত!
আমার শরৎচন্দ্র হওয়ার কোন মানসিকতা নেই!
আমি মাতালের খিস্তি–
আমি নিরক্ষরীয় মিস্ত্রি —
আমি সোনাগাছি-কালীঘাটের অসহায় নারীদের
বেঁচে থাকার অদম্য ইচ্ছে!
বিস্রস্ত মানসিক অবস্থার মধ্যেও
পঞ্চাশ টাকা হাতে পাওয়া হো-হো হাসি উদ্দাম!
আমি চিত্রকল্পে ভাসন্ত থাকার চেয়ে
অনেক গহন অ্যালকেমির ফল!
আমি উদ্ধত নই তবু অতিচারী-
বিকৃত তবু সৌন্দর্য্যোপাসক-
আমি আড়ম্বর, অতীক্ষ্ণ, অবিদ্বিষ্ট-
আমি চপল তবু অবসন্ন, বিমর্ষ,
একটু জটিল, স্বপ্নপর একটু আমি
স্বল্প ভালোবাসাতে হর্ষ!
আমি প্রেমিকার কাছে দূরত্বপরায়ণ
মমতা আর ভালোবাসায়!
আমি উচ্চকিত–সমারোহপূর্ণ-
দ্রুতস্পন্দিত– তবু তরঙ্গসঙ্কুল!
আমি স্নেহ তবু নিঃসঙ্গতা
আমি নিষ্প্রভ ভালোবাসা!
আমি অভিমান, আমি অপমান
আমি ছোট সামান্য দৃশ্য!
আমি নিরুচ্ছাস স্নিগ্ধতা, অপ্রকটতা,
আমি অনাত্মীয়ের আত্মীয়তা–
আমি স্পষ্ট, ভিজে, আচম্বিত একটু
লঘু নাগরিক গদ্য–,
আমি বিহারীর লিট্টির ধিকধিক আগুনের তাপে
আটার পেটে ভরা ছাতু-মশলার ঢুঁ-মারা
ছটপট করা পদ্য!
আমি অসহায় -চিৎকার অক্ষম-সিরিয়া’র
অন্ধকার ছাতে, পথে–, বাতাসহীন-দুর্দশার মিশাইলের আলোয় আলোকিত
অথচ কালো ইরাকের রাতে–,
আমি চন্দ্রাতপের নীচে চা খেতে খেতে
ট্রাম্প-মোদী’র হুস্টন সম্মেলনে শরীক–
আর আমার ছোট্ট গাঁয়ের চার দেয়ালের
পলেস্তরা খসা ইঁট!
আমি এক রাতেই বড় হওয়া
মৃত রফিকুলের মেয়ে ফিরোজা–
ওরা মরে গেছে–তাই শেষ হয়ে গেছে পদ্য!
আমি সার্কাসের এরিনায়, নৈশ ক্যাবারে হাউসে-
ট্যারিফিক জ্যাম থেকে বেরিয়ে এসেছি সদ্য!
আমি আত্মনিয়ন্ত্রণহীনতার প্রতীক!
অনিশ্চিতে বিলুপ্ত হবার প্রতীক!
আমি ভেন্ট্রিলোকুইষ্টের পুতুলের স্মারক–
ইরাকের অস্ত্র-প্রর্দশনী সম্মেলনে
“বুল” এর সুপারগানের একমিটার চওড়া হাঁ-মুখ!
আমি মাথার ওপর ভ্রষ্টরজনীর ঘাতক-কালপুরুষ!
আমি মুণ্ডুহীন -তমস্বিনী,স্বপ্নগর্ভনম্রতা–
প্রোষিতভর্তৃিকার গর্ভের ক্রুর-বধিরতা!
আমি তাত্বিক, আমি উদ্ভট তার্কিক–
আমি ভালোবাসার কাঙাল
এ সমাজে অসামাজিক !
আমি গম্ভীর হাসপাতালের বিষণ্ণ-ওয়ার্ডের রক্ত —
আমি মহারাষ্ট্রে সরকার টানাপোড়েন!
ঈশ্বর-আল্লা আমি অযোধ্যা থেকে পলায়নরত!
সকালের চা-কাগজে ছড়ানো-ছেটানো রক্ত!
আমি খাদ্য-আন্দোলনে শরীক
সত্তরের হাজার ছেলের লাশ-ঘরের
প্রতিটি কঙ্কাল-ইঁট!
আমি অহিংস স্রষ্টার মাথায় লাথি-মারা
উচ্ছৃঙ্খল -হিংসা–
বা বাগদাদির গুহায় ম্যালিনওয়া কুকুর’এর চোখে-জ্বলা জিঘাংসা!
তবু আমি পরাধীন এ স্বাধীন দেশে
মাতাল এক্সচেঞ্জ বা ছাঁটাই কর্মচারী বেশে–
আমি ধাওয়া করা নিঃশব্দ বির্পযয় আর
মেকী গণতন্ত্রে মোড়া ভারতবর্ষ —
আমি হাসবো না, হাসিও না আর
তোমরা যত খুশী হাসো–!
আমি টি.এন.টি বম মেগাটনে
বাল্টিকের জ্বলন্ত আগুনে
অভিনন্দন শৌর্য বীর-গাথা —
আমি রোমে রোমে রাম এর
এক অবিস্মরণীয় ভারতবর্ষ !
আমি শুধু ভালোবাসা নই!
এক রঙীন ফানুষ, উবে যাওয়া ঈথার তরঙ্গ!


ছবি: প্রণবশ্রী হাজরা


লেখকের কথা: গৌতম চট্টোপাধ্যায়

কবিতা লেখা শুরু সেই ১৯৮৫ সাল থেকে। কলেজ পত্রিকায়। পরে দেশ বিদেশের বহু বিখ্যাত পত্র পত্রিকায় লেখা। পত্রিকা সম্পাদনা দীর্ঘ এগারো বছর। এরই মাঝে কোলকাতা বইমেলায় বের হয় পরপর দুটি কবিতা সংকলন। ঊনবিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ কবিতায় দু’ দু’বার বিখ্যাত মনীষীদের মাঝে ওনারও লেখা স্থান গ্রহণ করে নেয় নিজ দক্ষতায়। তৃতীয় কবিতা সংকলন, “সময়, ভালোবাসায় নেই নীলাঞ্জনা” যন্ত্রস্থ।

One comment

  1. Probir

    I have read the poem twice. It has that attractiveness but , in the end , rather empty. Not vessel but cranium. Absolutely condemnable actually. Poet may be jailed for wasting my time. Still wish him the best. Create intrigue.

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।