প্রজ্জ্বলিত শিখা

লেখক : উনিশ রহমান

ফজরের আযান শুরু হয়েছে।

তা শুনেই প্রতিদিনের মতো নাইরা আকতার ঝড়মরিয়ে ওঠে বিষণ্ণ মুখে দ্রুত প্রস্তুত হয়ে নামাজ পড়তে শুরু করে। এরপর নামাজ শেষ করে সে বাড়ির সামনের পুকুর পাড়ে এসে একটু স্বস্তি খুঁজে নেওয়ার বৃথা চেষ্টা করে এই শুভ্র স্নিগ্ধ সকালে। কুজঝুটিকাচ্ছন্ন  অন্ধকারের বুক চিরে সোনালী রোদের ছটা ইতিমধ্যে উঁকি দিতে শুরু করেছে দুরের বাঁশবনের ফাঁক দিয়ে। সাধারনত এই পুকুরটিতে আগে সে কখনো আসেনি যখন থেকে এই মফঃস্বলে এসেছে। প্রথমবার এই পুকুরপাড়ের সামনে এসে সে এমন এক বিদঘুটে অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয় যে তার বিষন্ন মুখের অস্বাভাবিক ভঙ্গি দেখে তা স্পষ্ট বোঝা যায়। এই পুকুরের পানা-পচার তীব্র আঁশটে গন্ধের কাছে তার পরিচিত প্রিয় পুকুরের স্নিগ্ধতা কোথাও যেন অবলুপ্ত।

গত এক মাসে তিন বছরের সাংসারিক পুরনো অভ্যাস ত্যাগ করে নতুন অভ্যাসের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে একটু অসুবিধা হলেও বাস্তবতাকে কাছ থেকে দেখে তা মেনে নিতে বাধ্য হয় নাইরা আকতার। এই সামাজিক বাস্তব চিত্রটা তার কাছে কখনোই স্পষ্ট হতো না যদি না সে আভিজাত্যের মোহ ত্যাগ করে মেহবাহ রহমানের হাত ধরে বেরিয়ে আসতো। এখন নাইরা আকতার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর তত্ত্বাবধায়কের পদে কর্মরত। এর আগে সে লোকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ঝি কিংবা বাচ্চা সামলানোর কাজ করতো দু-মুঠো খেতে পাওয়ার আসায়।

চৌধুরী বাড়ির রমেশ কাকু একদিন তাকে ডেকে বললেন -তোমার জন্য একটা সুখবর আছে নাইরা।

নাইরা আকতার বৌদিমনির বাচ্চাটাকে শান্ত করে দৌড়ে এসে বললেন- কাকু আমায় ডেকেছেন? ইন্দিরা কাকিমা এবং কাকু দুজনে একে অপরের দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হেসে -জি রহমান সাহেবা, তোমার জন্য দ্বিতীয় বাড়ির ব্যবস্থা করলাম। নাইরা আকতারের  বুকের ভেতরটা ছ্যাৎ করে উঠল এবং তার মাথার মধ্যে তো নানান প্রশ্ন, বাঁসার ভেতর থেকে যেভাবে বাবুই পাখি উঁকি মারে সেভাবে ইতিমধ্যে উঁকি দিতে শুরু করেছে। অন্য কোথাও গিয়ে সুখে থাকার কথা সে ভাবতেও পারে না। এ বাড়ির মতো মানুষজন হয় নাকি? অন্য বাড়ির মানুষজন কেমন হবে, কত টাকা দেবে? এও ভাবতে শুরু করে। এ বাড়ি থেকে যেটুকু অর্থ সে পেত তাতে তো শত দুঃখ কষ্টের মধ্যেও তাদের ভালভাবে চলে যাচ্ছিলো। এসব প্রশ্নের শীঘ্রই জট কাটল ইন্দিরা কাকিমার কথা শুনে।

– আরে রহমান সাহেবা!  তোমার তো চার পো কপাল গো,তোমার কাকু তার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর অফিসে তোমার কাজের ব্যবস্থা করেছেন। আগামীকালই জয়েন একেবারে তত্ত্বাবধায়কের পদে।

দেখতে দেখতে দেড় মাস পার হয়ে গেছে। নাইরা আকতারের এখন সচ্ছল অবস্থা বলা চলে, অফিসেও এ কদিনে সে সকলের কাছে পছন্দের পাত্রী হয়ে ওঠেছে।দুপুরে খাওয়ার পর অফিসের বিশ্রামকক্ষে অফিসের সবচেয়ে শান্ত, নম্র মেয়েটিকে গম্ভীর থাকতে দেখে তার কাছে গিয়ে বসে। আসলে এই অফিসে যবে থেকে সে জয়েন করেছিল তবে থেকেই এই শান্ত, নম্র, করুণাময়ী মেয়েটির সঙ্গে কিভাবে যে  তার এত গভীর ব্ন্ধুত্ব হয়ে ওঠল তা আল্লাহই জানে। অন্যেরা তো প্রথমদিকে তাকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখতো, তার হিজাব পরিধিত ইসলামিক শালিন পোশাকের কারনেই হোক কিংবা জন্মসূত্রে মুসলিম হওয়ার কারণেই হোক তা তারাই জানতো ভালোভাবে। সভ্য সমাজে যেভাবে সাম্প্রদায়িক বাতাবরণ ছরিয়ে পড়েছে,তা নাইরা আকতারের ক্ষেত্রেও খুব একটা অস্বাভাবিক কিছু ছিল না।এই সভ্য সমাজে মুসলিম সম্প্রদায় কোথাও যেন অবহেলিত, তাচ্ছিল্য, অস্পৃশ্য।

-কিরে সায়নী;তোর মন খারাপ বুঝি?পুরো নাম সায়নী চক্রবর্তী। নাইরা আকতারের থেকে এক বছরের বড়ো হলেও নাইরা আকতার প্রথম থেকেই তাকে সায়নী বলে আসছে।

-আরে না তেমন কিছু নয়, প্রলয়ের সঙ্গে কাল সামান্য কারনে একফালি ঝগড়া হয়ে গেল।

এতদিনতো ভালোই চলছিল কিন্তু সায়নীর কথা শুনে কোথায় যেন সে হারিয়ে যেতে থাকে।বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের সেই বাস প্রতিক্ষালয় যেখানে একদিন বর্ষার উড়মেঘের বৃষ্টির মতো মেহবাহ রহমানের সাথে তার পরিচয়,এবং পরিচয় থেকে বন্ধু, বন্ধু থেকে ভালোবাসা। তারপর একদিন পরিবারের অমতে কবরস্থানে গিয়ে শাদি করেই বসলো তারা। তবে এতে একজন কাজী এবং মেহবাহের পরিচিত গোটা কয়েক বন্ধুও ছিল। এরপর নাইরা আকতারের জীবনটা কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যেতে শুরু করে।

নাইরা আকতার মেহবাহের হাত ধরে আনন্দময় স্বপ্নের যে কাল্পনিক জাল বুনেছিল তা বিয়ের দুই দিনের মধ্যেই ভেঙে টুকরো হয়ে যায়। নতুন পরিবেশে মানিয়ে নেওয়ার যেমন সমস্যা তেমনি অন্যদিকে তো সাংসারিক কাজকর্মের কোনো বালাই নেই। এর আগে তাকে কোনদিন বাড়ির কাজ করতে হতো না, বাড়ির দুই-তিন জন চাকরাণীই সব করতো। এখন তাকে সংসারের যাবতীয় কাজ করতে হয়-সকালে গোরুর গোয়াল থেকে গোবর ফেলা থেকে শুরু করে রাতে গোরু তোলা সবই করতে হয় । প্রথমদিকে তো সে উনুনটায় জ্বালাতে ভোর-দুপুর করে দিয়েছিল। সেইদিন তাকে লাঠি আর ঝাঁটার বাড়ি খেয়েই থাকতে হয়েছিল মেহবাহের হাতে। শাশুড়ির প্রতিপদক্ষেপে গঞ্জনা শুনতে শুনতে ব্যতিবস্ত হয়ে উঠে নাইরা আকতার। যখনই তার মন খারাপ করতো বাড়ির সামনের এই ছোট পুকুরটিতে এলে তার সব কষ্টই যেন ম্লান হয়ে যেত এই পুকুরের স্নিগ্ধতায়। এই পুকুরটায় ছিল তার একমাত্র দুঃখ প্রকাশের সঙ্গী। শাশুড়ির পা্ঁজর-ফাটানো চিৎকারে দৌড়ে আসে নাইরা আকতার। বুড়ির বয়সটা সাড়ে তিন-কুড়ি ছুই-ছুই তা স্বত্ত্বেও গলার আওয়াজের তেজ কম নেই। এই গলার জোরেই না সে সারা পাড়া মাৎ করে রাখে।

-আজ আরান আঁছে গো। তুমি জানো নাই, বড়ো লোকের মাইয়াদের ইগুলোই সমস্যা। নাও জলদি জলদি করবেক অনেক কাম বাকি আছে গিয়ে।

-কি বলছেন আম্মী, এগুলোতো হিন্দুদের উৎসব। আমরা পালন করবেন কেন?

-আপনি কি জানেন, ভিন্ন ধর্মের কোনো কিছু অনুসরণ করা শরীয়ত বিরোধী। আল্লাহ কখনোই ক্ষমা করবেন না।

-এই শুরু হলো মহারানির লেকচার দেওয়া। কাজের বেলা অষ্টরম্ভা, আর কথায় ফুলঝুরি।

-আম্মী আপনি যাই বলেন, আমি করতে পারবো না।

এই গ্রামের সকলই হিন্দুদের সাথে মিশে যে হিন্দু ঘেঁষা হয়ে উঠেছে, তা কদিনের মধ্যেই সে বুঝতে পেরেছিল। এইতো সেদিন গ্রামের সকলকে দশরের দিন ঘরের বাইরে চারিদিকে দশরবেড়ি দিতে দেখে এবং একাদশী,পূর্ণিমাতে উপোসবাস করতে দেখে তা ঠিকই আঁচ করেছিল।।আরও এমনকি কত কি-

এই দোজখখানায়। আরে গ্রামের নাম দোজখখানা। এখানে একটি মাত্র দ্বীনি পরিবারের বাস, একজনই সদস্য। হামিদুর আজহারি।গ্রামের সকলের মামা হিসেবেই পরিচিত। নাইরা আকতার ইনার কাছ থেকেই একটা কোরান শরীফ নিয়ে গিয়েছিল।

এখন নাইরা আকতার গ্রামের সকল শিশুদের ইসলামিক শিক্ষা দিয়ে থাকে মাঝে মধ্যে কাজের ফাঁকে। যদিও এতে খুশী নয় গ্রামের ভন্ড পির বাবারা। এরজন্য কম উসকানিমুলক কথা শুনতে হয়নি তাকে।

হঠাৎ একদিন তার শাশুড়ি ইন্তেকাল করলেন। আর ইন্তেকাল করবেনই না কেন? মেহবাহের বয়স যখন দেড় বছর তখন মেহবাহ তার আব্বুকে হারিয়ে ছিল। তবে থেকেই তো মেহবাহের আম্মী তাকে কি কষ্ট করেই না বড়ো করে তুলেছে। সংসার চালাতে শেষ সম্বল দুই কাঠা জমিটাও বিক্রি করে দিয়েছিল। কড়কড়ে এক হাজার টাকায়। তারপর থেকে মাটি কাটা, বাড়ি বাড়ি গিয়ে গিয়ে ভিক্ষা করেই তো চালাচ্ছিল সংসার। দু-মুঠো খেতে পেত না পেট ভরে।অভাবের কারণে তার দীর্ঘস্থায়ী যক্ষা রোগের কোনো সুরাহা হয়নি। যাদের পেটে একমুঠো ভাত নেই,রোগে  যাদের এক ফোঁটা ঔষধ জোটে না তারা রোগের সংক্রমণ কীভাবে রুখবে?

একমাস কেটে গেছে।মেহবাহ তার কাজ হারিয়েছে। আর কাজ পাবেই বা কোথায় যেখানেই কাজ করুক না কেন বাড়ির মালিকের কাছ থেকে মোটা টাকা নিয়ে আর পাত্তায় দিত না। সেই টাকায় লটারি, জুয়া, মদ, গাঁজাতেই ডুবে থাকতে সারাক্ষন। নাইরা আকতার কত বুঝিয়েছ তাকে, তাতে কোনো লাভ হয়নি।

দিনদিন অভাব বাড়তে থাকে। নুন ভাতটাও ঠিক করে জোটে না। পাড়াপড়শি দের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা ধার নেয় মেহবাহ। দোজখখানায় এমন সহৃদয়  ব্যক্তি পাওয়া দুরস্ত যারা বিনা সুদে টাকা ধার দেবে তাদেরকে।

রমজান মাস চলছে। এক গ্লাস পানি খেয়ে সেহেরী করে নাইরা আকতার । খেজুরটুকুও  জোটে না। পাড়াপড়শি দয়া করে কোন কোন দিন ইফতারের নাস্তা দান করে তাকে। তাও আবার একটা খেজুর এককুচি আপেল আর এক গ্লাস বেলের শরবত। তা না হলে এক গ্লাস পানি খেয়ে ইফতার করে । মেহবাহ সুদের টাকায় মদ -গাঁজা খেয়ে মাতাল হয়ে ঘরে আসে। নাইরা আকতার নামাজের পাটিতে বসে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে দুই হাত তুলে মুনাজাত করতে থাকে। হরিণীর মতো উজ্জ্বল দ্বীপ্তিময় চোখ থেকে ঝরনার স্রোতের ন্যায় ঝর ঝর করে পানি বের হতে থাকে। সে ভাবতে থাকে -‘কবে এই  দুঃখের মরুভুমি অতিক্রম করে সুখের ঐ মরুদ্যানে পৌঁছাবে সে? আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদের এই অভাব একদিন ঠিকই ঘোঁচাবেন -এই আশায় অকুল দরিয়ার মাঝখানে খড়কুটো আঁকড়ে ধরে যেমন করে কোন অসহায় কীটপতঙ্গ বেঁচে থাকার  ক্ষীন আলো দেখতে পায় তেমনি নাইরা আকতার নতুন করে বেঁচে থাকার সন্ধান পায়।

দোজখখানার সকলে রোজা রেখে নানা বেয়াদবী কাজে লিপ্ত থাকে । চুরি, মারামারি ,চড়া সুদে টাকা ধার দেওয়া ,এমনকি গাঁয়ের ছেলে ছোকরারা জুয়া-মদ-গাঁজাতে  ডুবে থাকে সারাক্ষণ। গাঁয়ের মেয়ে -বউ কেউ পর্দা  করে না । গান-বাজনা, পরচর্চায় মশগুল থাকে সারাক্ষণ ।

– আম্মি! আম্মি !কেউ আছেন?

নাইরা আকতারের বুকের ভেতরটা ছ্যাঁক করে ওঠে। এই নির্ঝুম ভরদুপুরে কে তাকে আম্মি বলে ডাকে? বাইরে রোদের তেজ প্রচণ্ড। মাঝে মাঝে লু ও বইছে । ঝুপড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে দেখে- তার ভগ্নপ্রায় আদিকালের দরজার সামনে বছর পাঁচেকের একটা ফুটফুটে ছেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ভারী মিষ্টি দেখতে। পরনে ময়লা সাদা পাঞ্জাবী এবং সাদা ছেঁড়া টুপির ফাঁক দিয়ে চুলগুলি উঁকি দিচ্ছে। হাতে একখানা ব্যাগও রয়েছে।ফিতরা আদায় করতে বেরিয়েছে সে।

যাদের হাড়িতে প্রায়দিনই চালের বদলে শুধু পানি ফোটে তারা কিভাবে অন্যকে ফেতরা দেবে? নাইরা আকতার দানশীলা রমনী। রমজান মাসে তার আব্বুর অঢেল টাকা থেকে কত টাকাই না সে দান করেছে। পাড়ার পথশিশু, অসহায় দরিদ্র ব্যক্তিদের । সে এই বাচ্চাটাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দেবে এ হয় নাকি? নাইরা আকতার তার পাতলা ফিনফিনে ছেঁড়া আঁচলের গিঁট খুলে সাত টাকা ছেলেটিকে দেয়,যেটা সে ঘুঁটে বিক্রি করে পেয়েছিল। আসসালামু আলাইকুম আম্মীজান !বলে সে সামনে সরু গলি পার হয়ে ভাঙ্গা পথ ধরে যেতে থাকে।

নাইরা আকতার ছেলেটির মুখে আম্মিজান ডাক শুনে পরম তৃপ্তি অনুভব করে। প্রহরের পর প্রহর গুনতে থাকে সে কেবলমাত্র এই আম্মিজান ডাক শোনার জন্য। মেহবাহের প্রতিদিনের জ্বালা-যন্ত্রণা, অশান্তি সহ্য করতে করতে একটা সময় নিজেকে শেষ করে দেয়ার কথা ভেবেছিল  কিন্তু তার কথা ভেবে একটা জীবন্ত লাশ হয়ে বেঁচে থাকার প্রবল ইচ্ছা জাগ্রত হয় তার মনের গহ্বরে।

ভগ্নপ্রায় ঝুপড়ির ফাঁক দিয়ে আসা জ্যোৎস্নালোকিত চাঁদের আলোয় পাতলা ফিনফিনে পলাশ-রঙা শাড়ি পরা নাইরা আকতারের  উজ্জ্বলতা কয়েক গুন বেড়ে গিয়েছিল । একটু বেশিই উজ্জ্বল। দীর্ঘ ঘন হরিণীর মতো চোখে সেদিন তার ঘুম আসে না। রাত ক্রমশ বাড়তে থাকে । আদিকালের ভাঙা লন্ঠনটাও  কখন নিভে গিয়েছে ।  ঝুপড়ির ফাঁক দিয়ে একরাশ  অন্ধকার আকাশের নিঃসঙ্গ নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে একাকিত্বের  সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতে  দুচোখ  বেয়ে টপটপ করে ঝরে পড়ে বেদনার অশ্রু। এই বেদনার্ত মুহূর্তে সে অনুভব করে জান্নাতের অন্তহীন সুগন্ধের ন্যায় এক পরম তৃপ্তি। এই তৃপ্তি মাতৃত্বের তৃপ্তি। আম্মীজান শোনার উৎকন্ঠা। এই দিনই না সে পেটের মধ্যে নড়ে উঠেছিল।তাকে স্বাগত জানানোর অপেক্ষায় শত দুঃখ কষ্টের মধ্যে সূখ নেওয়ার চেষ্টা করে। আর এই সুখটুকু তাকে বেঁচে থাকার প্রেরণা দেয় -দুঃখ জয় করার ক্ষমতা যোগায়।

চাঁদের উজ্জ্বলতা ক্রমশ ক্ষীন  হতে থাকে মেঘেদের আগমনে। মধ্য রাতের নিস্তব্ধতাকে খানখান করে ডেকে ওঠে পুকুরপাড়ের বাঁশগাছের ওই নিদ্রাহীন পাখিটি। সামনের রাস্তায় কুকুরটি  ক্রমাগত ঘেউ ঘেউ করতে থাকে। কে যেন গলির মধ্যে দিয়ে চুপিচুপি পায়ে হেঁটে যাচ্ছে। নাইরা আকতার  রীতিমত শুয়োপোকার মতো গুটিয়ে মেহবাহের বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে চোখ বন্ধ করে দেয় প্রচণ্ড ভয়ে। টনটনে আরষ্ট চোখে তাকিয়ে দেখে শুরু গলির কোণে একটা কালো ছায়া। মুহুর্তের মধ্যে চোখ বন্ধ করে  ঘুমিয়ে পড়ে সে।

পশ্চিম আকাশের কোলে মুচকি হাসি বাঁকা চাঁদের শোভা ।আনন্দে মেতে উঠে গায়ের কচিকাঁচা থেকে পাড়াপড়শি সকলে।সকলের চোখে সহস্র খুশি। ইফতার শেষে নাইরা আকতার মাগরিবের নামাজ আদায় করে। নাইরা আকতারের  মনে ও একরাশ উৎকণ্ঠা। দীর্ঘ ত্রিরিশ দিন সিয়াম উপবাসের পর আগামীকাল খুশির ঈদ।

নাইরা আকতার ঘুমে জোড়ানো ক্লান্ত চোখে দেখে মেহবাহ  ভাঙা ঝুপড়ির  এক পাশে বসে আছে নিঃঝুম হয়ে।মেহবাহের সামনে গিয়ে দেখে তার চোখের কোনে  বেদনাভরা অশ্রু চিকচিক করছে।

– তোমার চোখে এমন হতাশার চিহ্ন? কি হয়েছে তোমার?

নাইরা আকতারকে দেখে  মেহবাহ মাঘের এক পশলা বৃষ্টির মত অঝরে কেঁদে ফেলে । নাইরা আকতার ওকে এইভাবে কখনো কাঁদতে না দেখে তার হরিণির মত সুন্দর চোখ থেকে ঝড়ঝড় করে পানি বের হতে থাকে।

নাইরা আকতার ওকে জড়িয়ে ধরে শান্ত করার চেষ্টা করে । তার মাথায় হাত বুলাতে থাকে । তার ফিনফিনে শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ মুছিয়ে দেয়।

– তোমার গোলাপের ন্যায় সুন্দর শরীরটাকে আমি প্রত্যেক মুহূর্তে ক্ষত-বিক্ষত করেছি । সারা জীবন শুধু তোমাকে কষ্ট দিয়ে এসেছি। আজ ঈদ। পাড়ার সকলে রং-বেরংয়ের পোশাক পড়ে ঈদ পালন করবে । আমি  তোমার জন্য একখানা শাড়ীর কিনে আনতে পারিনি।

নাইরা আকতারের হৃদয় থেকে শক্ত ও ভারী দম আটকানো অশান্তি ও অত্যাচারের পাথরটা নেমে গেল মুহুর্তের মধ্যে। ও নিজেকে শান্ত করে  মেহবাহকে গোসল সেরে ঈদ পালন করতে যাওয়ার জন্য বলে। মেহবাহ ফজরের নামাজ সেরে গোসল করেছে আগেই। নাইরা আকতার তার সাদা সেলাই করা ছেঁড়া লুঙ্গি আর পাঞ্জাবীটা তাকে বের করে দেয়। নাইরা আকতার  গোসল সেরে নাস্তার জোগাড় করতে যায়। কিন্তু নাস্তার যে কিছুই নেই । আল্লাহ কি এই ঈদের দিনেও  তাদের কিছু  জোটাবেন না?

দূর থেকে ভেসে আসে একটা অস্পষ্ট শব্দ।  বাইরে বেরিয়ে দেখে- সাদা দাড়ি ,সাদা ধবধবে পাঞ্জাবী এবং মাথায় সবুজ পেট্টিগ্রু বাঁধা এক বুজুর্গ। দাঁড়িয়ে রয়েছে। নাইরা আকতার  তাকে সালাম দেন।

-ওয়ালাইকুম আসসালাম ।আমাকে হামিদুর আজহারী পাঠিয়েছেন । উনি তোমার জন্য কিছু ঈদের তওফা পাঠিয়েছেন।

-ওহ!আচ্ছা।

-উনি তো আসতে পারতেন? এগুলো দিতে।

-উনিই আসতেন।কিন্তু উনি তার এক আত্মীয়ের বাড়ি গিয়েছেন।

নাইরা আকতার এগুলি নেয়। পরম আনন্দে নেয়। উনি যাবার পরে গোটা ঘর আতরের সুগন্ধে ভরে ওঠে। হামীদুর আজহার  দুঃখীদের রাজা, আল্লাহর এক নেক বান্দা। তা সে আগেই জানতো। মুহুর্তের মধ্যে তার সব চিন্তা এক ঝাঁক বসন্তের  পাখির মতো  কোথায় যেন উড়ে চলে যায়।

মেহবাহ ফিরে আসে। নাইরা আকতার  ও মেহবাহ  দুজনে ঈদের তোওফাটা খুলে দেখে- একজোড়া হিজাব ও পাঞ্জাবি, এক বরতন  রান্না করা দুম্বার গোশত এবং বিভিন্ন ফল ও এক পেয়ালা শরবত রয়েছে।

তারা দুজনে নতুন পোশাক পড়ে খানা খেতে শুরু করে । নতুন পোশাকের ঝলকানিতে তাদের সৌন্দর্য যেন কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছিল। এ খাবারের স্বাদ সারাজীবনের না খেয়ে থাকার অভাব  ঘুচিয়ে দিলো মুহূর্তের মধ্যে।

পরের দিন সকালে গ্রামের মোড়ল তার দলবল নিয়ে হাজির হয়।  আজ সে তার সুদসহ আসল টাকা নিয়ে যাবেই। কতবার এসেছে কিন্তু কোন লাভ হয়নি। মেহবাহ টাকা শোধ করবে কি করে? সুদ সহ  তার টাকার অঙ্ক  যে বিশাল। প্রায় আড়াই লাখ। সমস্ত কিছু বিক্রি করলেও এত টাকা হবে না। থাকার মধ্যে আছে তার আদিকালের ঝুপড়িটি।

মেহবাহ তাকে টাকা শোধ করে দেবে বলে আশ্বস্ত করে প্রায়ই । কিন্তু নাছোড়বান্দা মোড়ল তাকে এক চড় মেরে মাটিতে ফেলে দেয়। নাইরা আকতার  মুখ ঢেকে বেরিয়ে এসে মেহবাহকে মাটি থেকে তুলে।

গাঁয়ের মোড়ল তার ঝুড়িটিকে ভেঙে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। মুহূর্তের মধ্যে হাহাকার ছড়িয়ে পড়ে। আগুনের লেলিহান শিখা উন্মাদের মতো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। গাঁয়ের সকলে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকে। তাদের  গাঁ ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয় । গাঁয়ের মোড়ল ।যতদিন না তারা টাকা শোধ করতে পারবে ততদিন এই গ্রামে আসা নিষেধ তাদের। কেউ থাকতে দেয় না তাদের । হামিদুর আজহারীও নেই,  থাকলে কিছু একটা করতেন তাদের জন্য। কাঁদতে কাঁদতে গাঁ ছেড়ে চলে যেতে থাকে তারা।

বাঁশের ঠুনকো সেতু পার হতে গিয়ে নাইরা আকতার নদীতে পড়ে গিয়েছিল। নদীর স্রোত তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। তাকে বাঁচাতে নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিল  মেহবাহ।তাকে বাঁচাতে পারলেও তাদের সন্তানকে বাঁচাতে পারেনি তারা। গাঁ থেকে দুই ক্রোশ দূরে গ্রামীণ হাসপাতালে মৃত সন্তানের জন্ম দিয়েছিল নাইরা আকতার।অপুষ্টি। এ কারণে তারা তাদের সন্তানের মুখ থেকে আম্মিজান ,আব্বুজান ডাক শুনতে পেল না ।

সূর্য ডুবে গিয়েছে । আকাশ থেকে মুছে গিয়েছে শেষ সোনালী রং টুকু। দু -চোখ ফেটে অশ্রুর স্ফুলিঙ্গ  উল্কার মতো জ্বলে ওঠে। নাইরা আকতার কেঁদেছিল, কেঁদেছিল নাইরা আকতার। ঝর্ণার জলের বিদ্রোহী তরঙ্গের মতো কিংবা গুলিবিদ্ধ বোবা পাখির মতো ডুকরে ডুকরে  কেঁদেছিল ।

একরাশ অন্ধকার আকাশের একটি নিঃসঙ্গ নক্ষত্র হয়ে কিংবা আঁধার রাতের  শেষ সম্বল প্রজ্জ্বলিত শিখা হয়ে থেকে গেল নাইরা আকতার।

শূন্যতার গভীরে সাঁতার কাটতে থাকে তারা আম্মীজান শোনার  উৎকণ্ঠা।

চোখের কোনে এক চিলতে পানি।

– কিরে তোর চোখে জল ?

নাইরা আকতার স্মৃতির অতল অন্ধকার কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসে।

-না চল কাজ করি।

-তোর স্বামী কেমন আছে নাইরা?

-পায়ের অবস্থা দিন দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কালই একটা হুইলচেয়ার কিনেছি।

 


লেখক পরিচিতি : উনিশ রহমান
I am a student and love to write stories.

(বি. দ্র. - একটি বাংলা সাইটে বাংলা লেখা জমা দেওয়ার পর লেখক পরিচিতি দিতে লেখক বিদেশি ভাষায় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছেন। তাই সেটিই রাখা হল - লেখকের স্বাধীনতা ভেবে নিয়ে।)

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।