একটি ঢাকের আত্মকাহিনী

লেখক: ইচ্ছেমৃত্যু

আর আজকের রাতটা পেরোলেই শেষ। কাল সারাদিন বাজবে ভাসানের সুর, “ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ/ঠাকুর যাবে বিসর্জন”। তারপর আবার প্রায় এক বছরের জন্য আমার পিঠে আর প্রহার পড়বে না। প্রহার বলছি বটে তবে তাতে আমার ব্যথা হয় না। জগুবায়েন – আমার বাবা নাকি মালিক বুঝতে পারি না… যেই হোক, ওর লাঠির আঘাত অম্ল মধুর… যেন সন্তানকে বকার ছলে একটু গাল টিপে দেওয়া। জগু এখন ঘুমোচ্ছে – ওর নিজের ছেলে নন্তুকে জড়িয়ে ধরে। আর আমি উল্টোদিকে গড়াগড়ি খাচ্ছি… অন্যদিন আমিও ঘুমিয়ে পড়ি কিন্তু আজ আর কিছুতেই ঘুম আসছে না। আসলে ঘুমোতে হয়ত চাইছিও না! …আর তো কালকের দিনটা, তারপর আবার সেই অন্ধকার ঘরে, এক কোণে… তার আগে কালকের সারাটা দিন শুধু একটাই বোল – “ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ/ঠাকুর যাবে বিসর্জন….”
জগু যখন আমাকে দোকান থেকে কিনে নিয়ে এল তখনও আমার গা থেকে চামড়ার বোঁটকা গন্ধটা যায়নি। ক’দিনই বা বয়স তখন আমার! জগুবায়েন বায়না ক’রে গিয়েছিল আমাকে কিনবে ব’লে। জগুরা বংশ পরম্পরায় বায়েন – মানে ঢাক বাজায়। বেশ কয়েক পুরুষ আগে ওদের শুধু ঢাক বাজিয়েই সংসার চলত – এখন অবশ্য দিন পাল্টেছে – এই কয়েকটা দিন বাজনার কাজ পায়, বাকি সময়টা জনমজুর। মহালয়ার দিনকয়েক আগে থেকে আমার তোয়াজ শুরু হয় – অন্ধকার কোণ থেকে বের করা হয় – রোদ খাওয়ায় – পরিষ্কার করে – গায়ের কাপড় সাবান দিয়ে ধুয়ে আবার পরায় – আর পালকের পেখম লাগানো হয় নতুন ক’রে। তারপর গ্রাম বাংলার রাস্তায় “ড্যাং কুরাকুর, নাক কুরাকুর, নাক কুরাকুর ড্যাডাং ড্যাডাং” বোল তুলে চেপে পড়ি ট্রেনে… মানে জগু আমাকে নিয়ে ট্রেনে ওঠে সঙ্গে থাকে ওর ছেলে নন্তু যে কাঁসি বাজায়। মহালয়ার বিকেলেই পৌঁছে যাই শিয়ালদা স্টেশনে – স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে দেখি আমার মতই অনেক ঢাকেদের নিয়ে তাদের বায়েনরা উপস্থিত। স্টেশন চত্বরে বোল ওঠে সমস্ত ঢাকের…. যদিও বছরের পর বছর বায়েন আর ঢাকের সংখ্যা কমতির দিকে… তবু বোল ওঠে – “ড্যাং কুরাকুর, নাক কুরাকুর, নাক কুরাকুর ড্যাডাং ড্যাডাং…..”
দরদাম চলতে থাকে – কোনও বছরই কোনও বারোয়ারি পুজো কমিটি বা বাড়ির পুজোর মালিক বায়েনদের বলা দামে রাজি হয় না – তাই দর কষাকষি চলেই… তাদের পুজোর থিম বা আলোর রোশনাইয়ের পিছনে যত টাকাই ঢালাঢালি চলুক বায়েনদের জন্য বরাদ্দের পরিমাণ কমতে থাকে বছরের পর বছর – আগে যেসব বাবুদের বাড়িতে বাজত চার জোড়া ঢাক সেখানে এখন বাজে দুটো বা একটা ঢাক। আর বারোয়ারি পুজো কমিটিরা তো বলেই দেয় “সিডিতে ঢাকের বোল বাজিয়ে দেব”। যাই হোক প্রাপ্য চাল, পোষাক বা টাকার কোনও একটা বা সব ক’টার সঙ্গে আপস করে আমার মানে জগুবায়েনের বায়না হয়ে যায় এক পুরনো বাবু বাড়িতে। বনেদী বাড়িতে বায়না হলে একটা সুবিধা হয় – একটা নিয়ম ধরে, সময় ধরেই বাজতে হয়; অবশ্য বারোয়ারি পুজোর থেকে একটু বেশিই বাজতে হয় তবে তার মধ্যে একটা রীতিনীতি আছে। বারোয়ারি পুজোর মতো ঢাক আর বায়েন দুজনকেই বারোয়ারি হয়ে যেতে হয় না – যার যখন ইচ্ছে ঠেঙ্গিয়ে দিল! অবশ্য তাই বা হয় কোথায় সব সময়! আজই তো বাবুর বিদেশবাসী ছেলের কাঠির ঠ্যাঙ্গানি খেয়ে আমার সারা গায়ে ব্যথা ধরে গ্যালো! এই ভূতটা কেন যে এদের মাথায় চাপে! জানা নেই শোনা নেই হঠাৎ ছেলের সখ হল কিনা ঢাক বাজাবেন! বোলটোল কিছু বোঝে না, দমাদ্দম পিটিয়ে দিলেই কি ঢাক বাজানো হয় রে! ভাগ্যিস ওর ন্যাকা ন্যাকা প্রেমিকাটা ওকে ডেকে নিল প্যান্ডেলের পিছনের দিকে – কেন ডাকল সেটা কি আর বুঝি না!… সে যাই হোক, ওদিকে নজর দিয়ে তো আর আমাদের লাভ নেই!  এছাড়া যখন তখন কাঁধে তুলে নিয়ে বা আদিখ্যেতা করে জড়িয়ে ধরে মুখ বাঁকিয়ে মোবাইল না কি বলে তাতে ছবি তোলার হুজুগ তো লেগেই আছে… তাকে নাকি সেলফি বলে। জোর আলোচনা চলে ওদের – ক’টা লাইক পড়ল ঢাকের সাথে সেলফিতে। এদিকে যে আমার ঝিমুনিটা গ্যালো চটকে সেটা তো আর ওরা বোঝে না! না:, বড্ড হাই উঠছে, একটু গড়িয়েই নিই – কাল তো আবার সারাদিন বোল তুলতে হবে – “ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ/ঠাকুর যাবে বিসর্জন….”
বাপরে বাপ! আর পারা যাচ্ছে না! আর কত নাচবে কে জানে! সারা দেহে ব্যথা হয়ে গ্যালো – নন্তু তো মনে হয় হাতই নাড়াতে পারছে না – ওর কাঁসি থেকে আওয়াজই বের হচ্ছে না। আর এনারা নেচে যাচ্ছেন – ধুনচি নাচ – ধুনচি ছাড়া নাচ – বেলেল্লা নাচ। বেশির ভাগেরই পেটে সিদ্ধি নইলে বিলিতি পড়েছে – তাল বেতাল ভুলে নেচেই চলেছে। খুশিটা এদের কিসে বুঝি না – মায়ের বিসর্জন হবে… মুখে বলছে মন খারাপ হয়ে আছে, আর এদিকে নেত্য চলছে! আজ আর আমাদের বাড়ি ফেরা হবে না – কাল বিদায়ী নিয়ে ফিরতে হবে। বরং বিসর্জন অব্দি বোল তুলে যাই “ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ/ঠাকুর যাবে বিসর্জন….”
জগুবায়েন অনেকক্ষণ থেকে বাবুর সাথে কথা বলছে, শুনতে ইচ্ছে করছে না। আমার মনটাও একদম ভাল নেই। আবার এক বছরের জন্যে বন্দী – যদি বরাত খুব ভাল হয় তাহলে কালি পুজোয় একদিন – নইলে তাও নয়। অথচ এই শহরেও দম বন্ধ হয়ে আসে – নন্তুটা মাকে ছাড়া পুজোর দিনগুলো কাটায় আমার একদম ভাল লাগে না – তাই যত তাড়াতাড়ি ফিরতে পারি ততই ভাল – কিন্তু জগু যে যাওয়ার নামই করছে না – নন্তুও বাবার ধুতির খুঁট ধরে দাঁড়িয়ে। কী বলছে একটু শোনাই যাক –
জগু: বাবু, আজ্ঞে…মানে… একশোটা টাকা যদি বখশিশও দ্যান…
বাবু: বখ্‌শিশ কোথায় পাবরে! দেখছিস তো এতবড় পুজো.. এত খরচ… তারপর এই নোট ব্যান, জিএসটি – এই সব করে ব্যবসার অবস্থা ভাল না – সে তোরা বুঝবিও না…
জগু: নোট বেনে আমরাও তো কম ভুগলাম না বাবু! জানেনই তো পুজোর এই কটা দিন ছাড়া মজুর খাটতে হয়… সেই দিনমজুরি ছেড়ে বেংকে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে…
বাবু: সেই তো বলছি. আমাদেরও তো ওই করে ব্যবসায় ক্ষতি. নেহাত ঘরের পুজো… করতেই হয়!
জগু: আজ্ঞে…. বাবু, এতো বড় পুজোর থেকে একশোটা  মোটে টাকা… যদি দ্যাতেন… মানে ঐ বউটোর জন্নি একটা ছাপা শাড়ি কিনে নে যেতাম… বুঝতেই তো পারেন – পুজো তো আমরা আনন্দে কাটাই না… আশায় কাটাই। ক’টা টাকা হাতে আইলে… বউয়ের একটা শাড়ি….
বাবু: নারে, এবারে একদম হাতে কিছু নেই… অন্যান্য বছর কি বেশি বলতে হয় বল!
জগু: তাইলে, আজ্ঞে…. নিদেন একটা পুরনো শাড়ি….মানে গিন্নিমার….
বাবু: তোর গিন্নিমার শাড়ির কথা আর বলিস্‌ না… সেসব কি আর রাখে… শাড়ি দিয়ে কিসব কেনে!
জগু: তাও হবে না? তাইলে নন্তুটার…জামা একটা…
বাবু: নারে তাও নেই… আচ্ছা তুই যখন এত ধরেছিস নন্তুকে না হয় গোটা দশ টাকা দেবো চকলেট খেতে।
এমন সময় বাবুর নাতি পাশ থেকে ব’লে ওঠে, “দাদু আমার তো অনেকগুলো পুরনো জামা প্যান্ট আছে….দ্যাট উইল ফিট হিম”।
বাবু: আছে তোর? দিবি বলছিস? তাহলে দে –
নাতি জগুবায়েনের দিকে ঘুরে বলে, “আমি দু মিনিটে ওর জন্যে জামা নিয়ে আসছি… বাট একটা শর্তে, আমাকে বাজনা শোনাতে হবে – বোধনের বাজনাটা…”
“তা আর বলতি দাদাবাবু” এই ব’লে জগু আস্তে আস্তে আমাকে কাঁধে তুলে নেয় – ওদিকে নাতির হাতে নন্তুর জন্যে দুটো ব্যবহৃত জামা প্যাণ্ট…. জগুর হাতের যাদুতে আমি বোল তুলতে থাকি,  – বোধনের বোল – বিসর্জনের পরের দিন শহরের সব আওয়াজ ছাপিয়ে বাজতে থাকে বোধনের বোল – আর ব্যবহৃত নতুন জামা পাওয়ার আনন্দে নন্তুর কাঁসি সেই আওয়াজকেও ছাপিয়ে আওয়াজ তুলতে থাকে “কাঁই নানা, কাঁই নানা….কাঁই নানা, কাঁই নানা…”


লেখকের কথা: ইচ্ছেমৃত্যু
জন্ম বর্ধমানের বর্ধিষ্ণু গ্রামে। পেশায় নরম তারের কারিগর আর নেশায় – রীতিমত নেশাড়ু, কী যে নেই তাতে – টুকটাক পড়াশোনা, ইচ্ছে হলে লেখা – সে কবিতা, গল্প, রম্যরচনা, নিবন্ধ যা কিছু হতে পারে, ছবি তোলা, বাগান করা এবং ইত্যাদি। তবে সব পরিচয় এসে শেষ হয় সৃষ্টিতে – পাঠক যেভাবে চিনবেন চিনে নেবেন।

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

One comment

  1. Gobinda pramanik

    ইচ্ছে মৃত‍্যূ ,একটা সুন্দরধারণা(concept)এর উপর,অত‍্যন্ত বাস্তব দৃষ্টিভংগি নিয়ে গল্পটি লেখা।লেখিকার কলম চালনা অত‍্যন্ত স্বাভাবিক মুন্সীয়ানার পরিচয় দেয়।ঢাকের বোলে সবাই যখন মাতোয়ারা,ঢাকীর সযত্নে চেপে রাখা চোখের জল’আলো ঝলমলে সম্ভ্রান্ত সমাজে’নেহাত ই ব্রাত‍্য।
    লেখিকার কিছু দূর্বলতা,সময়ের সংগে কেটে যাবে ।গল্পের বুনণ আরো সাবলীল হতে হবে ।ঢাক ও ঢাকীর আত্মীক যোগ দেখানো দরকার ছিল ।গল্পের নাম করণে ঢাক প্রাধান‍্য পেয়েছে কিন্তু মুল গল্প ঢাকী কেন্দ্রীক ,ঢাক গৌণ ভূমিকায় ।লেখিকা (আমার ভাইঝী),খুব প্রতিশ্রুতি সম্পন্ন তাই ঋণাত্মক(negative)দিক যা আমার লেগেছে,সেটাও আলোচনায় রাখলাম ।
    অজস্র সুন্দর লেখা ওর কাছে থেকে প্রত‍্যাশায় রাখলাম।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।