মোচার ঘণ্ট

লেখক: শুভদীপ চক্রবর্তী

সোমবার অফিসে এসে সুজিতবাবু দেখলেন আজ কাজের চাপটা একটু বেশি। অবশ্য এটা তাঁর কাছে নতুন কিছু নয়। দীর্ঘ ২০ বছরের বহুজাতিক সংস্থার চাকরি জীবনের বেশিরভাগটাই তাঁর ব্যস্ততাতেই কেটেছে।

সুজিতবাবু অকৃতদার মানুষ। বাবা মা উভয়েই গত হয়েছেন আজ ১০-১২ বছর হল। নিজের কাজকে ভালবেসে আর কোনদিকেই মন দেওয়া সম্ভব হয়নি। অফিস থেকে বেলেঘাটার ফ্ল্যাটটায় শুধু যান একটু রাতে ঘুমাতে। এই এত বছরে তিল তিল করে নিজের একটা ভাল অবস্থান গড়ে তুলেছেন অফিসে। তার জন্য যখন যা করতে হয় করেছেন। সেটা বসের পদলেহন হোক, অথবা অফিসের রাজনীতিতে অংশ নিয়ে অন্যের অধিকার হনন। লোকে তাঁকে স্বার্থপর মনে করলেও তাতে তাঁর কিছু যায় আসে না, তাঁর পাখির চোখ শুধুমাত্র এই অফিসের ম্যানেজার পদ।

আজ অফিসে আসার সাথে সাথেই বস ডেকে পাঠালেন। যা বললেন তাতে এটাই বোঝা গেল যে এই প্রজেক্টের একটা বিশাল সমস্যা হয়েছে যার সমাধান খুঁজতে না পারলে প্রচুর টাকার লোকসান হয়ে যাবে। এবং বরাবরের মত বস তাঁর ওপরেই ভরসা রাখছেন এই সমাধান খোঁজার জন্য। ১ মাস সময় দিয়েছেন। তিনি নিজের জায়গায় ফিরে এলেন মাথার অপর একরাশ কাজের বোঝা নিয়ে। সবে কাজটা শুরু করতে যাবেন, তখনই হঠাৎ চোখ পড়লো একটি নতুন ছেলে তাঁর ডেস্কের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

“কী ব্যাপার, কিছু কাজ ছিল আমার সাথে?”, জিগ্যেস করলেন তিনি।

“আমার নাম মনোজ, আজ নতুন জয়েন করেছি। বস বললেন আপনার কাছে ট্রেনিং শুরু করতে। ১৫ দিনের ট্রেনিং সম্পূর্ণ করে তবে কাজে বহাল হতে পারব আমি।”

একটু বিরক্ত হলেন সুজিতবাবু। ভাবলেন এটা আবার একটা উটকো ঝামেলা হল। যাই হোক, আদেশ যখন এসেছে মানতে তো হবেই।

“শোনো, তোমাকে ধরেবেঁধে কাজ শেখানোর সময় তো আমার হবে না, তাই যখন যেমন আমি কাজ করছি তুমি দেখতে থাকো। নিজেই শিখে যাবে।”

এতেই বিগলিত হয়ে ছেলেটি বসে পড়লো। একদৃষ্টে দেখতে লাগল সুজিতবাবুর কাজ। মাঝে মাঝে একটু আলাপচারিতাও করতে লাগল। যদিও সুজিতবাবুর বিন্দুমাত্র উৎসাহ ছিল না, তাও ভদ্রতার খাতিরে টুকটাক তাকেও কথা চালাতে হচ্ছিল। জানা গেল মনোজ তার মায়ের সাথে কসবায় একটা ভাড়া বাড়িতে থাকে। বিয়ে হয়নি, বাবা গত হয়েছিলেন মনোজের ছোটবেলাতেই। অনেক কষ্টে এই চাকরিটা সে জোগাড় করেছে।

এসব বলতে বলতেই লাঞ্চের সময় হয়ে গেল। চিরদিন সুজিতবাবু একাই ক্যান্টিনে গিয়ে খান। কিন্তু আজ মনোজও পিছু নিল। ক্যান্টিন থেকে কেনা পরোটা আর ডিমের ঝোল নিয়ে বসতে গিয়েই সুজিতবাবু দেখলেন মনোজ তার বাড়ি থেকে আনা রুটি আর মোচার ঘণ্ট টিফিন বাক্স থেকে বের করছে।

সুজিতবাবুকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মনোজ বলল, “স্যার একটু চেখে দেখুন না, আমার মায়ের বানানো।”

“না না এই তো আমার খাবার আছে, তুমি খাও।” একটু লজ্জা পেলেন সুজিতবাবু।

“আরে স্যার কিছু হবেনা, খান না। একসাথে এসেছি যখন মিলেমিশেই খাই।”

দোনোমনো করেও মোচার ঘণ্ট একটু মুখে তুললেন তিনি। অপূর্ব স্বাদ, অনেকদিন এরকম বাড়ির রান্না খাননি। চেখে দেখার অছিলায় যেন একটু বেশি খাওয়া হয়ে গেল। মনোজের সাথেও একটু একটু করে গল্প করতে শুরু করলেন তিনি। জানা গেল তাদের দুজনেরই স্কুল কলেজে পড়াকালীন গান বাজনার সখ ছিল। এমনকি তাদের প্রিয় গায়কও এক। আরো অনেক কিছু বিষয়ে দুজনেরই আগ্রহ থাকায় গল্প বেশ জমে উঠল।

আজ লাঞ্চের পর কাজের চাপ বেশি থাকলেও ক্লান্ত বোধ করলেন না সুজিতবাবু। মোচার ঘণ্টের স্বাদটা যেন মুখে লেগে আছে। মনোজের সাথে কথা বলা আর কাজের মাঝখান দিয়েই সময়টা কেটে গেল। খুব সহজেই যেন আপন করে নিতে পারে ছেলেটা।

ধীরে ধীরে বেশ একটা প্রাত্যহিক রুটিনেই দাঁড়িয়ে গেল যেন এটা। সারাদিন মনোজের সাথে টুকটাক গল্প, আর দুপুরে টিফিন ভাগ করে খাওয়া। বেশ ভালোই কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো তাঁর। মনোজও প্রায়শই মোচার ঘণ্ট আনত তাঁর পছন্দ আন্দাজ করতে পেরে। এর মধ্যে মনোজের ট্রেনিং শেষ হয়ে সে কাজে বহালও হয়ে গেছে। তাও দিনে অন্তত একবার লাঞ্চের সময় সুজিতবাবুর সাথে মনোজের আড্ডা হবেই হবে। সারাদিন পরিশ্রমের পর জিভে লেগে থাকা ওই মোচার ঘণ্টের স্বাদটাই যেন তাঁর দিনটা ভাল করে দেয়।

ইতিমধ্যে বসের দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ কাজটাও তিনি শেষ করে এনেছেন। আজকেই জমা করে দেবেন। আর তারপর একটা পদোন্নতি তো এবার পাকা, এটা মনে মনে চিন্তা করে অফিসে বসেই তার মুখে একটা হাসির রেখা ছড়িয়ে পড়লো। এসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ দেখলেন মনোজ একদিকে কেমন থমথমে মুখ নিয়ে বসে আছে। দূর থেকে দেখেই তিনি বুঝতে পারলেন কিছু একটা হয়েছে মনোজের। এগিয়ে গেলেন তিনি মনোজের দিকে।

“কী ব্যাপার কিছু হয়েছে নাকি? আজ লাঞ্চের জন্য ডাকতেও এলেনা এখনো?”

“বস সব নতুন কর্মীদের ডেকেছিলেন। বললেন এই সংস্থা আর এতজন নতুন কর্মীদের রাখতে পারবেনা। ৩ দিন সময় দিলেন, তার মধ্যে যারা নতুন কোনও কাজের proposal আনতে পারবে যেটা সংস্থার পক্ষে লাভজনক হবে তারাই থাকবে, বাকিদের চাকরি যাবে।” একটু ইতস্তত করে বলল মনোজ।

“হুমমম” এর বেশি আর কী বলবেন ভেবে পেলেন না সুজিতবাবু। ফিরে এলেন নিজের জায়গায়। খুবই ভেঙ্গে পড়েছে মনোজ। আসলে চাকরিটা ওর খুবই দরকার। এসব ভেবে তাঁরও আজকে কেন জানি মনের ভেতরটা আনচান করছে। কোনোদিন কারোর জন্য এভাবে ভাবেননি তিনি। এরকম কত লোকের চাকরি তো তিনি নিজেই খেয়েছেন এত বছরের চাকরি জীবনে শুধুমাত্র নিজের লাভের কথা ভেবে। মনকে এভাবেই এত বছর শক্ত করেছেন যাতে শুধুমাত্র নিজের উন্নতির কথা ভাবতে পারেন। তবে আজ কেন এরকম লাগছে বুঝতে পারছেন না।

কিছুক্ষণ পরে আবার মনোজের কাছে গেলেন সুজিতবাবু।

“মনোজ, মন দিয়ে আমার একটা কথা শোনো। বস আমাকে যে কাজটা দিয়েছিলেন, এগুলো হল তার সব কাগজপত্র। তুমি একটু পরে বসের কাছে গিয়ে বলবে যে আমি তোমাকে এই কাজটার requirements brief করেছিলাম, আর তারপর তুমি এটার solution টা করেছ।”

“কী বলছেন স্যার, মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি আপনার? এগুলো আপনার এত পরিশ্রমের কাজ, আমি কীকরে নিয়ে নিতে পারি?” চমকে উঠল মনোজ।

“শোনো, আমাকে এতদিনের আলাপে যদি একটু দাদার মত মনে করতে পারো, তাহলে সেই অধিকারেই তোমাকে বলছি তুমি এটা নাও। আমার এটা দিয়ে দেওয়ায় এমন কিছু ক্ষতি হবেনা, কিন্তু তোমার চাকরিটা বেঁচে যাবে।” নাছোড়বান্দা সুজিতবাবু।

আর না করতে পারল না মনোজ। সুজিতবাবু চলে আসার আগে ওকে বলে এলেন, “আমি আজ একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যাচ্ছি, কাল আবার লাঞ্চে দেখা হবে।”

হাফ ডে ছুটি নিয়ে আজ বাড়ির দিকে চললেন সুজিতবাবু। সারাদিন কিছু খাওয়া হয়নি আজকে তাঁর।

তবু বাড়ি ফেরার সারাটা রাস্তা ঠোঁটে একটা তৃপ্তির হাসির সাথে জিভে যেন মোচার ঘণ্টের সেই চেনা স্বাদটা লেগে রইলো!


লেখকের কথা: শুভদীপ চক্রবর্তী
পেশায় টেক্সাস,মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তে কর্মরত সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার কিন্তু নেশায় শখের গায়ক। আর লেখালেখিটা শুধুমাত্র স্পর্ধাই বলা যায়। গান অথবা লেখালেখি কোনটাই ভাল পারি কিনা জানি না, কিন্তু ভালবেসে করতে পারি।

13 Comments

  1. অর্ণব সরকার

    খুব ভা‌লো সুভদীপ, পেশার সা‌থে সা‌থে নেশা গু‌লো ও চা‌লি‌য়ে যাউ। 👌🏻👌🏻

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।