ভালোবাসার বৃষ্টি

লেখক : প্রিয়াংকা রাণী শীল

(১)

“চাঁদের আলোটা আজ বড্ড চোখ ঝলসানো,তাই না!” চিত্রাকে বললো রজত। বিছানায় শুয়ে চিত্রা তাকিয়ে আছে খোলা কাঠের জানালার দিকে। রজতের কথায় শুধু “হুম” শব্দ করে আর কোন উত্তর দিলো না। রজত আর একটু চিত্রার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলো , “কি হলো? কোন উত্তর দিচ্ছো না?” চিত্রা তখনও চুপ। চিত্রাকে এমন চুপ থাকতে দেখে একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে চিত্রার মুখটা নিজের দিকে ফেরালো রজত।

চিত্রাকে আজ দেখাচ্ছে দারুণ। দারুণ বলতে আহামরি তেমন কিছু নয়। তবে অন্যদিনগুলোর থেকে একটু আলাদা। মাথায় হালকা একটা খোঁপা আর তার সাথে গুঁজে রাখা বাগানের একটা দোলনচাঁপা। পরনে লাল রংয়ের নতুন মোটামুটি রকমের  একটা ভালো শাড়ি। রজত কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল চিত্রার মুখের দিকে। কপালের লাল টিপটার জন্য যেন ভয়ংকর রকমের সুন্দর দেখাচ্ছিলো রজতের কাছে।

রজত হঠাৎ চিত্রার চোখের কোণে জল আবিষ্কার করলো।
“কি ব্যাপার,তোমার চোখে জল?” জিজ্ঞেস করলো রজত।
“এমনি,কিছু না।” এড়িয়ে যেতে চাইলো চিত্রা। মুখটা আবার জানালার দিকে সড়াতে গিয়ে পারলো না। রজত দ্বিতীয়বার হ্যাঁচকা টান দিয়ে চিত্রাকে তার দিকে ফেরায়। চিত্রা এবার শোয়া থেকে উঠে বসলো আর হাতের আঙ্গুল দিয়ে চোখের কোণ থেকে জলটা সরিয়ে নিলো দ্রুত। রজত এবার উঠে চিত্রাকে পেছন দিক থেকে ধরে বললো,”কি হয়েছে, বলবে তো?”
“কিছু হয় নি।” চোখ মুছতে মুছতে বিছানা থেকে নেমে খোলা জানালাটার সামনে দাঁড়ালো চিত্রা। চাঁদটা আজ বড্ড সুন্দর দেখাচ্ছে। এদিক দিয়ে একটা পুকুরও আছে। পুকুরের জলে চাঁদটা এমনভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে যেন মনে হচ্ছে , দুটো চাঁদ একে অপরের সাথে সুন্দরের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। আজ বোধহয় পূর্ণিমা। চিত্রার মনে হলো তাই।

হঠাৎ পিঠে রজতের হাতের ছোঁয়া পেয়ে পিছনে তাকালো চিত্রা। রজত আজ একটা পাঞ্জাবী পড়েছে। এই প্রথমবার তাকে পাঞ্জাবীতে দেখেছে চিত্রা। রজত চোখে মুখে একটু বিরক্তির ছাপ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “তোমার হয়েছে টা কি?”
” কিছু না , ভাবছি……।”  একটু থেমে আবার বললো, ” কিভাবে যেন সবকিছু হয়ে গেল? বুঝতে পারছি না…………ঠিক হলো কিনা?”
রজত এবার বুঝতে পারলো । চোখমুখ থেকে বিরক্তি সরিয়ে নিয়ে বললো,” ভেবো না, সব ঠিক হয়ে যাবে একদিন।”
” নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে রজত। মনে হচ্ছে , তোমার জীবনে আমি না আসলেই ভালো করতাম। তাহলে আর তোমাকে সব ছাড়তে হতো না।”

চিত্রার নিজেকে অপরাধী ভাবাটা অনেক স্বাভাবিক।কিন্তু রজত কি করবে? এভাবে না হলে চিত্রাকে তার হারাতে হবে চিরদিনের মতো। সে এটা মানবে কি করে? অনাথ আশ্রমে বড়ো হওয়া এই মেয়েটাকে সে ভালোবেসেছে নিজের জীবনের থেকেও বেশি। তাই বাবা-মায়ের আপত্তি সত্ত্বেও  চিত্রাকে বিয়ে করেছে। সমস্যাটা যা হয়েছিলো তা হলো, চিত্রার এক মামা হঠাৎ করেই তার বিয়ে ঠিক করেছিল তাদের গ্রামে। এক রকম জোর করেই যেন বিয়েটা দেবেন উনি। তাই উপায় না দেখে তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে হয় তাদের। রজত ভেবেছিল, বিয়ে হয়ে গেলে বাবা-মা আর আপত্তি করবে না। হয়তো রাগ করবে। কিন্তু একদিন ঠিক হয়ে যাবে সব। কিন্তু সে তো আর হয়নি। চিত্রাকে বরণ করে নেয়নি রজতের মা। গতকালই তো ঘটেছে এ ঘটনা। শেষে কাল সারাদিন সারারাত কাটিয়েছে এক হোটেলে। কালরাত্রি ছিল বিধায় বুকিং করতে হয়েছে দুটো রুমের। গতকাল বিকেলে এই  মহল্লায় টিনের ঘরটি ভাড়া নিয়ে আজ উঠেছে চিত্রাকে নিয়ে। হাতে যা ছিল তা দিয়ে অগ্রিম ভাড়া দিয়েছে। ভাবতে লাগলো রজত,” সত্যিই তো, কি থেকে কি হয়ে গেলো!”

রজত তখন বললো, “পেছনের কথা ভেবে আর কি হবে? সামনের টা ভাবো………।”
চিত্রা এবার বললো, “সেটাও ভাবছি। ভাবছি বলেই তো ভয় লাগছে।”
” কি ভেবেছ ,শুনি?”
“ভাবছি……… চলবে কি করে? তোমার সামনে মাস্টার্স পরীক্ষা। আমারো অনার্স শেষ হয়নি। সংসারে কি খরচ কম! “
রজত এবার হাসে।
“তুমি হাসছো। আমি হাসির কি বললাম?” চিত্রার রাগ হয়।
রজত এবার হাসি থামিয়ে বলে, “হাসছি এই ভেবে, তুমি পাকা সংসারী হয়েছো।”
” ধ্যাত্ , তোমাকে কিছু বলাটাই বৃথা।” কিছুটা বিরক্ত হয় চিত্রা।
রজত এবার চিত্রাকে ধরে বলে,” ভেবো না, কিছু টিউশন পেয়েছি। আপাতত তাই করি। আশা করি , তোমার সংসারের খরচটা হয়ে যাবে।”
“টিউশন! তুমি টিউশন করবে! ” চোখ কপালে তুললো চিত্রা। বললো, “তোমার তো পড়াতে ভালো লাগে না বলেছিলে।”
“হুম। কিন্তু এখন করবো।………তোমার জন্য, আর তোমার সংসারের জন্য।”
” ধ্যাত্। তোমার যতো ফাজলামো। যেন সংসারটা তোমার নয়!!!”
দু’জনে হাসে। রজতের বুকে মাথা রাখে চিত্রা। দু’জনে তাকিয়ে থাকে চাঁদটার দিকে। চাঁদের আলোটা আজ বড্ড হিংসে করার মতো।

হঠাৎ হু হু করে একটা ভারী ঠাণ্ডা বাতাস বয়ে যায়। আর ওলোটপালট হতে শুরু করে বাহিরটা। খোলা জানালা দিয়ে আসা বাতাসে চিত্রার হালকা করে বাঁধা চুলের খোঁপাটা যেন খুলে যেতে থাকে। রজত চিত্রার দিকে তাকিয়ে থাকে। এ চিত্রাকে সে যেন দেখছে নতুন করে। মুহূর্তে টিনের চালে বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ শুরু হয়।খোলা জানালাটা দিয়ে বৃষ্টির জল আসতে থাকে। সেই বৃষ্টির জলে ভিজতে থাকে দু’জন। পেছনের সব ভুলে চিত্রা আর রজত উপভোগ করতে থাকে বৃষ্টিস্নাত এই রাত………তাদের প্রথম রাত্রি।

 

(২)

সকালে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার পর একটু রোদ দেখা গেল। চিত্রা তখন বাহিরের উঠোনের দড়িতে ভেজা কাপড়গুলো শুকোতে দেয়। আসার সময় সিঁড়ির পাশে দোলনচাঁপা গাছটা স্পর্শ করে যায়। বড্ড ভালো লাগে তার। দোলনচাঁপাগুলো বৃষ্টির জলে ভিজে এমনভাবে স্নাত হয়েছে যে বড্ড লোভ লাগছে চিত্রার, হচ্ছে হিংসেও। ভাবছে ,” ইস্, যদি একটু ভিজতে  পারতাম এমনভাবে।”

দিনটা ছুটির দিন বলে চিত্রা আজ আর ভার্সিটি যায় নি। রজত বাসায় নেই । এই ছুটির দিনেও সে টিউশন করে। বাসায় ফিরতে ফিরতে হয়ে যায় সন্ধ্যা। সামনে তার মাস্টার্স ফাইনাল । পরীক্ষার ফি সহ আনুষঙ্গিক খরচ যোগাতে এই বাড়তি টিউশন। চিত্রা নিজেও দুটো টিউশন করে। এতে অন্তত তার খরচটা হয়ে যায়। রজত অবশ্য প্রথম দিকটায় রাজি না হলেও পরে হ্যাঁ বলেছে।

মহল্লায় তারা এসেছে আজ প্রায় তিন মাস হতে চললো।  কিভাবে কিভাবে যেন দিনগুলি পার হয়ে গেলো!!!  খোলা কাঠের জানালার কাছে রাখা একটা চেয়ারে বসে ভাবতে লাগলো চিত্রা। পুকুরটা বৃষ্টির জলে বেশ টইটুম্বুর হয়ে আছে। একটু পরপরই  একটা ঠাণ্ডা  হাওয়া এসে গায়ে লাগে চিত্রার। চিত্রার তখন মনে হয় পুকুরের ঐ পাড় ছেড়ে দূর-বহুদূর থেকে বুঝি ছুটে আসা বাতাস তারই স্পর্শের জন্য অপেক্ষা করে থাকে সারাক্ষণ।

ইদানীং রজতের জন্য বেশ খারাপ লাগে চিত্রার।  যে কোনদিন স্টুডেন্ট পড়াতে চাইতো না সে আজ প্রচুর স্টুডেন্ট পড়ায়।সেদিন রাত্রে বিছানায় শুয়ে রজতকে সে জিজ্ঞেস করেছিল,” তোমার স্টুডেন্ট পড়াতে অনেক কষ্ট হয়, তাই না।”
” কেন?” রজত জিজ্ঞেস করেছিল।
” তোমার তো স্টুডেন্ট পড়াতে ভালো লাগে না। তাই………”
“এখন অনেক ভালো লাগে। টিউশন করাতে গিয়ে অনেক কিছু শিখেছিও। সামনের চাকরির পরীক্ষাগুলোতে অনেক কাজ দেবে।” বলতে বলতে অন্য পাশে ফিরে গিয়েছিল রজত।
চিত্রা ভাবতে থাকে ,” জীবন মাঝে মাঝে মানুষের মাঝে কত পরিবর্তনই না এনে দেয়! বদলে যাওয়া পরিবেশ , পরিস্থিতিতে মানুষ কত কঠিন অনভ্যাস গুলোকেও অভ্যাসে পরিণত করে নেয়।”

এই যখন ভাবছিলো চিত্রা তখনই ওর ফোনটা বেজে উঠে। কাছে গিয়ে দেখে রজত ফোন করেছে।
” হ্যালো, রজত।”
“হুম,কি করো?”
“কিছু না।”
” সামনের রাস্তায় চায়ের দোকানটার ওখানে আসো।”
” তুমি কোথায়?”
” আমি ওখানেই আছি।”
” টিউশনে যাও নি?”
” গিয়েছিলাম। স্টুডেন্ট আজ পড়বে না। “
” তাহলে তোমাকে ফোন করে বলতে পারলো না? এত কষ্ট করে গেলে!!!”
” আচ্ছা………এখন আসো। আমি আছি এখানে।”
রজত ফোনটা ছেড়ে দেয়। চিত্রা পরনের শাড়িটা পালটাতে পালটাতে মনে মনে বলতে থাকে,” আগে থেকে বলে দিলেই পারে পড়বে না। কষ্ট করে যায়, আবার ফিরে আসে।” ভারি রাগ হয় চিত্রার।

চায়ের দোকানটায় তেমন ভিড় নেই। সামনের লম্বা টুলটাতে রজত চিত্রাকে নিয়ে বসে।
” হঠাৎ এখানে ডাকলে………”
” এমনি। কি খাবে বলো?”
” যা খুশি।”
” মন খারাপ।” বলতে বলতে রজত দু’কাপ চায়ের অর্ডার দিলো। সাথে বিস্কিট।
” না।”
” বলো না কি হয়েছে?”
” তোমার অনেক কষ্ট হচ্ছে , তাই না রজত।”
” ওসব রাখো।” ততক্ষণে চা চলে এসেছে। রজত চিত্রাকে চা দিতে দিতে বলে,” মাঝে মাঝে এমন হলেই ভালো। দু’জন মিলে একটু সময় কাটানো যায়। ভালো না।”
চিত্রা এবার হাসে। রজতের তখন মনে হয়, এ হাসির জন্য সে সবকিছু করতে পারে। কিছুক্ষণের জন্য যেন সে হারিয়ে যায় চিত্রার হাসিমুখটার মাঝে। এরপর চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলে, ” তা তোমার সংসার চলছে তো ঠিকমতো?”
” তোমার ফাজলামো আর গেলো না। “

রজত হাসে। হাসে চিত্রাও। হঠাৎ কথা নেই বার্তা নেই হুট করে দমকা একটা ঝড়ো হাওয়া বয়ে যায়। আকাশ থেকে পড়তে থাকে বড়ো বড়ো জলের ফোঁটা। চায়ের দোকানের দোকানদারটা তাগাদা দেয়। রজত তাড়াতাড়ি দামটা চুকিয়ে দিলে দোকানদার বাইরের বসার টুলগুলো দ্রুত ভেতরে ঢুকায়। রজত তার ছাতাটা মেলে ধরে। মুহূর্তে বৃষ্টি নামে অঝোরে। চারদিকের কোলাহল যেন থেমে যায়। একটু আগের ব্যস্ত রাস্তাটা হয়ে পড়ে নীরব, জনমানবহীন। পরিবেশটা হয়ে পড়ে বড্ড শান্ত। নীল- কালো মেশানো শাড়ি আর খোলা চুলে চিত্রাকে এ পরিবেশে মানিয়ে যাচ্ছিল ভীষণভাবে। ডান হাতে ছাতাটা ধরে রজত তার বাম হাত দিয়ে চিত্রাকে কাছে টেনে নেয় পরম যত্নে, আগলে রাখে তার বুকের মাঝে। নিঃশব্দ পরিবেশে শুধু মেঘ-বৃষ্টির শব্দের মাঝে হারিয়ে যায় আজ তারা ; ভেজা রাস্তায় ধীর পায়ে হেঁটে চলে দু’জন আর সিক্ত হয় ভালোবাসায়, ভালোলাগায়।

(৩)

সময়গুলো চলে যাচ্ছে ভালোভাবেই। রজত অনেকটাই ব্যস্ত সময় পার করছে। একে তো টিউশন অন্যদিকে সপ্তাহখানেক পরেই ফাইনাল পরীক্ষা। রাত জাগতে হচ্ছে অনেক। এদিকে চিত্রারও পরীক্ষার তেমন একটা দেরি নেই। টেবিলে বসে স্টাডি করছিলো রজত। ইলেকট্রিসিটা হঠাৎ চলে যাওয়াতে মেজাজ তিরিক্ষি হলো তার । হুট করে গরমটাও প্রচণ্ড পরিমাণে বেড়েছেও। মহল্লায় লোডশেডিং হয়ও বেশি। চিত্রা তাড়াতাড়ি চার্জার লাইটটা টেবিলে দেয়। কাঠের খোলা জানালাটা দিয়ে মৃদু একটা বাতাস অনেকক্ষণ পরপর ঘরের ভিতরে আসে। তাতে এই হঠাৎ গরমে প্রশান্তি আনে একটু। সমস্যাটা বেশি হয় মশার উৎপাতে।

রজতের কষ্টটা প্রচণ্ডভাবে চিত্রার ভেতরে এক ধরনের অপরাধবোধ তৈরি করে। রজত অত্যন্ত সচ্ছল পরিবারের সন্তান। তেমন একটা শারীরিক  কষ্ট করেনি কোনদিন। রজতের বাবা স্বর্ণের ব্যবসায়ী। শহরে নিজেদের দুইতলা বাড়ি । নিচের তলা ভাড়া দিয়ে উপরের তলাতেই ওর পরিবার থাকে। রজত টিউশন করছে জানতে পারলে তার পরিবার না জানি কি ভাববে? মাঝে মাঝে ভাবে চিত্রা। পরিবারের কাছ থেকে রজত আজ এত দূরে। চিত্রার এ ব্যাপারটা বড্ড খারাপ লাগে। নিজে সে অনাথআশ্রমে বড়ো হয়েছে। পরিবারের গুরুত্ব সে উপলব্ধি করেছে বারবার। রজতের দিকে তাকিয়ে দেখলো, “রজত মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করছে তার পড়ায় ।”

চিত্রা পড়ার টেবিলের কাছাকাছি বিছানায় বসে বললো, “পড়ছো?”
রজত  চিত্রার দিকে একবার তাকিয়ে আবার পড়ায় মন দিতে দিতে বলে, “হুম। কেন? কিছু বলবে?”
“হুম। বলছি………বাসায় একটা ফোন দিয়েছো ? তোমার মায়ের কাছে?”
রজত এবার পড়া বন্ধ করে।
” না, কেন?”
” সামনে তোমার পরীক্ষা। মাকে একটা ফোন দিও।”

চিত্রা এ ধরনের একটা কথা হুট করে বলবে–  এটা রজতের চিন্তার বাইরে ছিলো। কিন্তু চিত্রা তো ঠিকই বলেছে। রজত ভাবতে লাগলো। এ কয়দিনে প্রচুর প্রেসার যাচ্ছে। তার নিজেরই ভাবা উচিত ছিলো। অনেকদিন হলো বাসায় একটা ফোন দেয়া হয়না। পরে বললো,   “হুম। দিবো, কাল সকালে।”
চিত্রা হাসে। চিত্রার দিকে তাকিয়ে মুখে হালকা হাসি আনে রজতও।
পরদিন সকালে রজত ফোন দেয় কয়েকবার। কিন্তু কেউ ফোন ধরেনা। চিত্রা পরে তাকে বললো,” পরে না হয় আবার ফোন দিও।” রজত ভাবলো সেটাই ঠিক হবে। তাছাড়া টিউশনে যেতেও দেড়ি হয়ে যাচ্ছে। রজত তাই টিউশনে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো।

পরীক্ষার আগের দিন ।
রজত সকালে তার মাকে আবার ফোন দিলো। দুইবার ফোন দেয়ার পর লাইন পাওয়া গেলো।
” হ্যালো, মা।”
“তুই! ফোন দিয়েছিস কেন?”
“কেমন আছো তোমরা?”
“আমাদের খবর নেয়ার দরকার নেই। ঐ অনাথ মেয়েটাই তো তোর সব।”
“কেন এভাবে বলো মা? আমি কি বলেছি যে তোমরা আমার কেউ না? ওকে আমি ভালোবাসি মা।”
” তাই বলে একটা নামহীন , পরিচয়হীন মেয়ে! আত্মীয়স্বজন জানলে কি বলবে? কি পরিচয় দিবো আমরা ওর?”
” মা, ওর পরিচয় আছে। “
” তুই যে বললি ও অনাথাশ্রমে বড়ো হয়েছে!”
” অনাথাশ্রমে বড়ো হয়েছে। কারণ ছোটবেলায় একটা দুর্ঘটনায় ওর বাবা-মা মারা যায়। পরে ওর এক মামা তাকে অনাথাশ্রমে দেন। সেই মামাই ওকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছিল। সে জন্যই আমি ………।” রজত থেমে যায়।
রজতের মা এবার একটু শান্ত গলায় বলে, ” কিন্তু এসব তো তুই আগে বলিস নি।”
” বলবো কি করে? তোমরা তো শুনতে চাওনি। বাসায় একদিন গিয়ে নিজের বইপত্র নিয়ে এসেছিলাম। তখনও তো জানতে চাওনি।”
রজতের মা চুপচাপ শুনছিলেন। রজত বলতে লাগলো,” আজ কয়টা দিন ধরেই তোমাকে ফোন করে যাচ্ছি। পাচ্ছি না।”
” তোর বাবা অসুস্থ। এখন হাসপাতালে। আমি কিছুক্ষণ আগে এসেছি।”
“হাসপাতালে! কি হয়েছে বাবার?”
” ভয় পাস না। তেমন কিছু না। মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলো। ডাক্তার বলেছে শরীর দুর্বল। টেনশন আর অনিয়মিত খাওয়াদাওয়ার কারণেই এমন হয়েছে। এখন ভালো আছে। হয়তো আর দুই -তিন দিন হাসপাতালে থাকতে হতে পারে।”
” আমাকে একটা বার জানালেও না!”
“তুই কেন ফোন দিয়েছিলি?”
” কাল ফাইনাল পরীক্ষা শুরু। তাই।”
“ও। ভালো করে পরীক্ষা দিস।” এরপর কি ভেবে আবার জিজ্ঞাসা করলেন,” টাকা পয়সা হাতে আছে?”
” ওটা নিয়ে ভেবো না। কাল পরীক্ষা শেষে আমি আসবো বাবাকে দেখতে। “
” আসিস। ” একটু থেমে পরে আবার বললো, ” শোন্ চিত্রাকেও নিয়ে আসিস।”
” নিয়ে আসবো মা!!!” রজত অবাক।
“হুম।”
” কিন্তু বাবা……”
” ও আমি দেখবো।”
“ঠিকাছে মা।”
লাইনটা কেটে গেলো। রজতের মুখে হাসি।
রজত এরপর চিত্রাকে বলে,” বলেছিলাম না , একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।”
চিত্রা কিছু বলে না। হঠাৎ তার চোখে জল।শুধু ভেজা চোখ আর হাসিমুখে ” হাঁ ” সূচক মাথা নাড়ে।

(৪)

সময়টা প্রায় সন্ধ্যা নাগাদ। পরীক্ষা শেষে রজত যখন বাসায় ফিরে তখন প্রায় বিকেল হয়ে গেছে। রজত তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে চিত্রাকে নিয়ে বের হয়। সন্ধ্যার সময়। রাস্তায় গাড়ির চাপ ভীষণ এবং প্রচুর ভিড়। বাসগুলো একটার পর একটা  আসছে। কিন্তু প্রচুর ভিড় থাকাতে চিত্রাকে নিয়ে উঠাটা বেশ মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। রজত একা হলে কোন সমস্যা ছিলো না। কিন্তু চিত্রার পক্ষে দাঁড়িয়ে যাওয়াটা কষ্টকর হবে। হঠাৎ রজত দেখলো একটা বাস এদিক দিয়ে আসছে আর বাসের হেল্পারটা  “একটা সিট, একটা সিট………” বলে চিৎকার দিচ্ছে। বাসটা কাছে আসতেই রজত চিত্রাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি ঐ বাসটায় উঠলো। চিত্রাকে খালি সিটটায় বসিয়ে দিয়ে রজত একটু সাইড হয়ে বাসের হ্যাণ্ডেল ধরে দাঁড়ালো অতি কষ্টে। রজতের মনে হচ্ছিল চারদিকে মানুষের চাপে ওর নিঃশ্বাস বুঝি বন্ধ হয়ে যাবে।

হাসপাতালে এসে রজত চিত্রাকে নিয়ে ওর বাবার কেবিনে যায়। রজত ওর মা কে দেখতে পেলো। দরজাটা একটু খুলতেই রজতকে দেখলো ওর মা।
” এসছিস্। আয়।”
রজত চিত্রাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে। রজতের বাবা তাদের দেখতে পান। চিত্রা রজতের মা- বাবা দুজনকেই নমস্কার করে। রজত তার বাবাকে জিজ্ঞেস করে,” বাবা, এখন কেমন আছো?”
” আছি, ভালো আছি।” সহজ উত্তর রজতের বাবার। পরমুহূর্তে বলে, ” তুই?”
” এইতো ভালো।”
” অনেক শুকিয়ে গেছিস দেখছি।”
” রাত জেগে পড়তে হচ্ছে তাই হয়তো………।”
রজতের মা হঠাৎ বললেন,” থাক্, তুমি এখন বিশ্রাম নাও।”
তারপর একটা কাগজ রজতের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে রজতকে বললেন,” রজত দ্যাখ তো একটা ওষুধ লিখে  দিয়েছে ডাক্তার। তুই একটু নিয়ে আয়। আমি ততক্ষণে ও’র( চিত্রাকে ইঙ্গিত করে) সাথে কথা বলি।”
” ঠিকাছে মা। আমি দেখছি।” কাগজটা হাতে নিতে নিতে বললো রজত।
রজত কেবিন থেকে বের হয়। তার বাবার কেবিন পাঁচ তলায়। লিফটে করে সে নিচতলায় নামে। নিচতলার একেবারে শেষ মাথায় ফার্মেসী। হাসপাতালের প্রতিটি জায়গায় জায়গায় যথেষ্ট ভিড়। রজত ফার্মেসীর কাছাকাছি আসতে সেখানেও মোটামুটি রকমের ভিড় লক্ষ্য করলো। তবে ওষুধ কিনতে এতটা বেগ পোহাতে হয়নি। রজত কেবিনে ফিরলে খেয়াল করলো তার মা চিত্রার সাথে বেশ হাসিমুখে কথা বলছে। ব্যাপারটা বেশ ভালো লাগলো তার।

“এই নাও।” ওষুধের প্যাকেটটা রজত তার মায়ের হাতে দিতে দিতে বললো। রজতের মা প্যাকেটটা নিলেন। রজত এরপর বললো,” এখন তাহলে আসি , কাল আবার আসবো।”
” কাল আসতে হবে না। কাল বোধহয় তোর বাবাকে এমনিতে ছেড়ে দেবে। আমি তোকে ফোনে জানাবো।”
রজত দেখলো তার বাবা ঘুমিয়ে গেছে। মাকে বললো, ” ঠিকাছে। তবে চলি।”
” যাবি কি করে?”
” বাসে চলে যাবো।”
” বাসে যেতে হবে না। অনেক রাত হয়েছে। এত রাতে ও’কে(চিত্রাকে দেখিয়ে) নিয়ে বাসে না যাওয়াটাই ভালো।” বলতে বলতে হাতের ব্যাগ থেকে কিছু টাকা বের করে রজতের হাতে দিয়ে বললেন,” ট্যাক্সি করে চলে যাস্।”
” টাকা লাগবে না।”
” রাখ্ না। পরীক্ষা দিচ্ছিস্। একটা খরচও তো আছে।”
রজত আর কিছু বললো না। চিত্রাকে নিয়ে কেবিন থেকে বের হয়ে গেলো।

রজত চিত্রাকে নিয়ে এখন ট্যাক্সিতে। ট্যাক্সি যেন বাতাসের গতিতে ছুটছে। এতে করে প্রচণ্ড গরমে যেন একটু প্রশান্তির হাওয়া ট্যাক্সির ভেতরে এসে গায়ে লাগছে আর তাতে শরীর জুড়িয়ে যাচ্ছে নিমিষে। রজত লক্ষ্য করেছে চিত্রা আজ অনেক খুশি। চিত্রার হাসিমুখ সেটাই জানিয়ে দিচ্ছে রজতকে।

পরদিন দুপুর বেলা। চিত্রা ভার্সিটি গিয়েছে সকালে। রজত পরের পরীক্ষার পড়া পড়ছিলো। বিকেলে আবার টিউশন আছে।তাই যতদূর সম্ভব একটু পড়া এগিয়ে নিতে চাইলো সে।  ফোনটা হঠাৎ বেজে উঠতেই রজত ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলো তার মা ফোন দিয়েছে।
” হ্যালো,মা।”
” হ্যাঁ, রজত । কি করিস?”
” আমি পড়ছিলাম।”
” চিত্রা কোথায়?”
” চিত্রা তো মা ভার্সিটি গিয়েছে।”
” ও। আচ্ছা শোন্, আমরা বাসায় চলে এসেছি সকালে।”
” ও, তাই। আমায় বললে না যে? আমি না হয় তোমাদের বাসায় দিয়ে আসতাম।”
” না,রে। আমরা চলে এসেছি।”
” আচ্ছা , ঠিকাছে।”
“রজত?”
” হ্যাঁ, বলো মা।”
” তুই নাকি টিউশন করিস।”
” তোমাকে কে বললো?”
” চিত্রা”
” ও। কাল চিত্রার সাথে বসে থেকে বুঝি এসব খবর নিয়েছো।”
”  মেয়েটা অনেক ভালো রে।”
“হুম”রজত হাসে।
” শোন্ না, চলে আয় না বাসায়। তো ‘ র বাবাও বলেছে।”
”  আমি জানতাম একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু এখন না মা। এই সব বইপত্র নিয়ে আবার বাসায় যাওয়া, গোছানো………এখন এই পরীক্ষার মধ্যে সমস্যা হয়ে যাবে।”
” তাও ঠিক।”
” পরীক্ষা শেষ হোক আর একটা চাকরিও পেয়ে নেই। তারপর।”
” হুম।” ঠিকাছে, রাখছি তাহলে।”
” ঠিকাছে, মা।”
ফোনটা কেটে গেলে রজত আবার পড়ায় মন দেয়।

রাত্রিবেলা। রজত চিত্রাকে জিজ্ঞেস করে,” মা’কে কেমন লাগলো, বললে না তো?”
চিত্রা বললো,” অনেক ভালো। আমার নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে গিয়েছিলো।”
” তাই……”
“হুম।”
” মা আজ ফোন দিয়েছে, বলেছে, বাসায় চলে যেতে।”
” হুম! তাই………”
রজত মাথা নাড়ে। বলে,” বলেছিলাম না একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।”
চিত্রার মুখে হাসি। চিত্রার মনে হলো, এতদিন তার ভেতরে যে একটা অপরাধবোধ কাজ করতো তা অনেকটাই কেটে গিয়েছে। ভেতরের ভারি ভাবটা যেন  হালকা হয়ে গেছে অনেকখানি।

(৫)

পরের বছর

বৃষ্টি হচ্ছে প্রচণ্ড। বাইরে দোলনচাঁপা গাছগুলোতে চোখ গেল চিত্রার। বছর ঘুরে আবার বর্ষার সময়টা এসেছে। গরমের দাবদাহের পর দোলনচাঁপা গাছগুলি আবার স্নাত হয়েছে বৃষ্টির জলে। ফুটেছে ফুলও। চিত্রার এ দৃশ্যটা ভালো লাগে ভীষণ।কাঠের খোলা জানালা দিয়ে পুকুরটাকেও জলপূর্ণ দেখাচ্ছে। বৃষ্টি তখনও ঝরে পড়ছে অঝোরে। বিকেলের এ সময়টাতে চিত্রার বাইরের প্রকৃতির এসব দৃশ্য দেখে সময় কাটাতে ভালো লাগে। রজত বাসায় নেই। একটা প্রাইভেট কোম্পানীতে তার চাকরি হয়েছে। এ নিয়ে একটু ব্যস্ত। এ মহল্লায় হয়তো আর দু’তিনদিন। সব গোছগাছ করে রজতদের বাসায় চলে যাবে তারা।

এর মধ্যে আরও কিছু পরিবর্তন হয়েছে। এ মহল্লায় অনেকের সাথে পরিচয় হয়েছে। চিত্রা আর রজত জানতে পেরেছে এখানকার পরিবারগুলোর সম্পর্কে। মহল্লায় যেসব গরীব বাচ্চারা রয়েছে, যাদের পরিবারের অবস্থা দিনে আনে আর দিনে খায় এর মতো ; সেসব বাচ্চাদের নিয়ে একটা স্কুল খুলেছে তারা। অন্তত তাদের অক্ষর জ্ঞান দেয়াটা যেন যায়। যাতে তারা কোথাও গিয়ে না ঠকে। এক্ষেত্রে অবশ্য চিত্রার আগ্রহ ছিল সবচেয়ে বেশি। রজত আর চিত্রার পাশাপাশি মহল্লার কিছু ভাল আর শিক্ষিত পরিবারের ছেলেমেয়েরাও এর সাথে যুক্ত হয়েছে। মহল্লার একটা টিনের ঘরে তারা এই কাজ করে থাকে। প্রতিদিন বিকেলের পর চলে এই কার্যক্রম। একদিন একজন করে সময় দেয় ছেলেমেয়েগুলোকে। তবে চিত্রাই সবকিছু দেখেশুনে রাখে। কে কোনদিন পড়াবে? কোন বাচ্চাটা আজ আসে নি? কেন আসে নি? সব কিছু চিত্রাই দেখে।

চিত্রা দেখলো বাইরে এখন আর বৃষ্টি নেই। তবে আকাশটা এখনো মেঘলা। যেকোন মুহূর্তে আবারও নামতে পারে বৃষ্টি। চিত্রা একটু দোলনচাঁপা গাছগুলোর কাছে গেল। হাত দিয়ে একটু স্পর্শ করতেই অনেকটা জল তার হাতে লাগলো। সঙ্গে সঙ্গে একটা হিমশীতল পরশ অনুভব করলো সে।এমন সময় চিত্রার ফোনটা বেজে উঠে। কাছে গিয়ে চিত্রা দেখে রজতের ফোন।
” হ্যালো, রজত……”
“হুম, কি করো?”
” কিছু না।”
” তৈরি হয়ে বাইরে এসো। ঘুরে আসি। “
” হুম। আসছি।”

আকাশ যদিও অনেক মেঘলা। তবুও চিত্রার আজ ইচ্ছে হলো একটু বেরিয়ে আসে। তাই রজত বলার সাথে সাথে সে আর না করে নি। আসার সময় স্কুলের ভিতরে গিয়ে দেখে বাচ্চাগুলো পড়ছে। শীলা নামের একটা মেয়ে পড়াচ্ছে। শীলা সবেমাত্র ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে।

রজত দাঁড়িয়ে ছিল সেই চায়ের দোকানটার কাছে। চিত্রা এলে রজত বললো,” কিছু খাবে?”
” চা ” সাথে সাথে বললো চিত্রা।
রজত দু’কাপ চায়ের অর্ডার দেয়। চা আসতে আসতে রজত বলে,” তারপর……দু’দিন পর তোমার সংসার বড়ো হতে যাচ্ছে। কেমন লাগছে?”
“ভীষণ ভালো। “
” তাই বুঝি………”
” হুম”
” স্কুলে ছেলেমেয়েগুলোকে কে পড়াচ্ছে আজ।”
” শীলা”

ততক্ষণে চা আসে। রজত আর চিত্রা চায়ে চুমুক দেয়। রাস্তায় গাড়ির চাপ নেই। আকাশটা এখনও মেঘলা। মাঝে মাঝে মেঘের গর্জন শোনা যাচ্ছে। বাতাস বয়ে যাচ্ছে একটু পরপর। চা শেষ হলে রজত আর চিত্রা হাঁটতে থাকে। রাস্তাটা পার হয়ে ডানে হাঁটতে থাকে। একটু কাছেই একটা লেক রয়েছে এখানে। এই পাশটা অনেক সুন্দর। অনেক সবুজ গাছগাছালি। বৃষ্টি নেই। কিন্তু বাতাসে গাছের ভেজা পাতা থেকে টুপটাপ জল পড়তে থাকে। আর তা এসে গায়ে লাগে মাঝে মাঝে। প্রকৃতির এই ছোট ছোট খেলাগুলো ভারি আনন্দ দেয় চিত্রাকে।

লেকের কাছে আসতেই রজতের মনে হলো বৃষ্টি আসবে খুব জোরে। লেকের আশেপাশে কেউ নেই। লেকের সাথে লাগোয়া একটা ছোট্ট টিনের টং রয়েছে। বৃষ্টির কারণে লেকের জল যেমন ভরা তেমনি অনেক স্বচ্ছ। বাতাসটা হঠাৎ করেই যেন বেড়ে চলেছে। রজত তখন চিত্রাকে নিয়ে টং এর ভিতরে বসেছে। যতটা ছোট্ট ভেবেছিল ততটা ছোট্ট নয়। দু’জনে বসতে পারা যায় ভালোভাবেই। রজত হঠাৎ চিত্রাকে বললো, ” জায়গাটা সুন্দর, তাই না……”
” হুম………”
চিত্রা এরপর বললো,” জানো রজত, আমি ভেবেছিলাম কিছুই বুঝি ঠিক হবে না।”
রজত হালকা একটা হাসি দেয়। বলে, ” সব একদিন ঠিক হয়ে যায় চিত্রা। শুধু সময়ের ব্যাপার।”
” আমার কারণে তোমায় অনেক কষ্ট করতে হলো বলো।”
” কষ্ট কিসের?”
এই যখন রজত বলছিলো তখন বৃষ্টি আসলো অনেক জোরে । টং এর ভিতর বাতাস আর বৃষ্টি গায়ে লাগছে ভালোভাবেই । রজত চিত্রাকে জড়িয়ে ধরে রাখে। আর বলে,” তোমার জন্য আমি সব পারি চিত্রা। তুমি যে আমার আত্মবিশ্বাস। তুমি থাকলে সব অসম্ভবই সম্ভব।”

বৃষ্টি পড়ছে তখন অঝোর ধারায়। লেকের জল তখন বৃষ্টির সাথে খেলে যাচ্ছে নিরলসভাবে। কিংবা আকাশ থেকে ঝরা ঐ বারি খেলছে হয়তো লেকের জলের সাথে। যেন তাদের কোন ক্লান্তি নেই। আপন করে নিয়েছে একে অন্যকে চিরদিনের জন্য। বৃষ্টি হয়তো থেমে যাবে। কিন্তু আবারও আসবে ; বারবার ফিরে আসবে। আর আনন্দে মেতে উঠবে তার খেলায়। রজত আর চিত্রা তাকিয়ে থাকে এই খেলাটার দিকে। প্রকৃতির চারদিক জুড়ে তখন বৃষ্টির খেলা; এ খেলায় যেন অদ্ভূত এক শক্তি বিরাজ করে, বিরাজ করে অন্যকরম এক ভালোলাগা, ভালোবাসা।  মুহূর্তে মুহূর্তে সেই শক্তি যেন ধরা দেয় আরও প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে। এমন ভালোবাসাই আসুক বারবার পৃথিবীতে। এ ভালোবাসায় যে কোন দেনাপাওনা নেই, আছে শুধু নিরলস ক্লান্তিহীন পরিশ্রম আর তাতেই বুঝি লুকিয়ে থাকে অসম্ভব কে সম্ভব করার প্রবল আত্মবিশ্বাস, খু্ঁজে পাওয়া যায় এক অদ্ভূত শক্তি………। ভালোবাসার এই বৃষ্টি নামুক মানবমনে আর সুন্দর থেকে সুন্দরতর হয়ে উঠুক পৃথিবী।


লেখক পরিচিতি : প্রিয়াংকা রাণী শীল
আমি প্রিয়াংকা।জন্ম বাংলাদেশের চট্টগ্রামে। পড়াশোনা করেছি চট্টগ্রামেই। গল্প, উপন্যাস পড়তে ভালবাসি। আর ভালবাসি গল্প লিখতে। পড়াশোনা করা অবস্থায় স্কুল,কলেজ ম্যাগাজিনে তিনবার আমার লেখা গল্প ছাপানো হয়েছিল।বর্তমানে বাস করছি ইতালিতে। আমার লেখা গল্প পড়ে ভালো না খারাপ লাগলো তা জানালে অনেক বেশি ভালো লাগবে।

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

4 Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।