নানা রূপে ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়

লেখক: অয়ন মৈত্র

ডাঃ বিধান চন্দ্র রায় বলতেই আমাদের চোখের সামনে সদা হাস্যময় এক ব্যক্তির ছবি ভেসে ওঠে যিনি একাধারে পশ্চিমবঙ্গের রূপকার এবং অসামান্য প্রায় ঐশ্বরিক ক্ষমতা সম্পন্ন এক চিকিৎসক। একটা সমগ্র দিনে আকাশে যেমন আলো ছায়ার বিভিন্ন রূপান্তর চলে, তেমনি একটি জীবনে প্রতিটি মানুষেরই চেনা পরিচয়ের বাইরে কিছু অচেনা পরিচয় থাকে। ডাঃ বিধান চন্দ্র রায় সম্পর্কে এখানে তেমনই কিছু জানা অজানা তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করলাম। 

ডাক্তার বিধান রায় বা প্রশাসক বিধান রায় সম্পর্কে যত কিংবদন্তি ছড়িয়ে আছে তুলনায় তাঁর অসামান্য রসবোধ সম্পর্কে সিকিভাগ আলোচনাও দেখা যায় না। মানুষটির আপাত গাম্ভীর্যের আড়ালে যে অনবদ্য রসবোধ সম্পন্ন একটি ব্যক্তি লুকিয়ে তা ওনাকে দেখে বোঝা যেত না। কেবল মেঘ না চাইতেই জলের মত মাঝে মাঝে সেগুলো বেরিয়ে আসত। এখানে সেগুলিই তুলে ধরা হল।
শোনা যায় ডাক্তার রায় মজার ছলে তাঁর পেশেন্টদের বলতেন :
– অসুখ হলে অবশ্যই দেরি না করে ডাক্তার দেখাবেন কারণ ডাক্তারদের তো বাঁচতে হবে !
– ডাক্তাররা যে ওষুধ লিখে দেবেন তা অবশ্যই কিনবেন কারণ দোকানদারদেরও তো বাঁচতে হবে !
– ওষুধ কিনে বাড়ি ঢুকেই ওগুলো অব্যশই ফেলে দেবেন কারণ আপনাকেও তো বাঁচতে হবে ! এটা শুনে চেম্বারের সমস্ত রোগীরাই হেসে উঠতেন! 

বিধান রায় মনে করতেন রোগ সারাতে হাসি খুব জরুরি। কঠিন অসুখেও রোগীর মনকে হালকা করতে হাসি রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা অনেক গুন বাড়িয়ে তোলে। তাঁর মতে আমাদের বেশির ভাগ অসুখই সত্তর শতাংশ শারীরিক আর ত্রিশ শতাংশ মানসিক !

গান্ধীজির সঙ্গে ডাঃ রায়ের অত্যন্ত সুসম্পর্ক ছিল। দুজনের প্রথম আলাপ হয় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের বাড়িতে।  ১৯৪৩ সাল। দীর্ঘ অনশন করে অসুস্থ মহাত্মা গান্ধী রয়েছেন পুনার আগা খান প্যালেসে। অবস্থা অত্যন্ত সংকটজনক। ক্রমাগত বমি হচ্ছে। অবস্থা এতই সংকটজনক যে ইংরেজ সরকার গান্ধীজির শেষকৃত্যের ব্যবস্থা শুরু করে দিয়েছে। এমন সময় ডাক পড়ল বিধান রায়ের। গান্ধীজি আগেই বলে রেখেছেন তাঁকে যেন কোনভাবেই গ্লুকোজ দেওয়া না হয়। তিনি কৃত্রিমভাবে তৈরি কিছুই খাবেন না। বিধান রায় গিয়ে গান্ধীজিকে বোঝান গ্লুকোজ খেতে হবে না আপনাকে। আপনি চার চামচ লেবুর রস খান। লেবু প্রাকৃতিক যেহেতু সুতরাং আপনার খেতে কোন অসুবিধে হবে না। গান্ধীজি অবশেষে রাজি হলেন। লেবুর রস খেতেই বমি বন্ধ হয়ে গেল। শারীরিক অবস্থা ভাল হতে লাগল ক্রমশ।  এরপর এই আগা খান প্যালেসেই থাকাকালীন গান্ধীজি আ্যংকাইলোস্টোমাইসিস রোগে আক্রান্ত হলেন। গান্ধীজি ছুটি কাটাতে পুনে থেকে জুহু চলে গেলেন। বিধান রায় কলকাতা থেকে ছুটলেন আ্যংকাইলোস্টোমাইসিস রোগের সর্বাধুনিক ওষুধটি নিয়ে। নিয়ে তো গেলেন কিন্তু গান্ধীজি তো কিছুতেই খাবেন না। গান্ধীজির আবার অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসার ওপর ভরসা ছিলনা। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করাতেন। তারওপর এই ওষুধটি আবার ভারতে তৈরি নয়। গান্ধীজি বিধান রায়কে বললেন, ‘দেশের ৪০ কোটি দীনদুঃখী মানুষের অসুখে যখন তোমার ওই অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা দিতে পার না, তখন আমিই বা তোমার চিকিৎসা নেব কেন?’
বিধান রায় বললেন, ‘ঠিকই মহাত্মাজি, দেশের ৪০ কোটি মানুষের চিকিৎসা আমি করতে পারিনি। কিন্তু এই ৪০ কোটি মানুষের যিনি আশা ভরসা, ৪০ কোটি পরাধীন মানুষ যাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে, ৪০ কোটি মানুষের দুঃখ লাঘবের ভার যাঁর হাতে, যিনি বেঁচে থাকলে ৪০ কোটি মানুষ নিশ্চিন্ত থাকবে, তাঁর চিকিৎসার ভার সেই ৪০ কোটি মানুষ আমার উপর দিয়েছে।’
গান্ধীজি বললেন, ‘আমি তো অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা কখনও নিই-ই না।’
বিধান রায় বললেন, ‘আচ্ছা মহাত্মাজি, আপনি তো বলেন পৃথিবীর সব কিছু, এমনকী ধূলিকণাটি পর্যন্ত ঈশ্বরের সৃষ্টি, এ কথা কী আপনি সত্যি বিশ্বাস করেন?’
গান্ধী বললেন, ‘নিশ্চয় নিশ্চয়, আমি বিশ্বাস করি সবই ভগবানের সৃষ্টি।’
বিধান রায় বললেন, ‘তা হলে মহাত্মাজি, আমাকে বলুন, অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসাও কি তাঁরই সৃষ্টি?’
এই বার গান্ধী হেসে ফেললেন। বললেন, ‘তুমি তো দেখছি থার্ডক্লাস মফঃস্বল কোর্টের উকিলের মত তর্ক করছ? তুমি ডাক্তার হলে কী ভাবে? দাও কী ওষুধ দেবে, দাও।’
বিধান রায়ের যুক্তির জালে গান্ধীজির মত দুঁদে ব্যারিস্টারও হেরে গেছিলেন।


সাংবাদিকদের একটু এড়িয়েই চলতেন বিধান রায় যতটা সম্ভব। একদিন সরাসরি প্রশ্নের মুখেই পড়ে গেলেন। কথোপকথনটি তুলে দেওয়া হল সরাসরি।
সাংবাদিক: আমরা আপনার কী ক্ষতি করলাম?! না পারি কাছে ঘেঁষতে, না পারি সংবাদ নিতে?!
বিধান রায়: আপনাদের নিয়ে ভয়ের আমার অন্ত নেই। আপনারা দোধারি তলোয়ার।
সা: এই তলোয়ারে আপনার কী ধরনের ভয়?!
বি: জবাব দেওয়ার ভয়।
সা: সে আবার ভয় কী! আপনার জবাব আপনি দেবেন, তাতে আবার ভয় কী! সত্যকে সত্য, মিথ্যাকে মিথ্যা বলে দিলেই হলো!
বি: না, হলো না। আপনাদের প্রশ্নের ধরন-ধারণ বড় উদ্ভট থাকে। একটা উদাহরণ নিন, তাহলেই আমার ভয়ের কারণ বুঝতে পারবেন। আপনারা এমনভাবে প্রশ্ন করেন, ‘হ্যাঁ’ বলাও বিপদ, ‘না’ বলাও। বলা যায়, এটির চেয়ে অন্যটি বড় বিপদ।
সা: যেমন?
বি: যেমন, এই ধরুন- আপনি কি স্ত্রী প্রহার বন্ধ করেছেন? এর জবাবে আমি যদি ‘হ্যাঁ’ বলি, তার অর্থ হবে-আমি আগে পেটাতাম, এখন বন্ধ করেছি। এটি আমার ব্যাপারে কোনো ভালো খবর নয়। যদি আপনাদের প্রশ্নের জবাবে আমি ‘না’ বলি, বুঝতে হবে আমি এখনও স্ত্রী প্রহারের মতো মন্দ কাজ অব্যাহত রেখেছি। যা এমন এক সংবাদ, একজন মুখ্যমন্ত্রীর ব্যাপারে কোনোদিনই কানে তোলার নয়। এবার আপনারাই বলুন, আমি কী করব! আপনাদের তাড়ানোর কথা আমি বলব না, এড়ানো-সরানো ছাড়া আমার কি আর উপায় আছে! বয়সের এই ধাপে প্রহারের জন্য পিঠবিছানো কি আমার পক্ষে সম্ভব! আপনারাই ভেবে বলুন।

আগেই বলেছি গান্ধীজির সঙ্গে বিধান রায়ের দারুণ হৃদ্যতা ছিল। তো একবার গান্ধীজী বিধান বাবুকে বললেন “আপনি যুক্ত প্রদেশের (এখন উত্তরপ্রদেশ) গভর্নরের পদগ্রহণ করতে রাজি হলেন না। আমি ভেবেছিলাম, আপনাকে ‘ইওর এক্সেলেন্সি’ বলে ডাকার সুযোগ পাব। তা আর হতে দিলেন না!”
বিধানবাবুর উত্তরটি এক্ষেত্রে স্মরণীয়, ‘‘আমি আপনাকে আরও ভাল বিকল্প দিতে পারি। আমি পদবীতে রয়, তাই আপনি আমাকে রয়্যাল বলতে পারেন। আর যেহেতু অনেকের চেয়ে লম্বা, সে হেতু আপনি আমাকে রয়্যাল হাইনেস বলতে পারেন! সেটা কিন্তু যথার্থই হবে।”

আরেকটা ঘটনার কথা এখানে উল্লেখ না করলেই নয়। স্যার আশুতোষ মুখুজ্জের ইচ্ছেতে  বিধানবাবু বেঙ্গল কাউন্সিল ভোটে লড়ার জন্য স্যার সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর উল্টোদিকে দাঁড়িয়েছেন। তো নির্বাচনী প্রচারের জন্য পাইকপাড়ায় তিনি একটি ছোট জনসভায় বক্তৃতা রাখছেন, কেন তিনি কাউন্সিলে যেতে চান, হঠাৎ এক যুবক লাফিয়ে উঠে বলে- “ওসব কথা রাখুন দেখি মশাই। আমাদের হরিসভার জন্য কত দিতে পারবেন আগে সেটা বলুন?… সুরেনবাবু কিন্তু দু’হাজার দেবেন বলেছেন!”
বিধানবাবু তাঁর স্বভাবসুলভ একটা হাল্কা হাসি ঠোঁটের কোণায় ঝুলিয়ে অত্যন্ত শান্তভাবে বললেন – “আপনি তো হরিসভাকে নিলামে তুলে দিয়েছেন মশাই! আমি কিন্তু কোন মতেই এটা মেনে নিতে পারবোনা।” বিধানবাবুর এই উত্তর জনসভায় হাসির রোল ফেলে দেয়।

ইংরেজিতে যাকে Ready Wit বলে বিধান রায় সেটার মাষ্টার ছিলেন। মুখ খুললেই তীরের ফলার মত নির্মল বুদ্ধিদীপ্ত কৌতুকে ভরা মন্তব্য বেরিয়ে আসত। মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন যখন সরকারের প্রায় সব কটা দপ্তরই নিজের অধীনে রেখেছিলেন কেবল পরিবহন আর পুলিশটা ছাড়া। মন্ত্রী এবং বিধায়কদের মধ্যে এই নিয়ে চাপা অসন্তোষও ছিল যে সবেতেই উনি মাতব্বরি করেন। বিধানসভার এক অধিবেশনে এক বিধায়ক আর রাগ চেপে না রাখতে পেরে চেঁচিয়ে উঠলেন – “ অর্থদপ্তরের প্রায় পঁয়তাল্লিশ শতাংশ আপনি একাই কন্ট্রোল করেন!”
বিধান বাবু ওনাকে তক্ষুনি থামিয়ে বলে উঠলেন – “আপনি সম্পূর্ণ ভুল তথ্য দিলেন! আমি একশো শতাংশ কন্ট্রোল করি। আর সেটাও অর্থমন্ত্রী হিসেবেই করি।”

একবার একটি সভায় সরোজিনী নাইডুর পাশে বিধান রায় বসে আছেন। সরোজিনী তখন বাংলার রাজ্যপাল। বিধান রায়কে মারাত্মক একটা ইয়র্কার দিলেন – “ডাঃ রায় আপনার তো প্রায় পঞ্চাশ বছর বয়স হয়ে গেল। অথচ এই বয়সেও কিন্তু হাসলে আপনার গালে টোল পড়ে।”  বিধান রায়ের সপাটে ছক্কা – “আপনারও তো পঞ্চাশ হল প্রায়! অথচ এখনও এসব নজর করেন!”

ইংরেজিতে যাকে Pun (পান) বলে বাংলায় সেই Punning এর সম্রাট ধরা হয় শিবরাম চক্রবর্তীকে। অনেকেই জানেননা বিধান রায়ও কিন্তু কিছু কম যেতেননা এই ‘পানিং’ -এ। তাঁর করা পান নিয়ে পানিং -এর একটি গল্প বলা যাক –

বিধান রায়ের মন্ত্রী সভার অন্যতম মন্ত্রী ছিলেন হেমচন্দ্র নস্কর। তাঁর খুব পান খাওয়ার শখ ছিল। তিনি ছিলেন আবার বেলেঘাটার জমিদারবাড়ির ছেলে। রাইটার্সে আসবার সময় প্রচুর পান নিয়ে আসতেন সাথে করে। কি মন্ত্রীসভা কি বিরোধী দল সকলেরই খুব শখ জমিদারবাড়ির পান খাওয়ার। বিধান রায় জানতেন ব্যাপারটা। একদিন পাকড়াও করলেন লবিতে। তারপর সবার সামনে বললেন- হেম, পান দাও, কিন্তু প্রাণ দিও না।

কৌতুকবোধ যেন মজ্জায় মজ্জায় ছিল বিধানবাবুর। একবার হল কি খাদ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেন কিছুতেই স্বীকার করবে না যে খাদ্যাভাবে লোক মারা গিয়েছে। বিধানসভায় তুলকালাম। বিরােধী সদস্যরা তীব্র আক্রমণ করছেন কিন্তু প্রফুল্ল সেন ক্রমাগত বলেই যাচ্ছেন – খাদ্যাভাবে নয়, হার্টফেল করে মারা গেছে। বিধান রায় অনেকক্ষণ ধরে এই তরজা উপভোগ করার পর প্রফুল্ল সেন কে বললেন – প্রফুল্ল এমন ঘটনা তুমি কি কখনো দেখেছ যে কেউ মরেছে কিন্তু হার্ট ফেল করেনি। আরে বাবা আমরা ডাক্তাররা তো জানি যে রোগেই মরুক, মরলে তাকে হার্ট ফেল করেই মরতে হবে।

১৯৫৩ সালে গণনাট্য সঙ্ঘের জমিদার বিরোধী উনষাটটি নাটক সরকার নিষিদ্ধ করে দেয়। এতে বিধান রায়ের খুব একটা সায় ছিল এমন নয়। কিন্তু কংগ্রেসের মধ্যে জোতদার-জমিদার লবি তখন সাংঘাতিক শক্তিশালী, বর্তমানে বিহার, ইউ পি, হরিয়ানা বা রাজস্থানের মতো তাঁদের ক্ষমতা। মণিকুন্তলা সেন বিধান সভায় এই নিয়ে বিতর্ক তোলেন। তর্কা তর্কি শেষ অবধি বিরোধী দলনেতা ও মুখ্যমন্ত্রী পর্যন্ত গড়ায়। জ্যোতি বসু বলেন – আপনি হিটলারের মতো আচরণ করছেন। এর উত্তরে বিধান রায় উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন – হ্যাঁ, হিটলার স্তালিনের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে।

ডাঃ রায় ভীষণভাবে ঈশ্বরবিশ্বাসী ছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন একবার মকর সংক্রান্তিতে গঙ্গাসাগর গেছিলেন স্নান করতে। বিধান সভার অধিবেশন শুরু  হতেই সিপিআই নেতা বঙ্কিম মুখার্জি বিধানবাবুকে খোঁচা মেরে বলেন- মশাই কি গঙ্গাসাগরে সারাজীবনের পাপ রেখে এলেন? বিধান বাবু অনুনকরণীয় ভঙ্গিমায় হাসতে হাসতে বললেন – হ্যাঁ রেখে এলাম। তোমরা মেখে নিও!

রেডি উইট (ready wit), এর সাথে বিধান রায়ের আরেকটি অত্যাশ্চর্য ক্ষমতা ছিল রেডি ইন্টুইশান। অর্থাৎ সাধারণ diagnosis নয়,  prognosis এর ক্ষমতা। রোগীকে দেখেই বা কোনো ক্ষেত্রে রোগীর একটা কাশি কিংবা শারীরিক কোন সামান্য পরিবর্তন যা প্রায় চোখে পড়ার মত নয় তা দেখেই উনি নির্ভুলভাবে বলে দিতে পারতেন কী হয়েছে রোগীর আর এর থেকে কিইবা হতে পারে। বিধান রায়ের এই প্রায় দৈবিক ক্ষমতার জন্য এশিয়া মহাদেশে তো বটেই ইউরোপ আমেরিকা পর্যন্ত তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। ডাক্তারির ছাত্র ছিলেন যখন তখন থেকেই রোগ নির্ণয়ের এই অদ্ভুত ক্ষমতার প্রকাশ ঘটতে থাকে। কলকাতা হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি ভগবতী প্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় সেরকমই একটি ঘটনার বর্ণণা দিয়েছিলেন একবার বর্তমান পত্রিকায়। বর্ণনাটি এখানে হুবহু তুলে দিলাম –
“একটা ঘটনা মনে পড়ছে। নার্স একজন রােগীকে ট্রলিতে করে নিয়ে যাচ্ছিলেন। বিধানবাবু এমনি কথার ছলেই জিজ্ঞাসা করলেন, এনাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? নার্স জানান, অপারেশন হবে। কী অপারেশন, কে করবেন, সবই নার্সকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন তিনি। সেই মেডিকেল কলেজের সার্জারি বিভাগের প্রধান তথা নামজাদা জনৈক শল্য চিকিৎসকের সেই অপারেশন করার কথা ছিল। কী অপারেশন এবং শরীরের কোন স্থানে হবে, তাও বিধানবাবুকে বললেন নার্স। সব শুনে ডাঃ রায় আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, বােধহয় শরীরের ঠিক জায়গায় অপারেশনটা হচ্ছে না! যেখানে করতে হবে, সেটাও বললেন নার্সকে। আর জানিয়ে দিলেন, সার্জনকে আমার নাম করেই না হয় আপনি বলবেন! নার্স গিয়ে সেটা ভয়ে ভয়ে বিভাগীয় প্রধানকে বললেন। একথা শুনে তাে সেই চিকিৎসক রেগেমেগে লাল। নার্সকে ধমকে জিজ্ঞাসা করলেন, কে এসব বলেছে আপনাকে?’ নার্স কাঁচুমাচু মুখে উত্তর দিলেন, ‘ডাঃ রায়। এবার আরও কড়া প্রশ্ন, ‘কে এই ডাঃ রায়?’ ততোধিক মৃদু গলায় উত্তর এল, ‘এখানে ডাক্তারির ছাত্র।’
উত্তর শুনে অগ্নিশর্মা হয়ে সার্জন বললেন, ‘ঠিক আছে দেখি তারে, কে এই ছােকরা। কীভাবে আমার ভুল ধরে!’


নিজের মতাে অস্ত্রোপচার শুরু করলেন চিকিৎসক এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারলেন, কোথাও ভুল হচ্ছে। কি যেন ভেবে এবার বিধানবাবুর পরামর্শটা মানলেন। সেই অনুযায়ী অপারেশন করে দেখলেন, বিধানবাবুরটাই ঠিক পদ্ধতি এবং রােগীর জন্য উপযুক্ত। অপারেশন শেষে বেশ কিছুক্ষণ গুম মেরে থাকলেন তিনি। নার্সকে বললেন, ‘ডাঃ রায়কে ডেকে পাঠান।’ তলব শুনে বিধানবাবুও হন্তদন্ত হয়ে সেই সার্জনের কাছে গেলেন। সার্জন তাঁকে প্রথমেই প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি কি এই রোগীকে আগে পরীক্ষা করেছিলেন?’ বিধানবাবু ঘাড় নাড়ালেন, না করেননি। পরের প্রশ্ন ছিল খুবই প্রত্যাশিত, ‘তাহলে আপনি কীভাবে জানলেন কোন অপারেশন তাঁর পক্ষে ঠিক হবে?’ সার্জনকে চমকে দিয়ে বিধানবাবুর উত্তর ছিল, ‘এটা আমি আমার intuition থেকে বলেছি।’ এই ঘটনার পর অধ্যাপক মহলে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ল।

বিধানবাবুর এই ইনটুইশন একটা সময়ে প্রবাদে পৌঁছে গেছিল। মানুষ তাঁকে আধুনিক ধ্বন্বন্তরী রূপে দেখত। শুধু কি সাধারণ মানুষের দেবতা ছিলেন তিনি? একেবারেই না। কে ছিলেন না তাঁর রোগীর তালিকায় – মতিলাল নেহরু, জওহরলাল নেহরু, মহাত্মা গান্ধী,  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ক্লেমেন্ট আ্যটলী, আমেরিকার রাষ্ট্রপতি জন.এফ.কেনেডি কে নেই।

এক ভদ্রলোক সকাল বেলায় ডাক্তার রায়ের কাছে এসে কাকুতি মিনুতি করে হাতে পায়ে ধরে বললো তার বাড়িতে যেতে , কারণ তার ছেলের টিবি হয়েছে ! তখন বিধান রায়ের টিবি চিকিৎসাতে ভারত জোড়া হাতযশ ছিলো ! তিনি রোগীর বাড়ি গিয়ে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠছেন আর শুনতে পাচ্ছেন একটি বাচ্চা ছেলের কাশির শব্দ, হঠাৎ তিনি কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে শুরু করলেন ! ছেলেটির বাবা তো অবাক, তাকে দেখে ডাক্তার রায় বললেন তাঁর ছেলেকে দেখে কিছু লাভ নেই, চারিদিকে থমথমে ভাব দেখে তিনি মৃদু হেসে বললেন ছেলেটি যে গরুর দুধ খায়, সেই গরুর টিবি আছে সম্ভবত, ছেলেটির কাশি সাধারণ ঠান্ডা লেগে হচ্ছে। তিনি ওষুধ লিখে দিচ্ছেন, কিনে এনে খাওয়ালেই ঠিক হয়ে যাবে ! সত্যি দিন তিনেক পরে ছেলেটি সুস্থ হয়ে ওঠে!

যত শুনবেন মনে হবে গল্প কথা শুনছেন। এরকম ভাবে চিকিৎসা কেউ করতে পারে নাকি! এতো কিছুই নয় একজন রক্ত মাংসের চিকিৎসক যখন মিথ হয়ে যায়, প্রবাদে পরিণত হয় তখন তাঁকে এরকম আরও অনেক লীলা খেলা দেখাতে হয়। আমি এখানে আমার সাধ্য মতন তাঁর অবিশ্বাস্য চিকিৎসা পদ্ধতির কিছু নমুনা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।

একবার গাড়িতে কলকাতায় ফিরছেন। হঠাৎ লক্ষ্য করলেন সামনের বাস থেকে এক যাত্রী নামতে গিয়ে পড়ে গেল রাস্তায়। পড়বার সময় বাসের পাদানীতে মাথার পিছন দিকটা জোর লেগেছে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে ড্রাইভারকে গাড়ী থামাবার নির্দেশ দিলেন। এখন সেই যাত্রী তো ধুলো ঝেড়ে হাঁটা শুরু করে দিয়েছে। বিধান বাবু তাঁকে ডেকে অবিলম্বে হাসপাতাল যাবার পরামর্শ দিলেন এবং স্থানীয় একজনকে বললেন সব খবর যেন পরের দিন তাঁকে দেওয়া হয়। কিন্তু সেই যাত্রী যাকে এত পরামর্শ দান করলেন বিধানবাবু, তিনি কোনো পাত্তাই দিলেননা এবং যথারীতি হাসপাতালের চৌহদ্দীও মাড়ালেন না। ২৪ ঘন্টা গেল না তার মধ্যেই ইহজগতের মায়া কাটিয়ে ফেললেন। বিধানবাবু পরে বলেছিলেন তিনি গাড়িতে বসে লক্ষ্য করেছিলেন কিভাবে লোকটি পড়লেন। উনি যে সন্দেহটা করেছিলেন সেটাই ঘটেছে। ওই যাত্রীর মাথায় ইন্টারনাল হেমারেজ হয়েছিল।

বিধান রায়ের যেটা বিশেষ দক্ষতা ছিল সেটা কেবল ইনটুইশন বা আগে থাকতে রোগের প্রকৃতি বুঝে ফেলা নয়, যে ক্ষিপ্রতায় তিনি এই রোগ নির্ণয়টা করতেন সেটাই ওনাকে তুলনাহীন করে তুলেছে। শুনেছি শচীন তেন্ডুলকর নাকি বোলারের কব্জির মোচড়েই বুঝে যেতেন বলটি কি ধরনের হতে যাচ্ছে। সেই অনুযায়ী শট সিলেকশনও করে রাখতেন। এসবই কিন্তু ঘটত সেকেন্ডের ভগ্নাংশে। ডাঃ রায়ও এমনটাই ছিলেন। এই গল্পটাও ভগবতীপ্রসাদ বাবুই শুনিয়েছেন বর্তমান পত্রিকায়। ওনার জবানিতে তুলে দিলাম পুরো গল্পটি- 
“মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় বিধানবাবু নিয়ম করে দিয়েছিলেন, বিকাল পাঁচটার পর মহাকরণে কেউ যেন না থাকে। সবাইকে বাড়ি চলে যেতে হবে। এমনকি, লিফটম্যানদের বাড়ি চলে যেতে বলতেন তিনি। শুধু তিনি থাকতেন। সেই সময়টায় ফাইল দেখেন একটার পর একটা। চলত রাত আটটা-সাড়ে আটটা পর্যন্ত। বিধানবাবুর একটা রােগ ছিল, প্রস্রাব পেলে বেগ চেপে রাখতে পারতেন না। তাই মহাকরণ ছেড়ে বেরোনোর সময় টয়লেট হয়ে যেতেন। বেরোনোর সময় মহাকরণে শুধু থাকতেন সুশান্তবাবু এবং একজন সার্জেন্ট। বিধানবাবু পাইলট ব্যবহার করতেন না। সেই সার্জেন্ট তাকে গাড়িতে তুলে দেবে। একদিন কাজ করতে করতে ন’টা বেজে গেল। এদিকে, ঘড়ি ধরে সাড়ে ন’টার সময় রাতের খাওয়া সেরে নেওয়ার অভ্যাস বিধানবাবু। নটা বেজে গিয়েছে শুনে টয়লেটে না গিয়ে তড়িঘড়ি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতেই বেগ এসে গেল। উঠতে গিয়েও থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তিন তলায় এক সাফাইকর্মী ঝাড় দিচ্ছে। সেটা অবশ্য তাকে আকর্ষণ করেনি। বিধানবাবুকে ভাবিয়েছিল ওই কর্মীর বিশ্রী শব্দের কাশি। বিধানবাবু সুশান্তবাবু বললেন, ‘ওকে ডেকে আন তাে’। কাকাবাবু’কে যতই ভালোবাসুন না কেন, তাঁর চিন্তা-ভাবনা তল কিন্তু সুশান্তবাবু পেতেন না। সাফাইকর্মীকে তলব করায় তিনি মনে মনে ভাবতে লাগলেন, কেন ডাকল রে বাবা? উপর থেকে ধুলােটুলাে পড়ল না তাে ‘বুড়াে’র গায়ে! চাকরিটা বােধহয় গেলই সাফাইওয়ালার। সেই লোকটি এসে দাঁড়ানো মাত্রই বিধানবাবু ধমক, ‘কী ভেবেছেন কী?’ সাফাইকর্মী তাঁর হাতে পায়ে ধরে বলতে চেষ্টা করলেন, ‘আমার চাকরিটা খাবেন না হুজুর…’।এবার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বিধানবাবু বললেন, ‘আরে দূর বেটা, আগে তো প্রাণে বাঁচি তারপর চাকরি!’ এ কথা শুনে সুশান্তবাবু তাে কিছুই কুলকিনারা পাচ্ছেন না। বিধানবাবু সেই সার্জেন্টকে ডাকলেন ‘গাড়ি তৈরি। তাে?’ সার্জেন্ট উত্তর দিলেন, হ্যাঁ। বললেন এক্ষুণি লােকটাকে গাড়িতে করে যাদবপুর টিবি হাসপাতালে পাঠানাের ব্যবস্থা করুন। ওঁর গ্যালপিং টিবি হয়েছে। সুপারকে বলুন, বিধানবাবু পাঠিয়েছেন। সার্জেন্ট তাই করলেন। এদিকে, সুশান্তবাবু তাে হতভম্ব হয়ে গােটা ব্যাপারটা দেখলেন। তাঁর সন্দেহ হল, অত দূর থেকে কাশির শব্দ শুনে বিধানবাবু কীভাবে বুঝে গেলেন লােকটির গ্যালপিং টিবি হয়েছে! সন্দেহ দূর করতে সুশান্তবাবু পরদিন সকালে ফোন করলেন হাসপাতালের সুপারকে। বললেন, ‘বিধানবাবু জানতে চাইছেন, সেই সাফাইকর্মী কী হয়েছে? এখন কেমন আছেন তিনি?’ সুশান্তবাবুকে তাজ্জব করে দিয়ে সুপার বললেন, আপনি কী বলছেন?এই তাে সকালে আমার ডাঃ রায়ের সঙ্গে ফোনে কথা হল। তাঁকে বললাম, রােগীর গ্যালপিং টিবিই হয়েছে। ওঁর কী কী ওষুধ লাগতে পারে সে ব্যাপারেও পরামর্শ দিলেন উনি। সেদিন মহাকরণে এসে ওই সাফাই কর্মীর ফাইল দিয়ে পাঠালেন বিধানবাবু। সচিবকে বললেন, ওই সাফাইকর্মীর লিভ উইথ ফুল পে আনটিল রিকভারি মঞ্জুর করে দিন। অবাক সচিব বললেন, ‘মানে… আমি তাে একটা দিনের জন্য এটা করতে পারি। এতদিনের করতে গেলে সেটা তাে রুলের বাইরে চলে যাবে…’। তাকে থামিয়ে বিধানবাবু বলে উঠলেন, ‘নিকুচি করেছে আপনার রুলের।’ তিনি ফাইলটি নিয়ে নিজেই সই করে দিলেন। বললেন, একে তাে জটিল যক্ষ্মা হয়েছে। তার উপর যদি ছুটি না পায়, তাহলে তো লােকটা এমনিই মরে যাবে!” আজকের দিনে এই মানসিকতার কোন রাজনীতিকের কথা আমরা কল্পনাও করতে পারিনা।

বিধান রায়ের ডাক্তার  হবার খুব যে ইচ্ছে ছিল তা কিন্তু নয়। শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং এবং কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ফর্মের জন্য আবেদন করেছিলেন। এখন ডাক্তারির ফর্মটা আগে আসায় ওইটাই আবেদন করে পূরণ করে পাঠিয়ে দিলেন। শিবপুরের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ফর্ম  যখন এল ততক্ষণে ডাক্তারিতে ভর্তি হয়ে গেছেন। ভাগ্যিস ডাক্তারির ফর্মটা আগে এসেছিল! ডাক্তারি পড়ার সময় থাকতেন কলেজ স্ট্রিট ওয়াই এম সি এ-তে। শুরুতে প্রবল অর্থকষ্টে ভুগেছেন। অতিরিক্ত উপার্জনের জন্য ধনী রোগীদের বাড়িতে মেল নার্স হিসেবে কাজও করেছেন। বারো ঘণ্টার ডিউটিতে পারিশ্রমিক পেতেন আট টাকা।এই অর্থকষ্ট কিন্তু পেশাদার ডাক্তার হিসেবে জীবন শুরু করার সময়েও ছিল। তাই রোজগার বাড়াতে একসময় পার্ট টাইম ট্যাক্সিও চালাতে হয়েছে তাঁকে। আসলে কোন কাজকেই ছোট মনে করতেন না তিনি। কলেজ জীবনের শুরুতেই একটি উদ্ধৃতি ছাত্র বিধান রায়কে ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করে যা আজীবন তিনি মেনে এসেছেন- “Whatsoever thy hand findeth to do, do it with thy might;” অর্থাৎ “তোমার হাত যে কাজেই নিয়োজিত হোক না কেন, সেই কাজটা নিজের সর্বোচ্চশক্তি দিয়ে কর।”

ভিয়েনায় চোখের চিকিৎসা করাতে গেছেন বিধানবাবু। অপারেশন টেবিলে শোয়ানো হয়েছে ওনাকে। অপারেশনের প্রস্তুতিও প্রায় সারা। এমন সময় উপস্থিত ডাক্তারদের মধ্যে কেউ একজন কাশলেন। ডাক্তার রায় চোখ বুজে শুয়ে শুয়েই জিগেস করলেন- কে কাশলো? এক ডাক্তার বললেন- আমাদেরই এক সহকর্মী ডাক্তার স্যার। এক্ষুনি ওনার একটা চেস্ট এক্স-রে করিয়ে নিয়ে আসুন। টিবি হয়েছে ওনার। ডাক্তাররা তো অবাক। একজন বলেই ফেললেন – উনি তো ঠিকই আছেন স্যার। উনি নিজে একজন ডাক্তার তেমন কিছু হলে তো বুঝতেই পারতেন। ডাক্তার রায় বললেন – যেটা বললাম সেটা করুন। ওনার চেস্ট এক্স-রে করিয়ে আনুন এক্ষুনি। আনা হল চেস্ট এক্স-রে। সত্যিই টিবি হয়েছিল ওই ডাক্তারের।

তাঁর চিকিৎসা পদ্ধতির সবথেকে স্বতন্ত্র দিক ছিল যতটা সম্ভব ওষুধ কম দিয়ে সম্ভব হলে না দিয়ে চিকিৎসা করা।  প্রাকৃতিক ভেষজ উপাদানে ভরসা রাখা।এরকম একটি ঘটনার কথা শোনাই বরং।

অবিভক্ত ভারতের পূর্ব পাকিস্তানের এক বিখ্যাত জমিদারের পুত্রবধূ একবার খুব অসুস্থ। বাংলাদেশের কোনও চিকিৎসকই রোগ সারাতে পারলেন না। জমিদার ছেলে-বউকে নিয়ে চলে এলেন কলকাতায় বিধানবাবুকে দেখাতে। সঙ্গে বিধানবাবুর বন্ধুর সুপারিশ করা চিঠি। কিন্তু এসে শুনলেন, বিধানবাবু শিলঙে।  হাল না ছেড়ে সেখানেই চলে গেলেন তারা। বিধানবাবু সব শুনে সেই মহিলার সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলতে চাইলেন। বিধানবাবু কথায় কথায় জানতে পারলেন, কুমারী অবস্থায় বাপের বাড়িতে গড়গড়ায় তামাক খাওয়ার অভ্যাস ছিল তাঁর। কিন্তু বিয়ের পর লজ্জায় আর সেকথা শ্বশুরবাড়িতে বলতে পারছেন না। এদিকে এতদিনের অভ্যাস হঠাৎ ছেড়ে দেওয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। বিধানবাবু সব শুনে বললেন, ‘কাউকে কিছু বলার দরকার নেই। আমি দেখছি।’ জমিদারকে ডেকে বললেন, ‘আপনার বউমার যা রােগ হয়েছে তার একটাই ওষুধ আছে। ওকে এক মাস দিনে একবার গড়গড়ায় তামাক খেতে দিতে হবে। তারপর দু’দিন অন্তর একবার। এইভাবে কমাতে হবে।’ সেই মহিলা যাওয়ার আগে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলেছিলেন, “আপনি আমায় বাঁচালেন।”

আরো একটি ঘটনা এ প্রসঙ্গে বলতে ইচ্ছে করছে। গ্রামের এক গরিব চাষিকে বিধান রায়ের কাছে পাঠিয়েছিলেন সেই গ্রামের এক ডাক্তার। বিধান রায় তখন তাঁর ওয়েলিংটন স্কোয়ারের বাড়িতে সপ্তাহে একদিন বা দুদিন রোগী দেখতেন। সেই গরিব চাষি বিধান রায়কে দেখানোর পর গ্রামে ফিরে আর ওই ডাক্তারের কাছে আসেননি। ডাক্তারবাবুই একদিন নিজেই গেলেন তাঁর খোঁজ করতে। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী হলো? কী বললেন ডাক্তার রায়?’ সেই গরিব চাষি তো আর চেনেন না কে ডাঃ রায়! তিনি অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘ধ্যুত্‍ কীসের ডাক্তার? দেখে বইল্য, চাষ করো তো? প্যাঁজের চাষ করো। এ-আবার ডাক্তার নাকি?’ ডাক্তারবাবু হেসে বললেন, তুমি দু’বেলা নিয়ম করে পিঁয়াজের রস খাবে। কী ভাবে খাবে বুঝিয়ে বললেন। দু-মাসেই চাষিটির রোগ সেরে গেল। 

এই প্রথাবিরোধী চিকিৎসাপদ্ধতি বিধান রায়কে প্রায় জাদুকর করে তুলে ছিল রোগীদের কাছে। মানবশরীর সম্পর্কে কী অসম্ভব রকম জ্ঞান থাকলে তবেই এই লেভেলের দক্ষতা অর্জন করা তা বিধান রায়কে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।

তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বাজার। ম্যালেরিয়া ছড়িয়ে পড়ছে বাংলায়। কিন্তু কুইনাইন পাওয়া যাচ্ছে না। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর জন্য কিনে নেওয়ায় বাজার থেকে কুইনাইন উধাও। বিধান রায় তখন ছাতিম গাছের পাতা থেকে বড়ি তৈরি করতে বললেন। তাতে অনেকটা কুইনাইনের মতোই কাজ হবে। ম্যালেরিয়া রোগী সেরে উঠবে। বিধান রায়ের পরামর্শে তৈরি হয়েছিল ছাতিম গাছের পাতা থেকে তৈরি ম্যালেরিয়ার বড়ি। বহু অসুস্থ মানুষের চিকিৎসা হয়েছিল এই নতুন ‘কুইনাইন’-এ।

ডাক্তার রায়ের রোগ নির্ণয়ের অবিশ্বাস্য ক্ষমতার আরও একটা নমুনা বিখ্যাত সাহিত্যিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় শুনিয়েছেন। সঞ্জীববাবুর বাবার এক সহকর্মী বিধান রায়ের কাছে যান তাঁর মাথা ঘোরার সমস্যা নিয়ে। ঘুম থেকে উঠলেই তাঁর মাথা ঘোরে। ভার্টিগো, স্পন্ডিলাইসিস সব রকমের চিকিৎসা করিয়েছেন কিন্তু কোন কিছুতেই কোন লাভ হয়নি। অগত্যা ডাঃ রায়ের শরণাপন্ন হয়েছেন। ডাঃ রায় ওনার মুখে সব শুনলেন শুনে একটা সাদা কাগজে খসখস করে কি লিখে হাতে ধরিয়ে বললেন যান, ঠিক হয়ে যাবে। ভদ্রলোক তাকিয়ে দেখলেন গোটা কাগজে বড়বড় করে তিনটে শব্দ লেখা ইংরেজিতে- Reverse your head। এটাই প্রেসক্রিপশন। ভদ্রলোক তো মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে না পেরে বাড়ি চলে গেলেন। বাড়ির সকলেই খুব বিরক্ত এরকম প্রেসক্রিপশন দেখে। ডাক পড়ল সঞ্জীববাবুর বাবার যেহেতু উনিই ডাঃ রায়কে দেখানোর কথা বলেছিলেন। “হতে পারেন উনি বড় ডাক্তার কিন্তু এটা কি ধরণের ঠাট্টা!” রেগেমেগে প্রেসক্রিপশনটা হাতে ধরিয়ে দিলেন ওই ব্যক্তি। অগত্যা সঞ্জীববাবুর বাবাই ছুটলেন ডাঃ রায়ের কাছে এর ব্যাখ্যা চাইতে। ডাঃ রায় প্রেসক্রিপশনটা দেখে বললেন – “আমার ধারণা রাতে শোয়ার সময় উনি উত্তর দিকে মাথা করে আর দক্ষিণে পা করে শোন। এর ফলে যেটা হচ্ছে পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র বরাবর উনি চুম্বক শলাকার কাজ করছেন যার প্রভাব মাথায় পড়ছে। আমি তাই ওনাকে উলটো করে মানে, দক্ষিণে মাথা আর উত্তরে পা করে শুতে বলেছি।” ওই ভদ্রলোককে এটা বলতে উনি শোয়ার ভঙ্গিমা পরিবর্তন করে শুতে লাগলেন। ব্যস! তিনদিনেই মাথা ব্যাথা গায়েব।

মাত্র ১২০০ টাকা সম্বল করে বিলেত গেছিলেন দু’বছরে মেডিসিন ও সার্জারির চূড়ান্ত সম্মান এম আর সি পি এবং এফ আর সি এস শেষ করবেন বলে। বিলেতের সেন্ট বারথোলমিউ কলেজে ডাক্তারি পড়ার জন্য আবেদন করলেন। ওখানকার অধ্যক্ষ সাফ বলে দিলেন, “ এ দেশের দারুণ মেধাবি ছাত্ররাও দুটি কোর্স একসঙ্গে শেষ করতে পারেনা।তুমি ভারত থেকে এসে সেটা করে ফেলবে?’’ প্রত্যাখান হয়ে গেল বিধানবাবুর আবেদন। দমলেন না। আবার করলেন আবেদন। এবারও ফল একই- প্রত্যাখান। আবার করলেন-আবারও প্রত্যাখান। এইভাবে টানা ৩০ বার আবেদন করার পর অবশেষে গ্রাহ্য হল আবেদন। দু’ বছরে মেডিসিন ও সার্জারির চূড়ান্ত সম্মান এম আর সি পি এবং এফ আর সি এস শেষ করলেন। এ এক অবিশ্বাস্য কৃতিত্ব। এই তিনিই ১৯৪৮-এ যখন ডাক্তারি পেশা ছেড়ে মুখ্যমন্ত্রিত্ব গ্রহণ করছেন তখন ডাক্তারি থেকে ওনার মাসে আয় ছিল ৪২০০০ টাকা। সেই সময় ৪২০০০ টাকা মানে আজকের বাজারে কত সেটা বোঝাতে একটা ছোট্ট হিসেব দেওয়া যাক। ১৯৪৭-এ ১০ গ্রাম সোনার দাম ছিল- ৮৮.৬২ টাকা যা বেড়ে এখন প্রায় ৩০০০০ টাকা। অর্থাৎ এই ৭৩ বছরে সোনার দাম বেড়েছে প্রায় ৩২৭ গুণ। সেই হিসেবে ওনার সেই সময়ের ৪২০০০ টাকা প্রতি মাসে, আজকের হিসেবে দাঁড়ায় ১,৩৭,৩৪০০০ টাকা।

এতো গেল সব সাধারণ মানুষের কথা। ডাঃ রায়ের বিখ্যাত রোগীদেরকে চিকিৎসার গল্প না শোনানোটা বড় অন্যায় হবে।

জওহরলাল নেহেরুর সাথে বিধান রায়ের  সম্পর্ক নিয়ে একটি বিবরণ দিয়েছেন নীতিশ সেনগুপ্ত।
একবার নেহেরু প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। দিল্লির সব নামকরা ডাক্তার সে বার নেহরুর অসুস্থতার ধরনটা বুঝতে পারছেন না। বিচলিত ইন্দিরা খবর দিলেন লালবাহাদুর শাস্ত্রীকে।মেডিক্যাল বাের্ড গঠন করা হল। ইন্দিরা ও লালবাহাদুর সমস্ত রাত জেগে, অস্বস্তিতে নেহেরু ঘুমাতে পারছেন না। ভােরবেলা লালবাহাদুর ফোন করলেন ডাঃ রায়কে এবং তাঁকে দ্রুত দিল্লি আসতে বললেন তখনই। এটাও বললেন একটা বিশেষ বিমান দমদমে অপেক্ষা করছে তাঁকে নেওয়ার জন্য। ডাক্তার রায় নেহরুর ঘরে ঢুকতেই মেডিক্যাল বোর্ডের রিপোর্ট তাঁর হাতে দেওয়া হল। ডাক্তার রায় তা সরিয়ে দিয়ে বিখ্যাত বাঙালি চিকিৎসক ডা. সেনকে তিরস্কার করে ববললেন, “তুমি এ রকম অপদার্থ!” এবার নিজে স্টেথােস্কোপ দিয়ে পরীক্ষা করতে শুরু করলেন। পেটে থাবড়া মেরে শব্দ শুনলেন। কাপড় কাচার সাবান এবং গরম জল আনতে বললেন। ডাঃ রায় নিজের হাতে ওই সাবান গুললেন এবং লালবাহাদুর ছাড়া সবাইকে বাইরে যেতে বললেন। এ বার তিনি নেহরুর পাজামার গিট খুলে দিতে নেহরু আপত্তি করে উঠলেন। তখন ডাঃ রায় ধমক দিয়ে বললেন, “আমি ডাক্তার, তুমি রোগী। একদম চুপ করে থাকবে।” অয়েল ক্লথ বিছিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে ডাঃ রায় দু’বার ডুস দিলেন এবং বেডপ্যান পেতে নেহরুকে পায়খানা করালেন। কলকাতায় ফোন করে একটা হোমিওপ্যাথি ওষুধ, কয়েকটি ডাব ও ডালপালা পাঠাতে বললেন। এর পর নেহরুকে পুরাে সুস্থ করার জন্য ডাঃ রায় প্রায় এক সপ্তাহ ধরে নিঃশব্দে কলকাতা-দিল্লি ডেলি প্যাসেঞ্জারি করেছিলেন এয়ারফোর্সের বিমানে।

ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ক্লেমেন্ট আ্যটলির হাঁটু অস্ত্রোপচার করে সারিয়েছিলেন। আর আমেরিকার রাষ্ট্রপতি কেনেডির চিকিৎসা করার গল্পটি তো প্রায় মিথ হয়ে গেছে। একবার কেনেডির চিকিৎসার সুযোগ এসেছিল বিধানচন্দ্রের কাছে। স্বাস্থ্য পরীক্ষার সময় যে স্টেথো দেওয়া হয়েছিল উনি কানে নিয়েই তৎক্ষনাৎ তা বাতিল করেন এবং প্রথাগত ভাবে বুকে হাত পেতে কান লাগিয়ে শুনে প্রয়োজনীয় ওষুধ বলে দেন। পরে জানা যায় ডক্টর রায়ই ঠিক ছিলেন ওই স্টেথোস্কোপে গোলমাল ছিল। কেনেডি অল্প কদিনেই ওনার দেওয়া ওষুধে সুস্থ হয়ে ওঠেন।

বিধান রায়ের মৃত্যুর পর ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালে তাঁকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে লেখা হয় –

“first medical consultant in the subcontinent of India, who towered over his contemporaries in several fields? …at his professional zenith he may have had the largest consulting practice in the world, news of his visit to a city or even railway station bringing forth hordes of would-be patients.”

ডাক্তার হিসেবে ডাঃ রায় যে অসামান্য দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেই তিনিই আবার মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসার পর পশ্চিমবাংলার ভোল পাল্টে দিয়েছিলেন।

মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বিধান রায় যে কাজগুলো করেছিলেন তার মধ্যে অন্যতম হল, স্যাটেলাইট টাউন সল্টলেক এবং কল্যাণী। ৮ খণ্ডে মেট্রো রেলের প্রাথমিক রিপোর্ট তৈরি। বোস ইনস্টিটিউটে আমেরিকার ৫ বিজ্ঞানীকে এনে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির পরিকল্পনা। পঙ্গপাল যাতে শস্যের ক্ষতি না করে তার জন্য বিদেশি সংস্থার সঙ্গে চুক্তি। আধুনিক পদ্ধতিতে মাছ ধরার জন্য বিদেশি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ গ্রহণ এবং জাপান থেকে ট্রলার আমদানি। বিধান রায়ের উদ্যোগে তৈরি হল আসানসোলে ভারতের প্রথম সাইকেল কারখানা। চিত্তরঞ্জনে রেল ইঞ্জিন তৈরির কারখানা। বিধান রায় আমেরিকায় গিয়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণে এবং সেচের জন্য ওখানকার টেনেসি ভ্যালি অথরিটি সংস্থাটির কাজকর্ম দেখে এসেছিলেন। সেই সূত্রেই তৈরি হল দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন। আমেরিকার ইঞ্জিনিয়ারদের বিধান রায় কলকাতায় ডেকে আনলেন। তৈরি হল, মাইথন, তিলাইয়া ও দুর্গাপুর জলাধার ও ব্যারেজ। গরিবদের জন্য প্রথম আবাসন পরিকল্পনা বিধান রায়ের। ১৬ ফুট বাই ১১ ফুটের ৫০০ টি কাঠের বাড়ির অর্ডার দেওয়া হয় এক সুইডিশ কোম্পানিকে। পরীক্ষামূলক ভাবে উদ্বাস্তুদের দেওয়া হবে। তবে সেই বাড়ি তৈরি হয়েছিল কিনা তার তথ্য মেলেনি।

পশ্চিমবঙ্গের জন্য দাবি আদায়ের জন্য বহুবার সরব হয়েছেন তিনি। এ প্রসঙ্গে  একটি ঘটনা আমি আমার দাদুর মুখে শুনেছি। চীনের সঙ্গে যুদ্ধের পরে দেশে ভয়ানক চালের আকাল দেখা দেয়। সেই সময় নেহেরু বিধানবাবুকে বলেন – পশ্চিমবঙ্গের জন্য যতটা চালের বরাদ্দ তা কিছুদিন দেওয়া সম্ভব নয়। … তার বদলে বিধানবাবু যেন গম দিয়ে কাজ চালিয়ে নেন। এই প্রস্তাব শুনে বিধানবাবু অস্থায়ী পদে প্রায় ৩০০-৩৫০ যুবক-যুবতী নিয়োগ করলেন যাদের দায়িত্ব দিলেন প্রায় ‘আদমশুমারির মতই’ বাড়ি বাড়ি গিয়ে গিয়ে বাংলায় ভাত এবং রুটি প্রধান খাদ্য কত মানুষের তার পরিসংখ্যান বার করতে। ঠিক তিন মাস পরে সেই পরিসংখ্যান হাতে পেয়েই – বিধানবাবু নেহরুকে চিঠি লিখেছিলেন – “আপনি বাংলায় রুটি যাঁদের প্রধান খাদ্য তাদের দায়িত্ব নিন, আমার পক্ষে তাদের খাদ্য যোগান সম্ভব নয়, আর বাংলায় ভাত যাঁদের প্রধান খাদ্য তাদের দায়িত্ব, আমি বুঝে নেব।” …. নেহেরু বিধানবাবুকে ভালোই চিনতেন – তাই বাধ্য হয়েই বাংলার জন্য চালের পুরো মাত্রই বরাদ্দ করেছিলেন তিনি।

তাঁর মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মেয়াদের মধ্যেই বাংলায় রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ, সোভিয়েত রাশিয়ার শাসক নিকিতা ক্রুশ্চেভ বাংলায় এসেছিলেন। নিকিতা ক্রুশ্চেভের সাথে বিধান রায়ের সাক্ষাৎ নিয়ে একটি অসাধারণ ঘটনা শুনিয়েছেন নীতিশ সেনগুপ্ত তাঁর বইয়ে।

১৯৫৬ সালে ৩ জুলাই ভারতে এসেছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধান দুই নেতা, প্রতিরক্ষামন্ত্রী নিকোলাই বুলগানিন এবং সেই সময়ের সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সর্বোচ্চ নেতা, সাধারণ সম্পাদক নিকিতা ক্রুশ্চেভ। এই উপলক্ষে কলকাতার ব্রিগেডে জনসভা হয়েছিল, তাকে এখনও বলা হয় সর্বকালের বৃহৎ জনসমাগম। এই সভার পরের দিন ক্রুশ্চেভ এবং বুলগানিনকে নিয়ে গঙ্গায় লঞ্চে করে বিধান রায় গেলেন শিবপুরে বোটানিক্যাল গার্ডেন দেখাতে। রাতে হল রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় নৈশ ভোজ। লঞ্চে যাত্রাপথে দুই সোভিয়েত নেতার সঙ্গে বিধান রায়ের যে কথা হয়েছিল, সে কথা পরে তাঁর কাছে শুনে অশোককৃষ্ণ দত্ত লিখেছিলেন ‘এক মহান ব্যক্তিত্ব’ রচনাটি। যা পরে নথিবদ্ধ করেন অশোককুমার কুণ্ডু তাঁর ‘ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়’ জীবনী গ্রন্থে। মাঝ গঙ্গায় বিধান রায় সোভিয়েত নেতাদের লঞ্চ থেকে শহর দেখাতে দেখাতে লন্ডন, নিউই্য়র্ক, হামবুর্গ ইত্যাদি শহরে টেমস বা হাডসন বা এলবে নদীবক্ষ থেকে তাঁর স্মৃতির সঙ্গে কলকাতার তুলনা করছিলেন। এসব শুনতে শুনতে ক্রুশ্চেভ হঠাৎ বললেন, ‘আপনি তো শুধু ক্যাপিটালিস্ট দেশের তুলনা করছেন, কোনও সমাজতান্ত্রিক দেশের কথা তো বলছেন না’! বিধান রায় হেসে বললেন, ‘আমি তো ওই সব দেশেই গিয়েছি। আমি তো কখনও কোনও সমাজতান্ত্রিক দেশ দেখিইনি’। ক্রুশ্চেভ তা শুনে বললেন, ‘কেন যাননি কেন’? বিধান রায় জবাবে বললেন, ‘ ওরা আমন্ত্রণ জানিয়েছে, তাই গিয়েছি। আমাদের অত বিদেশি মুদ্রা নেই যে বিদেশে বেড়াতে যাব’। তা শুনে ক্রুশ্চেভ হেসে বললেন, ‘ঠিক আছে, আমি আপনাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি, আপনি সোভিয়েত ইউনিয়নে আসুন, যত দিন খুশি থাকুন, দেখুন আমরা কেমন কাজ করছি’। বিধান রায় হেসে বললেন, ‘বড্ড দেরি কর ফেলেছেন আপনারা। এত বয়েসে আর কি যাওয়া হয়। কবে মরে যাব’। ক্রুশ্চেভ গম্ভীর ভাবে বললেন, ‘মরে গেলে লাল ফৌজ কুচকাওয়াজ করে আপনাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হবে’। এই বার বিধান রায় বললেন, ‘না ভাই আমি কোনও গডলেস কান্ট্রিতে মরতে চাই না’। ক্রুশ্চেভ অবাক হয়ে বলেন, ‘সেকি! ডাক্তার, তুমিতো বিজ্ঞান মানো, ঈশ্বরও মানো? দেখেছ কখনও ঈশ্বরকে’? বিধান রায় বললেন, ‘আপনি কি কখনও বিদ্যুৎ দেখেছেন’? ক্রুশ্চেভ বললেন, ‘না তা দেখিনি, কিন্তু সেই শক্তির প্রভাবে এই লঞ্চ চলছে, ওই আলো জ্বলছে’, এসব হল ওই বিদ্যুৎ শক্তির ফলিত প্রকাশ। বিধান রায় বললেন, ‘আমিও সেই ফলিত প্রকাশ দেখেই ঈশ্বরে বিশ্বাস করি’। এর পরও দু’জনে অনেক আলোচনা হল ঈশ্বর নিয়ে। ক্রুশ্চেভ বিধান রায়ের সঙ্গে কথা বলে এতটাই অভিভূত হয়েছিলেন যে দেশে ফিরে তিনি বিধান রায়ের জন্য একটি বিশেষ বিমান উপহার দিতে চাইলেন। বিধান রায় তাঁকে লিখলেন, ‘আমার কি আর এরোপ্লেন নিয়ে খেলার বয়স আছে! আপনি বরং আমাদের মেডিক্যাল কলেজের জন্য কিছু আধুনিক যন্ত্রপাতি পাঠান’। কিছু দিনের মধ্যেই কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে এসে পৌঁছেছিল সেই সব আধুনিক চিকিৎসা যন্ত্রপাতি। যা স্নাতকোত্তর মেডিক্যাল শিক্ষায় কাজে লেগেছিল।

মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে কিছু সময়ের জন্য  বিধান রায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর হয়েছিলেন। তিনিই চালু করেন বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কোর্স, জুট টেকনোলজি ইনস্টিটিউট, পাইলট এবং গ্রাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সংক্ষিপ্ত কোর্স।

সল্টলেক  উপনগরী, বিধান রায়ের স্বপ্নের পরিকল্পনা হলেও, বাম ও কংগ্রেস দুই তরফ থেকেই তিনি যেমন সমর্থন পেয়েছিলেন, দুই দলেরই বেশ কিছু নেতা এর বিরোধিতাও করেছিলেন। কংগ্রেসের তরফ থেকে ডঃ প্রতাপচন্দ্র এবং বামদের তরফ থেকে গণেশ ঘোষ (চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন খ্যাত) বিরোধিতা করেন। দুজনের কারণ কাছাকাছি ছিল। পরিবেশগত দিক থেকে লবণ হ্রদ বুজিয়ে দিলে জটিল সমস্যা দেখা দেবে, কলকাতার নিকাশি ব্যবস্থা গোলমাল হয়ে যাবে (অধিকাংশ বর্ষার জল ওইদিকেই নিকাশ করা হত, লবণ হ্রদ বোজানোর পর থেকেই কলকাতা সহজেই জলমগ্ন হতে শুরু করে), ওখানের মৎস্যজীবীদের জন্য কোনো পুনর্বাসন পরিকল্পনাও ছিল না। বিধান রায় প্রতাপচন্দ্রকে ডেকে বলেন – ‘ওয়ার্ল্ড ব্যাংক থেকে অনেক টাকা পেয়েছি, পরিকল্পনা গ্রহণ না করলে সমস্ত টাকাই ফেরত চলে যাবে। তোমরা বাপু বাধা দিও না।’ আর গণেশ ঘোষকে বলেন – ‘সল্টলেক বাসযোগ্য করতে আরও ছয় মাস সময় লাগবে, ২০ হাজার প্লট তৈরি হবে। আমার জীবদ্দশায় হয়ত এই পরিকল্পনা কার্যকর হবে না কিন্তু আমার বন্ধু গণেশ ঘোষ এই প্রকল্পের রূপায়ণ দেখে যেতে পারবেন বলে আমার মনে হয়। যদি একান্তই না হয়, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম এর সুফল পাবে বলে আমার বিশ্বাস।’ শেষপর্যন্ত আর কেউই আপত্তি করেননি।

আর.জি. কর মেডিকেল কলেজ, যাদবপুর টি.বি হাসপাতাল, চিত্তরঞ্জন সেবা সদন, কমলা নেহরু হাসপাতাল, ভিক্টোরিয়া ইনস্টিটিউশন, এবং চিত্তরঞ্জন ক্যান্সার হাসপাতাল তাঁর উদ্যোগেই প্রতিষ্ঠা পায়। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ মেন্টাল হেলথ, সংক্রামক রোগ হাসপাতাল এবং কলকাতায় প্রথম স্নাতকোত্তর মেডিক্যাল কলেজ তাঁর আমলেই প্রতিষ্ঠিত হয়। শুধু চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান নয় মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে  তিনি পাঁচটি বিশিষ্ট শহর, দুর্গাপুর, কল্যাণী, বিধানানগর, আশোকনগর, এবং হাবরা স্থাপন করেন।

দুর্গাপুর ইস্পাত নগরী তৈরি করতে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে কম লড়াই করতে হয়নি তাঁকে। এই সংক্রান্ত একটি গল্প এ প্রসঙ্গে না বললেই নয়। স্বাধীনতার পর সোভিয়েত, ব্রিটেন ও জার্মানির সাহায্যে দেশে মোট ৮টি ইস্পাত কারখানা গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু। কিন্তু ৮টির মধ্যে একটিরও পশ্চিমবঙ্গে তৈরি হওয়ার কথা ছিল না। একথা মেনে নিতে পারলেন না মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায়। বিরোধ বাধল কেন্দ্রের সঙ্গে। তাঁর দাবি, পশ্চিমবঙ্গের দুর্গাপুরে একটি কারখানা তাঁর চাই। কিন্তু কেন্দ্র একের পর এক যুক্তি খাড়া করে নাকচ করে দিল বিধান রায়ের দাবি। কেন্দ্রের মতে, দুর্গাপুর পাকিস্তান সীমান্তের কাছাকাছি অবস্থিত। কাজেই, যদি দুই দেশের মধ্যে কখনও যুদ্ধ হয়, তা হলে অনায়াসেই হামলার টার্গেটে পরিণত হবে ওই কারখানাটি। কিন্তু কেন্দ্রের এই যুক্তি মানতে নারাজ বিধান রায়। কারখানা তাঁর চাই-ই! ফলত তৎকালীন বাংলার পত্র-পত্রিকাগুলিকে এই দাবিতে সরব হওয়ার নির্দেশ দিলেন তিনি। কারখানার দাবীতে জোরকদমে চলল লেখালেখি পত্রপত্রিকাগুলোতে। সে সময় কেন্দ্রীয় শিল্পমন্ত্রী ছিলেন ওড়িশার নিত্যানন্দ কানুনগো। কাজেই, ইস্পাত কারখানার অনুমোদনের সিদ্ধান্ত ছিল তাঁরই হাতে। একবার কোনও কারণে জাতীয় উন্নয়ন পর্ষদের বৈঠকে হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়েন কেন্দ্রীয় শিল্পমন্ত্রী কানুনগো। বিধান রায় উপস্থিত ছিলেন সেখানে। পরীক্ষা করে বিধান রায় জানালেন, পেটে পাথর জমে জটিল রোগের আকার নিয়েছে, এখনই অপারেশন করা প্রয়োজন। বিদেশে চিকিৎসা করিয়েও যে রোগের ফল পাওয়া যায়নি, বিধান রায়ের অপারেশনে মিলল তার অব্যর্থ ফল। সুস্থ হয়ে উঠলেন কেন্দ্রীয় শিল্পমন্ত্রী। ডা. রায় রোগীকে দেখতে গেলেন। রোগীর দাবী, কোনও ফি না নিয়েই যে তিনি এতখানি রোগের চিকিৎসা করলেন, ফি তাঁকে নিতেই হবে। ফি তিনি নিয়েছিলেন। আর সেই ফি-বাবদই গড়ে উঠেছিল দুর্গাপুর ইস্পাত নগরী।

তাঁরই প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছিল, হরিণঘাটা দুগ্ধপ্রকল্প।  তাঁরই উদ্যোগে রূপ পেয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট স্পট দীঘা। শিক্ষাক্ষেত্রেও তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তাঁরই উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল রবীন্দ্রভারতী ও বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়। বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজ। পুরুলিয়া ও নরেন্দ্রপুরে রামকৃষ্ণ মিশনের আবাসিক বিদ্যালয় গড়ে ওঠার পেছনেও বিধান রায়ের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য।

সত্যজিৎ রায় ‘পথের পাঁচালি’ তাঁর পৃষ্ঠপোষকতাতেই গড়ে উঠেছিল। সরকারী নিয়মানুসারে সরাসরি চলচ্চিত্র নির্মানে টাকা দেওয়া আইন বিরুদ্ধ। বিধান রায় আলোচনায় বসে বললেন – ‘ও (সত্যজিৎ) যে আমাকে বলে গেল, এতে গ্রামের চিত্র ফুটে উঠেছে। গ্রামের সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখের কথা, রাস্তাঘাটের কথা, জলাশয়ের কথা, আরও কত কি ? এটা তো সরকারী পর্যায়ে একটা ডকুমেন্টারী হতে পারে।’ শেষ পর্যন্ত বিধান রায়ের চেষ্টায় আইনের ফাঁক গলে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ‘তথ্যচিত্র’ খাতে সত্যজিৎ রায়কে অর্থসাহায্য করেন এই যুগান্তকারী ছবিটি নির্মাণে।

বিরোধী দলের প্রতি সৌহার্দ্যপূর্ণ ব্যবহারে কখনো খামতি রাখেননি মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায়। বিধানসভায় জ্যোতি বসু ছিলেন বিধান রায়ের কঠোর সমালোচক। তবে বিধান রায়ের ব্যক্তিগত সচিব সরোজ চক্রবর্তী লিখেছেন, ‘দু’জনের মধ্যে সমঝোতা ছিল যে, ভোটের সময় কেউই একে অন্যের নির্বাচনী এলাকায় গিয়ে জনসভা করবেন না। ১৯৫২ সালের সাধারণ নির্বাচন ছাড়া আর কখনও কেউ এই চুক্তি ভাঙেননি। ডাঃ রায়ের বাড়িতে জ্যোতি বসু যখন কফি খেতে আসতেন ওঁর সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের সমস্যাবলী নিয়ে আলোচনা করতেন, তখন দু’জনে একেবারে অন্য মানুষ। আমি এই ঘটনা বহুবার দেখেছি’।

বিধানচন্দ্র যে কোনো বিক্ষোভ হলেই পুলিশকে নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন আগে জ্যোতি বসুকে গ্রেপ্তার করতে। শেষে গ্রেপ্তার হয়ে হয়ে আর জেলে গিয়ে গিয়ে তিতিবিরক্ত হয়ে জ্যোতি বসু বিধানচন্দ্রকে ধরলেন – ‘আপনি যে কোনো আন্দোলন হলেই আমাকে ধরেন কেন ?’ বিধান রায় সহাস্যে উত্তর দিলেন – ‘জান তো একটা কথা আছে – When the storm came, tallest tree are the first hit. তা তুমিই তো নেতা, তোমাকে গ্রেপ্তার করব না তো, কাকে করব ?’ জ্যোতি বসুর আর এর উত্তর দেওয়ার কিছু ছিল না। এইরকমই জ্যোতি বসুকে আরেকটি বিতর্কে স্তব্ধ করে দিয়েছিলেন বিধানচন্দ্র। সেটা অবশ্য অ্যাসেম্বলিতে, ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় নয়। মুখ্যমন্ত্রী প্রচুর টাকা খরচ করে একটা নতুন চেম্বার বানান, তাতে বসে এক রাজকীয় চেয়ার। জ্যোতি বসু অ্যাসেম্বলিতে এর তীব্র প্রতিবাদ করলে মুখ্যমন্ত্রী উঠে দাঁড়িয়ে বলেন – ‘তুমি এতে প্রতিবাদ করছ কেন ? তুমিই তো এই মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে একদিন বসবে।’ তরুণ বিরোধী দলনেতা সাংঘাতিক লজ্জা পেয়ে বসে পড়লেন।

প্রশাসক হোক বা চিকিৎসক বিধান রায়ের এই মানব দরদী চরিত্রের বিশ্লেষণে আগে মানুষ বিধান কে আমাদের দেখতে হবে।

যশোহরের রাজা প্রতাপাদিত্য, যিনি বিখ্যাত বারো ভুঁইঞার এক জন ছিলেন, বিধান রায় সেই পরিবারের সন্তান ছিলেন। ধর্মে তাঁরা ব্রাহ্ম ছিলেন। বাবা সরকারি আমলা হলেও খুব সাধারণ ভাবে বিধান রায় বড় হয়েছেন। বাড়িতে খাবার না থাকায় ভাই বোনেরা মিলে ঘোড়ায় খাবার ঘাস আর পদ্ম পাতা খেয়ে রাত কাটিয়েছেন এমন দিনও গেছে।

এই অত্যন্ত সাধারণ জীবন থেকে সাফল্যের মধ্য গগনে পৌঁছানোর পথে একবারের জন্যেও মানুষের সেবা করার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হননি। চূড়ান্ত কাজের মধ্যেও সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ব্যাপারে তাঁর খোঁজ রাখার মানসিকতা তাঁকে অনন্য করে তুলেছিল। একটা গল্প বলি এ প্রসঙ্গে। গল্পটি শুনিয়েছেন চণ্ডী লাহিড়ী।

“ডাঃ বিধান রায়কে চোখে দেখার ঢের আগে তাঁর কণ্ঠস্বর শোনার সুযােগ হয়েছিল। —আমি বিধান রায় বলছি। এটা লোকসেবক পত্রিকা? তখন আমি নাইট ডিউটি দিচ্ছি। প্রায় অবিশ্বাস্য ব্যাপার ! বিধান রায়ের গলা! পশ্চিমবঙ্গের রূপকার মুখ্যমন্ত্রী ফোন করলে টেলিফোন হাত থেকে পড়ে যাওয়ার কথা। ফোন চেপে বললাম—আজ্ঞে হ্যাঁ, এটা দৈনিক লোকসেবক। আপনি কোন বিধান রায়? উত্তরটা এল—আমি বিধান রায়। ডাক্তার। টেলিফোনটা হাত থেকে পড়ে না গেলেও আমার বিস্ময় সীমাহীন। বললেন, শােনাে, তোমাদের অফিসের এক রিপোর্টার একজন রােগী নিয়ে সকালে এসেছিলেন। যে ওষুধটা দিয়েছি সেটা বাজারে নেই। নতুন ওষুধ দিচ্ছি লিখে নাও। রাত প্রায় এগারোটা চিফ রিপোর্টার অমিত চক্রবর্তী এলেন। তাঁকে বললাম, বিধান রায় ফোন করেছিলেন। কেউ একজন তাঁর কাছে রোগী নিয়ে সকালে গিয়েছিলেন। একটা ওষুধ পালটে নতুন ওষুধ দিয়েছেন। অজিতবাবু বললেন, আমিই গিয়েছিলাম কাকাকে নিয়ে। —কিন্তু ডা. রায় ওষুধটা পালটে দিয়েছেন। সকালে যেটা দিয়েছিলেন সেটা বাজারে মিলছে না। সেজন্য  নতুন ওষুধ দিয়েছেন। নামটা লিখে রেখেছি। অজিতবাবু বললেন—রোজ পঞ্চাশ জন রোগীকে বিনা পয়সায় দেখেন। এই ভিড়ের মধ্যেও মনে রেখেছেন একজন রোগীর ওষুধের কথা, যে ওষুধ বাজারে নেই। রোগীর  নাম জানেন না। কেবল আমাদের অফিসটা জানেন। খবরটা দিয়েছেন। বড় ডাক্তার এমনি হয় না।”

ক্রিস্টোফার নোলান পরিচালিত বিখ্যাত ছবি ব্যাটম্যান বিগিন্স-এ একটি সংলাপ শুনেছিলাম- “If you make yourself more than just a man/if you devote yourself to an ideal/and if they can’t stop you/one day you will become something else/ a legend.” বিধান রায়ের ক্ষেত্রে এই কথাটি সবথেকে বেশি প্রযোজ্য। যেখানেই থেকেছেন মানুষের সেবা করার ধর্ম থেকে বিচ্যুত হননি কখনো।

১৯৩০। আলিপুর জেলে বিধান রায়। বললেন রাজবন্দির মর্যাদা নেবেন না, সশ্রম কারাদণ্ড নেবেন, আর শ্রম দেবেন জেল হাসপাতালের বন্দি রোগীদের দেখে। এরপর দেখা গেল বিরল দৃশ্য। বন্দি বিধান গম্ভীর হয়ে হাসপাতালে রাউন্ড দিচ্ছেন আর পেছন পেছন ফাইল হাতে জেলের সরকারি ডাক্তাররা। একদিন সরকারি ডাক্তাররা সময়মতো আসেননি। বিধান রায়ের রোগী দেখা শেষ। সরকারি ডাক্তার এসে বললেন ‘স্যর দেরি হয়ে গেল’। আর বিধান রায় স্মৃতি থেকে পর পর চল্লিশ জন রোগীর প্রেসক্রিপশন বলে গেলেন। সরকারি ডাক্তার লিখে নিলেন। শুধু তা-ই নয়, জেলে থাকাকালীন বরিশালের বিপ্লবী, জার্মানি থেকে যিনি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডক্টরেট করেছিলেন, সেই কানাইলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে বিধান রায় জার্মান ভাষা শিখেছিলেন।

কেবল ডাক্তারি বা প্রশাসনিক বিষয়ে নয়, বিধান রায় ইঞ্জিনিয়ার হিসেবেও কতটা দক্ষ ছিলেন তার একটা ঘটনা শোনানো যাক।

বিধান রায় ঠিক করলেন দুর্গাপুরে স্টিল প্ল্যান্টের পাশাপাশি সরকারেরও একটা সংস্থা দুর্গাপুর প্রজেক্টস লিমিটেড তৈরি করবেন তিনি। ইঞ্জিনিয়ারদের ডেকে বললেন ওই পরিকল্পনার একটা নকশা তৈরি করতে। তাঁদের দেড় মাস সময় দেওয়া হল। তাঁরা দেড় মাস পর একটা নকশা তৈরি করে এনে বিধানরায়কে দেখালেন। পছন্দ হল না মুখ্যমন্ত্রীর। বললেন, ঠিক হয়নি। নকশায় কিছু কিছু ত্রুটি উনি তখনই বের করে সেগুলি ঠিক করতে বললেন। একমাস পরে সংশোধিত নকশা বিধান রায়কে এনে দেখালেন ইঞ্জিনিয়ার। এটাও মনঃপূত হল না। বললেন, পুরােপুরি সঠিক হয়নি। এরপরেই নিজের দেরাজ থেকে একটি নকশা বের করে ইঞ্জিনিয়ারদের দেখালেন। তাঁরা তাে অত নিখুঁত নকশা দেখে উল্লসিত। নকশাটি বিধানবাবু নিজেই তৈরি করেছিলেন। বিধানবাবুর ডেপুটি সেক্রেটারি চোখের সামনে ওই ঘটনা দেখে থাকতে না পেরে মুখ্যমন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করেই ফেললেন, আপনার কাছে যখন এরকম একটা নিখুঁত নকশা আগে থেকেই ছিল, তাহলে বারবার ইঞ্জিনিয়ারদের ডেকে তা করতে বলছিলেন কেন? এতে কি সময় নষ্ট হল না? উত্তরে বিধানবাবু বললেন “আরে বাবা কাজটা তাে আর আমি গিয়ে করে দিয়ে আসতে পারব না! তাই ইঞ্জিনিয়ারদের ডেকে ভুলগুলো ধরিয়ে দিলাম, যাতে কাজটা ওরা ঠিকঠাক করতে পারে।”

ব্যক্তি হিসেবে ডাঃ বিধান রায় অত্যন্ত স্বাধীনচেতা ছিলেন তাঁর ইঙ্গিত তিনি ছাত্র জীবন থেকেই দিয়ে এসেছেন। 

ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল স্কুলে শিক্ষকতা করাকালীন সুপারিনটেনডেন্ট মেজর রায়েত এর সাথে বিধান রায়ের নানান বিষয়ে সমস্যা লেগেই থাকত। রায়েত আসলে অত্যন্ত নাকউঁচু ইংরেজ ছিলেন যিনি সর্বদা ভারতীয়দের নিচু চোখে দেখে এসেছেন। তো বিধান রায়ের সাথে নানান বাকবিতন্ডার পর উনি অবশেষে সিদ্ধান্ত নেন উনি পদত্যাগ করবেন কারণ ওনার মনে হয়েছে এই স্কুলে ওনার থেকেও বেশি যোগ্যতার শিক্ষক রয়েছেন যাঁরা সুপার হিসেবে বেশি যোগ্য। তো উনি একদিন বিধান রায় কে ডেকে জিগ্যেস করলেন- আচ্ছা তোমার কি আমাকে খুব বোকা মনে হয়?
বিধান রায়- এ প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারব না। মাফ করবেন।
রায়েত- কেন?
বিধান রায়- যদি আমি হ্যাঁ বলি আপনি তাতে অপমানিত হবেন। যদি আমি না বলি নিজের কাছে নিজেই ছোট হয়ে যাব। তাই এই প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারব না।

ছাত্রজীবনের শুরুতে বিধান রায় বেশ মুখচোরা ছিলেন। কিন্তু সময় যত গেছে তত ধীরে ধীরে ভাবনা, বক্তব্যে আরও সাবলীল হয়েছেন। যেকোন বড় মানুষের প্রধান চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তাঁর প্রখর আত্মসম্মান বোধ। বিধান রায়ও ছোট থেকেই তাঁর আত্মসম্মান বোধ সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। যেখানেই তাঁর মর্যাদায় সামান্য ঘাটতি দেখেছেন অমনি গর্জে উঠেছেন। এ বিষয়ে বিধান রায়ের সাথে ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল স্কুলের সুপারিনটেনডেন্ট মেজর রায়েত এর একটি কথোপকথন উল্লেখযোগ্য। বিধান রায় তখন ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল স্কুলের শিক্ষক। মেজর রায়েত বিধান রায়ের অনমনীয় মনোভাবের কারণে বেজায় চটে ছিলেন তাঁর ওপর। একদিন ডাঃ বিধানের নামে একটি নোট পাঠান উনি। তাতে উনি উল্লেখ করেন কাল থেকে প্রতিদিন ডাঃ রায় কে আ্যনাটমি বিভাগে রাত বারোটা থেকে দুপুর তিনটে অবধি উপস্থিত থাকতে হবে। বিধান নোটটি পড়ে সোজা মেজরের ঘরে গিয়ে বললেন- আমি কি এই নোটে যা নির্দেশ আছে তার আক্ষরিক অর্থ ধরব নাকি এর মর্মার্থ যা বলতে চাওয়া হয়েছে সেটা ধরব?
রায়েত বললেন – অবশ্যই নির্দেশে যা বলা আছে হুবহু তাই।
ডাঃ রায় উত্তরে যা বললেন কোন হিট সিনেমার হিট ডায়লগ হতে পারত অনায়াসেই। 
কিন্তু আমরা যখন কোন থার্ড ক্লাস ঠিকা গাড়ি ভাড়া নিই তখন ঘন্টা হিসেবে ভাড়া গুনি কিন্ত ট্যাক্সি ধরলে ভাড়ার হিসেবটা তখন কতটা দূরত্ব গাড়িটি কভার করল সেই হিসেবে ভাড়াটা গুনি। তেমনি আপনি যখন কোন পিওন বা বেয়ারা কে আ্যপয়েন্ট করেন তখন তার কাজের হিসেব হয় ঘন্টা ধরে, কিন্তু আপনি যখন একজন এফ.আর.সি.এস এম.আর.সি.পি ডাক্তার যিনি কিনা এই স্কুলের একটি ডিপার্টমেন্টের চার্জে আছেন তাঁর কাজের বিচার হবে কত ঘন্টা  দিয়ে নয় তাঁর দক্ষতা দিয়ে।
মেজর রায়েত তাঁর সিদ্ধান্তে কিন্তু অনড়ই থাকলেন।  এর কিছুদিন পর রায়েত বিধানকে একটি চিঠি পাঠান এই অনুরোধ করে তিনি প্রত্যেকদিন বিকেল চারটে থেকে পাঁচটা সার্জিক্যাল বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের ক্লাস নিতে পারবেন কিনা। বিধান রায় চিঠিটা পড়ে ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে দেন। 
চিঠির কোন উত্তর না পেয়ে মেজর রায়েত আ্যনাটমি বিভাগে এসে ডাঃ রায় কে সামনে পেয়ে জিগেস করলেন – তোমাকে একটা চিঠি যে পাঠালাম তার কোন উত্তর দিলে না কেন?
বিধান  মুখ না তুলেই উত্তর দিলেন – চিঠিটা তার যেখানে যাওয়ার কথা সেখানে গেছে বলে উত্তর পাননি।
রায়েত – কোথায় যাওয়ার কথা ওর?
বিধান – ডাস্টবিনে।
রায়েত –  কেন?
বিধান –  আপনিই আমাকে বলেছেন আপনার দেওয়া নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে। আমি তাই করছি। আমার ডিউটি আওয়ার রাত বারোটা থেকে দুপুর তিনটে। এরপর বাকি সময়টা আমার ব্যাক্তিগত সময়। সেখানে আমি আপনার অর্ডার মানতে বাধ্য নই।
রায়েত – তুমি কিন্তু তোমার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছ!
বিধান – যদি তাই হয় আমি সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের থেকে আমার সীমার ব্যাপারে কথা বলতে প্রস্তুত।
রায়েত এরপর আর কথা বাড়াননি।

বিধান রায় কেবল একজন চিকিৎসক, একজন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন না। এগুলি একেকটা পদ, একেকটা পেশা। এর আড়ালে থাকা মানুষটার ওপর নির্ভর করে এই খোলসগুলোর মাহাত্ম্য। বিধান রায়ের মৃত্যুতে বাংলা যেটা হারালো তা একজন অবিশ্বাস্য দক্ষতার চিকিৎসক কিংবা কর্মঠ মুখ্যমন্ত্রী শুধু নয়, মানুষের হিতার্থে নিবেদিত এক প্রাণকে যিনি এক হাতেই বাংলার স্বাস্থ্য তথা বাঙালির স্বাস্থ্যের পুনরুদ্ধারের জন্য নিজেকে সমর্পণ করে দিয়েছিলেন। 


তথ্যসূত্র:


2 Comments

  1. শংকর হালদার

    ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়ের সাহিত্য কর্ম নিয়ে কিছু আলোচনা হয়নি। চার টির জন্য বিখ্যাত লেখক।

  2. Jyotsna Das

    আপনার লেখা টা পড়ে ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের ব্যাপারে অনেক কিছু জানতে পারলাম। ভালো লাগলো। আমি শুনেছি উনি নাকি AIIMS কলকাতায় হতে দেয়নি এটা সত্য কি না জানি না । সত্যি টা জানতে ইচ্ছুক আছি।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।