বাবার বড় হজ

লেখক : এহছানুল মালিকী

মোয়াখালী ইসলামী ব্যাংক থেকে নেমে আমতলীতে রিকশার জন্য অপেক্ষারত বাবা আর রুমকি। হঠাৎ তাদের চোখের সামনে দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাল্গুনী লাল রঙয়ের সিংগেল ডিগার বাসটা চলে যাচ্ছিল। রুমকি বাবার কবজিটা আলতো করে ধরে নরম সুরে বলতে লাগলো, ইস্ বাবা আমার আর এই বাসটিতে চড়া হলো না। গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘ ইউনিটের রেজাল্ট দিয়েছে। আর্টসের ছাত্রী রুমকির খ ও ঘ ইউনিটের কোনটিতেই হয়নি। সচিবালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণী কর্মচারী রমিজ উদ্দিন। নিজে বেশি দূর পড়ালেখা করতে পারেননি। স্বপ্ন ছিল একমাত্র সন্তান রুমকি তার অফিসের পাশাপাশি অবস্থিত ক্যাম্পাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করবে। বুক ফুলিয়ে অফিসের সবাইকে জানান দিবে, আমার একমাত্র মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করে। দীর্ঘনিঃশ্বাস আর চোখের কোনে লোকানো পানি রেখে মেয়েকে সান্ত্বনা দিলেন, ইনশাল্লাহ এই গাড়িতে তুইও চড়বি। মেয়ে বাবার সান্ত্বনা মাখা কথা বুঝতে পেরেও বাবার সাথে তাল মিলালো ইনশাল্লাহ।

দুই দিনপর হঠাৎ রমিজ উদ্দিন অফিস থেকে বারোটার ভিতর বাসায় ফিরলেন, সাথে একটি ফরম ও ৫০/৬০ পৃষ্ঠার একটি বই এনে রুমকিকে ডাকতে লাগলেন। হঠাৎ তাড়াতাড়ি ফিরে আসা ও এইভাবে মেয়েকে ডাকাডাকিতে বাড়ির গৃহিনী রোজিনা ভয় পেয়ে গেলেন। দৌড়ে দু’জন রমিজ উদ্দিনের সামনে এসে হাজির। কোন কথা না বলেই তিনি রুমকিকে বলতে লাগলেন, তাড়াতাড়ি এই ফরমটা ফিলাপ কর আর তোর দুই কপি ছবি ও সার্টিফিকেটগুলোর ফটোকপি আমাকে দে। আজই ফরমটা জমা দিতে হবে। সামনের শুক্রবার তোর ভর্তি পরীক্ষা।

রুমকি এক পলক ফরমটা দেখে কান্না শুরু করে দিল। বাবা এটা তুমি কি করলা? উর্দু বিভাগ। এটা আমি কি ভাবে পড়বো? আর এটা পরে আমি ভবিষ্যতে কিইবা হতে পারবো? রুমকির সাথে সাথে রোজিনাও রমিজ উদ্দিনকে ধমকাতে লাগলেন। এবার রমিজ উদ্দিন রুমকির মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, মা সাবজেক্ট ডাজ নট মেটার? আমি খুঁজ নিয়ে দেখেছি, এই বিভাগ থেকেও বিসিএস, ব্যাংকে জব ও প্রশাসনের অনেক জায়গাতে ছাত্ররা জায়গা দখল করে রয়েছে। ইংরেজি বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীদের যেমন সুযোগ সুবিধা রয়েছে তেমনি এই উর্দু বিভাগেরও সমান সুযোগ রয়েছে। মোটামোটি ভালো করে এই বিভাগ থেকে বের হবি আর অন্যান্য বিষয়ে ভালো দখল রাখবি দেখবি, চাকরিতে তোরে কে ঠেকায়। আর আমার দোয়া সব সময় তোর সাথে রয়েছে। রুমকি ফরম ফিলাপ করে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রগুলো বাবার হাতে ধরিয়ে দিলো। বাবা সবকিছু পেয়ে ৫০/৬০ পৃষ্ঠার বইটি রুমকিকে দিয়ে বললো, আর বাকি কয়েকটা দিন রাতদিন খেটে বইটির এ টু জেড শেষ করে ফেল। এর থেকেই পরীক্ষার প্রশ্নগুলো হবে। আবারো মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন, তোর লাল গাড়িতে চড়ার স্বপ্নটা পূরণ হবেই।

বাবার আর্শীবাদে রুমকি উর্দু বিভাগে ত্রিশজন ছাত্র-ছাত্রীর ভীতর দশম স্থান অধিকার করে। যথারীতি বাবা সার্বিক সহযোগীতায় রুমকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রিকৃত একজন ছাত্রী হয়ে গেলো। মোয়াখালী স্টাফ কোয়াটারে বাসা হওয়ার দরূন এখন তার আসা যাওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাল বাসেই নিয়মিত হয়ে যায়। প্রায়ই বাবা অফিস থেকে ফিরে যখন দেখেন তার মেয়ে বাসায় এখনো ফিরেনি, তখন তিনি মেয়ের অপেক্ষায় বাসায় বসে না থেকে বাস স্টপে চলে যেতেন। লাল গাড়ি থেকে মেয়েকে নামতে দেখলে তিনি পুরোনো স্মৃতি মনে করে আবেগ প্রবল হয়ে যেতেন। মেয়েও বাবার জীবন্ত মুর্তির দন্ডায়মান দেখে দৌড়ে তার বুকে ঝাপিয়ে পরতো আর বলতো, বাবা বৃক্ষ তুমি আমাকে এভাবেই আগলে রেখো চিরকাল।
রমিজ উদ্দিন আজ মাস দুয়েক হলো রিটায়ের্ড করেছেন আর রুমকিরও অনার্স ফাইনাল শেষের দিকে। এখন তারা ফার্মগেটে ভাড়া বাসায় থাকে। তথাপি বাসের রোড বদলেছে কিন্তু লাল বাসে চলাচল রুমকির আগেই মতোই রয়েছে। হঠাৎ একদিন রুমকি বাবা ও মাকে সুসংবাদ দিলো, শাহবাগ রেডিও বহিঃবিশ্ব কার্যক্রমে উর্দু ভাষায় সংবাদ উপস্থাপনার জন্য তার নিয়োগ হয়েছে। কিন্তু বিপত্তি হলো, রাত আটটা থেকে দশটা পর্যন্ত কাজ। কীভাবে কী করবে তা নিয়ে সে চিন্তিত। বাবা মহাখুশি বললেন, আমার মেয়ে বাংলাদেশ বেতারে চাকরি করতে পারবে না শুধু মাত্র রাতের প্রোগ্রামের কারণে তা কোন ভাবে মেনে নেওয়া যায় না। এই নিয়ে তোর কোন চিন্তা করতে হবে না, তোর বাবা এখনো বেঁচে আছে। তুই এগিয়ে যা। টানা দু’বছর মেয়ে ভীতরে প্রোগ্রামে ব্যস্ত থাকতো আর রমিজ উদ্দিন বাইরে ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে পোকা-মাকড়, মশার যন্ত্রনাকে প্রশ্রয় না দিয়ে মেয়ের জন্য অপেক্ষায় থাকতেন। বুক ফুলিয়ে বাহিরে বন্ধুদের সাথে গর্ব করতেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যারয়ের উর্দুতে পড়ুয়া মেয়ে তার বাংলাদেশ বেতারের সংবাদ পাঠক।

তিনজনের সুখের সংসারে হঠাৎ দু:খের ঘনঘটা নেমে আসে। পঞ্চাশ বছর পার না হতেই রোজিনা হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে একদিন চির নিদ্রায় চলে যায়। অসহায় রমিজ উদ্দিনকে আত্মীয় স্বজন থেকে শুরু করে পাড়া প্রতিবেশী পর্যন্ত আরেকটি বিবাহের জন্য পরামর্শ দেয় কিন্তু রমিজ উদ্দিন রুমকির দিকে তাকিয়ে একা বেঁচে থাকার প্রয়াস পান। একমাত্র সম্বল পেনশনের টাকায় বাবা মেয়ের ভালোই দিন কাটছিল। রোজিনা মার যাওয়ার এক বছরও অতিক্রম হলো না। একদিন বিকেল বেলা রমিজ উদ্দিন ঘরের বারান্দায় বসে গল্পের বই পরছিলেন। বাহিরে কলিংবেল বাজতেই বুঝতে পারলেন মেয়ে বাহির থেকে ফিরেছে। দরজা খুলতেই তিনি হতবাক। মেয়ে বৌ সেজে গলায় গোলাপ রজনীর মালা পরে তার সামনে দাঁড়িয়ে আর পাশে পাঞ্জাবী পায়জানা পরা সুঠাম দেহী একটা যুবক দাঁড়িয়ে।

অভিজ্ঞ সম্পন্ন রমিজ উদ্দিনের আর বুঝার কিছু বাকি রইলো না। মাথায় যেনো আকাশ ভেঙ্গ পরলো। মুখ দিয়ে তিনি আর কোন কথা বলতে পারছিলেন না। দু’জনেই রমিজ উদ্দিনের পা ধরে সালাম করলো। মেয়েও বাবাকে কাবু করার হাতিয়ার ভালই রপ্ত ছিল। বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো, বাবা আবিরকে আমি ভালোবাসি, আমরা বিয়ে করে ফেলেছি। প্লিজ আমাকে মাফ করে দাও। বাকরুদ্ধ বাবা মেয়ে ও মেয়ের জামাই নিয়ে নিজ বাড়িতে দুইদিন অতিবাহিত করার পর জানতে পারলেন আবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ছাত্র। সে ও তার মেয়ে একই বর্ষের ছাত্রী। তবে ছেলে একটা প্রাইভেট কম্পানীতে ক্যাশিয়ার হিসেবে চাকরি রত রয়েছে। তার মা ডাক্তার ও বাবা আর্মির কর্ণেল। বাড়িতে ইন্টারে পড়া ছোট একটা বোন ছাড়া আর কেহই নেই। ঢাকার বছিলায় নিজেদের একটা পাঁচতলা বাড়ি রয়েছে। বলা যায় শিক্ষিত ও স্বচ্ছল একটা পরিবার। তবে আবির জানায় তার বাবা মা অনেক কড়া মানুষ। এই বিয়ে তারা কোন ভাবেই মেনে নিচ্ছে না। তাই তারা ছেলে ও ছেলে বৌকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে। রমিজ উদ্দিন দেখলেন এইভাবে সময় ক্ষ্যাপন করে বসে থাকলে চলবে না। তার নিজেরই কিছু একটা করতে হবে। এরই মধ্যে নিজ বাড়িতে মেয়ে ও নতুন জামাই নিয়ে দুইদিন অতিবাহিত হয়ে গেছে। আশে পাশের লোকজন এই নিয়ে কানাঘোষা ও শুরু করে দিয়েছে। তাই নিজেই আজ সাহস সঞ্চায়ন করে সরাসরি আবিরের বাসায় হাজির হলেন।

অনেক তর্কাতর্কি অপমান, অপদস্ত হয়ে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, মেয়েকে দশ ভরী স্বর্ণ ও ছেলেকে পুরোপুরি সাজিয়ে দিয়ে তাদের সামাজিকতা রক্ষার্থে এক সপ্তাহের ভিতর ঢাকার সেনাকুঞ্জে অনুষ্ঠান করে মেয়েকে তুলে দিতে হবে। বড়লোক বাসায় রমিজ উদ্দিনের চিন্তা করে জবাব দেওয়ার সময়ও কম ছিল। পারবে কি পারবেনা হিসাবের অংকটা না কষেই তাদের জবাব দিয়ে দিলেন সে তাদের শর্তে রাজি। বাসায় ফিরে তিনি মেয়ে ও মেয়ের জামাইকে সব কিছু জানালেন। মেয়ে কান্না শুরু করে দিয়ে বললো, বাবা তুমি রাজি হলে কেন? এতো টাকা তুমি কোথায় পাবে? হঠাৎ নতুন জামাই শ্বশুরের মুখের দিকে তাকিয়ে সোজা সাপটা বলে ফেললেন, বাবা আমাদের স্টেটাস রক্ষার্থে এর বিকল্প আর অন্য কিছু নেই। আপনি আপনার পেনশনটা বেচে দিয়ে হলেও আমাদের কাজটা করে দেন। জামাইয়ের মুখ থেকে এ কথা শুনার জন্য রমিজ উদ্দিন মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। একবার আবিরের দিকে তাকিয়ে পরক্ষনে রুমকির জবাব শুনার জন্য তার দিকে তাকালেন। রুমকি মাথা নত করে চুপ করে রইলো। বাবা মেয়ের জবাব পেয়ে গেলেন।
চারদিন অনেক দৌড়াদৌড়ি, ঘুষ ও লোকসান গুনে পেনশসের সম্পূর্ণ টাকা তুলে আনলেন। হজের জন্য তিন লক্ষ টাকা আর তার নিজের বেঁচে থাকার জন্য মোট দশ লক্ষ টাকা রেখে মেয়ের শ্বশুরের কথা মতো সবকিছুই রেডি করলেন। তবে মেয়ের দশ ভরি স্বর্ণ হতে কিছু টাকা কম হচ্ছিলো। বুদ্ধি করে মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগে মোয়াখালী ইসলামী ব্যাংকে মেয়ের নামে প্রতি মাসে এক হাজার টাকার একটা ডিপিএস করেছিলেন। সেটা ভেঙ্গে সুন্দর ভাবে মেয়ের দশ ভরি স্বর্ণ ও হয়ে গেলো। খুব ধুমধাম করে সেনাকুঞ্জে মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান হয় কিন্তু মেয়ের বাবাকে মেয়ের শ্বশুর বাড়ির লোকজন অবজ্ঞা, তাচ্ছিল্ল ও অপদস্ত করতে তারা একটুও কার্পন্যতা দেখায়নি। স্টেজে বৌ সাজা মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রমিজ উদ্দিন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবকিছু হজম করলেন। শুধু বিদায়ের বেলা করোজোরে তাদের বললেন, দয়া করে আমার মা মরা মেয়েটাকে আপনারা দেখে রাখবেন।

এক মাস অতিবাহিত হয়ে গেল। মেয়ে, জামাই, তাদের কারোর সাথেই যোগাযোগ নেই। মেয়ের সাথে যাও দু’চারটা কথা হয়, তা কথা না বলার মতই। যখনই সুযোগ হতো শুধু এইটুকু বলতেন, মা মাস্টার্স’টা শেষ করিস। আমার কাছে থাকলে তো আমিই সেটা শেষ করিয়ে দিতাম। মেয়ে বাবার এই কথায় সব সময়ই চুপ থাকত। রমিজ উদ্দিনের কাছে মনে হতো মেয়ে যেনো কি কারণে তার সাথে মন খুলে কথা বলছে না। তাও তিনি মেয়ের জন্য প্রার্থনা ও হজের যাবার পস্তুতি মূলক বই পড়ে দিন কাটাতে লাগলেন।

তিন মাস পর হঠাৎ খুব সকালে মেয়ে বাবার বাসায় এসে হাজির। রমিজ উদ্দিন এত সকাল সকাল মেয়েকে ঘরোয়া জামা কাপড়ে এই বাড়িতে দেখে খুব ভয় পেয়ে গেলেন। নানান দুচিন্তা তার মাথায় ঘুর পাক খেতে লাগলো। মেয়েকে দেখে তার মনে হচ্ছে, এক মাস ধরে সম্ভবত সে খাবার দাবার ঠিক মতো খায়নি। চোখ দু’টো গর্তে ঢুকে গেছে। চুয়ালের হাড্ডিগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বিয়ের পর ওজন কম হলেও দশ পনেরো কেজি কমে গেছে। আমার মেয়েকে কি তারা তাহলে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে? রুমকি বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। বাবা বারংবার কি হয়েছে জিজ্ঞসা করলেও কান্না ছাড়া আর কোন আওয়াজ বের হচ্ছিল না। ঘন্টখানিক পর মেয়েকে সকালের নাস্তা সারিয়ে শুনেত পেলেন, বিয়ের প্রথম সপ্তাহ থেকে শাশুড়ির আদেশে সে পড়ালেখা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়েছে। বাড়ির কাজের মানুষের যাবতীয় কাজ তারই করতে হয়। ছেলে বাবা মার হাতে গড়া পুতুল। তাদের কোন কথার অবাধ্য সে হয় না। যেই কারণে আজ সে বাবার কাছে এসেছে তা হলো, প্রাইভেট কম্পানীতে পাঁচ লক্ষ টাকা আত্মসাতের দায়ে আবিরকে গতকাল রাতে পুলিশ তুলে নিয়ে গেছে। বড়লোক শ্বশুর-শাশুড়ি মেয়েকে সকাল সকাল বাপের বাড়ি পাঠিয়েছে তাদের ছেলেকে শ্বশুর যেন পাঁচ লক্ষ টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে আসে। রুমকির কথা শেষ না হতেই আবারো বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। বাবা আমার স্বামীকে তুমি ফিরিয়ে দাও।

রমিজ উদ্দিন কথা দিলেন, হজের টাকা সহ তার কাছে আর সারে নয় লক্ষ টাকা রয়েছে। তা থেকেই সে তার স্বামীকে মুক্ত করে আনবে। দুনিয়াতে তুই ছাড়া আমার আর কেই বা আছে? তোর চেহারাটা দেখলে আমি সবকিছু ভুলে যাই। সেই রাতেই মেয়ে, মেয়ে জামাইকে নিয়ে ঘরের ছেলে ও ছেলের বৌকে রমিজ উদ্দিন তাদের বাসায় নিয়ে আসেন। সকলের উপস্থিতিতে রমিজ উদ্দিনের মনে হলো জেল থেকে ছেলেকে ছাড়িয়ে আনার ভারটা সম্ভবত তারই ছিলো। এতো বড়ো কাজের উপহার স্বরূপ সৌজন্যতা তো দূরের কথা কৃতজ্ঞতাও তার কপালে জুটলো না। বিদায়ের বেলা আবারো দু’হাত করোজোর করে বলে আসলেন, দয়া করে আমার মা মরা মেয়েটাকে আপনারা দেখে রাখবেন।

ফোনে দু’একটা কথা ছাড়া রমিজ উদ্দিন মেয়েকে এক বছর ধরে দেখেন না। এইদিকে হজের সময়ও খুব কাছে চলে এলো। চিন্তা করলেন বছিলার কাছাকাছিতে তার হজ এজেন্সি। সেখানে আজ হজের সম্পূর্ণ টাকা জমা দিয়ে আসবেন। তার আগে মেয়ের শ্বশুর বাড়ি গিয়ে মেয়েকে দেখে আসবেন এবং হজের জন্য দোয়া ও বিদায় নিয়ে আসবেন। ফোনে মেয়েকে জানিয়ে দিলেন আজ তিনি এজেন্সিতে হজের টাকা জমা দিবেন, তার আগে মেয়েকে দেখতে তিনি আসতেছেন। অস্বচ্ছল বাবা যেটুকু সম্ভব তার থেকেও বেশি পরিমান হাত ভরে মেয়ের শ্বশুর বাড়ির দিকে রওনা হলেন। দুপুর বারোটা নাগাত রমিজ উদ্দিন মেয়ের শ্বশুর বাড়ির মূল ফটকের ভীতর ঢুকে গেলেন। গেটের দারোয়ান নির্র্ধিধায় গেট খুলে দিয়ে তার হাতের পেকেটগুলো সে নিজ হাতে নিয়ে নিলো। যতোই বাড়ির সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন ততই মেয়ের আর্তনাদ ও চিৎকার তার কানে ভেসে আসছিল। বাড়ির দু’তলায় উঠতেই তিনি কলিংবেল টিপার শক্তি হারিয়ে ফেললেন। স্পষ্ট রুমকির কন্ঠের আওয়াজ বাঁচাও বাবা বাঁচাও। পিছনে দারোয়ানের দিকে তাকাতেই দারোয়ান মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। তিনি আর এক মুহুর্ত দাঁড়িয়ে না থেকে সোজা নিচে চলে এলেন। কাকুতি মিনতি করে দারোয়ানের কাছে মেয়ের কান্নার কারণ জানতে চাইলেন।
দারোয়ান মাথা নিচু করে বলতে শুরু করলো- আজ কয়েকদিন ধরে ভাবীকে তারা খুব মারধর করতাছে। আবির ভাইয়ের জন্য একটা বাইক কিইনা দিতে ভাবীকে তার খুব চাপ দিতাছে।

রমিজ উদ্দিন চোখের পানি মুছতে মুছতে পেকেটগুলো নিজের হাতের নিয়ে গেটের বাহির চলে গেলেন। তার পকেটে ছিল সারে তিন লক্ষ টাকা। সন্ধ্যার আগেই পূর্বের ন্যায় পেকেট হাতে নিয়ে আবার তিনি ঐ ফটকে ঢুকলেন। তবে সাথে এবার একটা পিকাপ ভ্যান ছিলো। যথারীতি দারোয়ানের হাতে সকল পেকেট দিয়ে তিনি তাকে উপরে গিয়ে বাড়ির সকলকে নিচে নামতে বলার জন্য বললেন। এরই মধ্যে পিকাপ ভ্যান বিদায় হয়ে গেল। রুমকি, জামাই, তার ছোট বোন ও তাদের বাবা-মা নিচে নেমে এলেন। আবির খুশিতে আটখানা হয়ে এফজেডএস ভার্সন মডেলের বাইকে বসে গিয়ার চেপে চেপে আনন্দের হুংকার দিতে লাগলো। রুমকির মুখ ছাড়া আর কারোরই মুখে হাসি ফুয়ারা অবিশিষ্ট ছিলো না। মেয়ে দৌড়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো, বাবা তুমি বড় হজে যাবে না?

মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বাবা বললেন- এইতো আমার বড় হজ, আমার হজ হয়ে গেছে।


লেখক পরিচিতি : এহছানুল মালিকী
লেখক, গবেষক

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।