গুরু সের তো চেলা সওয়া সের

লেখক : দেবাশিস চৌধুরী

বিহারের মোকামা ঘাট। আকারে বেশ বড়। সামনেই বয়ে চলেছে গঙ্গা নদী। গঙ্গা এখানে বেশ চওড়া। পারাপারের জন্য আগে নৌকাই ছিল একমাত্র মাধ্যম। তখন ইংরেজদের শাসনকাল। সেই সময় সারা ইউরোপে শিল্প বিপ্লব ছড়িয়ে পড়ে। তার ছোঁয়া ভারতবর্ষেও লেগেছিল। অবশ্যই ইংরেজদের দৌলতে। নৌকার বদলে এল স্টীমার। তখন শুধুমাত্র পহেলজা ঘাট থেকে মোকামা ঘাট অবধি ফেরি সার্ভিস চালু হয়।

এই ঘাটের আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল বেশ কয়েকটা মন্দির। গঙ্গায় স্নান সেরে পূজার্চনা করতেন ভক্তরা। তাই সকালে ঘাটে জন সমাগম লেগেই থাকত। আর তার সাথে থাকত সাধু-সন্ন্যাসীদের সমাবেশ। তাঁরা অবশ্য তিন-চার দিনের বেশি থাকতেন না। মন্দির থেকে অনতিদূরে তাঁবু খাটিয়ে চেলা-চামুণ্ডাদের নিয়ে আস্তানা গাড়তেন।

একদিন এক গৈরিক বসনধারী সাধু তাঁর চেলা-চামুণ্ডাদের নিয়ে হাজির হলেন এই ঘাটে। লম্বা, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। মাথার বড় জটা ও লম্বা দাড়িতে তাঁর চরিত্রের পূর্ণায়ণ পরিস্ফুটিত হচ্ছিল। চেলারা ছিলেন সংখ্যায় ছজন। পৌঁছান মাত্র বাবাজি তাঁর পূজা-পাঠের সরঞ্জাম নিয়ে শিষ্য পরিবেষ্টিত হয়ে বেশ গুছিয়ে বসলেন। শুরু হল তাঁর ঈশ্বরের সাধনা। পিছনে শিষ্যরা পরিবেশটা আরও বাস্তবিক করে তুলতে বিভিন্ন বাদ্যের সহযোগে নামগান শুরু করে দিল। একজন দুজন করে বেশ কয়েকজন দর্শক জুটে গেল। ইতিমধ্যে লোক মুখে প্রচার হয়ে যায়, অবশ্যই শিষ্যদের দৌলতে, যে বাবাজি সদ্য হিমালয় থেকে আগমন করেছেন। উনি এক সিদ্ধ-পুরুষ। মানব কল্যাণই তাঁর জীবনের একমাত্র ব্রত। ওনার আশীর্বাদ পেলে মানব জীবন ধন্য হয়ে যায়।

প্রথম দিনটা এভাবেই কেটে যায়। বাবাজির উপস্থিতি ও মহিমা তখন লোকমুখে দাবানলের মতন ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। দ্বিতীয় দিন ভোর থেকেই শুরু হয়ে যায় দর্শক সমাগম। বাবাজির শিষ্যরা ইতিমধ্যে ওনার সামনে একটা বড় সাদা কাপড় বিছিয়ে দিয়ে ছিল। তার উপর ভক্তরা, বাবাজিকে গড় করে সাধ্য মতন টাকা-পয়সা দিয়ে যাচ্ছিলেন। মুহূর্তের মধ্যে দানে ভরে উঠল চাদর।

বাবাজির কিন্তু সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। তিনি তখন চোখ বন্ধ অবস্থায় ধ্যানে মগ্ন। মাঝে মধ্যে কোন শিষ্য উঠে গিয়ে দানে ভরা চাদর খালি করে আসছিল। বাবাজির সম্বন্ধে উপস্থিত জন সমাগম তখন নানাবিধ আলোচনায় ব্যস্ত। উনি হিমালয়ে সাধনা করে নাকি অমরত্ব লাভ করেছেন। ওনার মুখের কথা যেন বেদবাক্য। চন্দ্র সূর্যের গতি স্তব্ধ করার মতন শক্তি ধরেন তিনি। বাবাজির প্রশস্তি লোকমুখে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে দেরী হল না। ওনাকে চাক্ষুষ দর্শনের জন্য তখন দূর থেকে লোকজন আসতে থাকলে। এইভাবে দ্বিতীয় দিনও পার হয়ে গেল।

তৃতীয় দিনে শিষ্যরা প্রচার করে দিলেন যে আজ বাবাজি মা গঙ্গার বিশেষ পূজা করবেন। যদি কোন ভাবে তাঁর পূজায় ব্যাঘাত ঘটে তো জগত সংসার রসাতলে যাবে। ভোর থেকেই তাই ঘাটে ভিড় উপছে পড়তে লাগল। বাইরে এদিকে ছোটখাটো একটা মেলাও বসে গিয়ে ছিল।

নটা নাগাদ বাবাজি ঘাটের শেষ সিঁড়িতে পূজার্চনার সরঞ্জাম সাজিয়ে বসলেন। নদীর মৃদুমন্দ ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছিল ঘাটে। চোখ বন্ধ করে একাগ্র চিত্তে বাবাজি সবে পূজা শুরু করেছেন, এমন সময় ওপাড় থেকে স্টিমার এসে ভেড়ে ঘাটে। ঢেউয়ের তরঙ্গে ভেসে যায় তাঁর পূজার সরঞ্জাম। বাবাজির বসনও খানিকটা ভিজে গিয়েছিল। ধ্যান ভঙ্গ হওয়ায় বাবাজি তখন ক্ষিপ্ত। কাপড় ঝেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে রুদ্র মূর্তি ধারণ করে শূন্যে হাত তুলে চেঁচিয়ে বললেন, ‘ক্ষুদ্র কল। এত আস্পর্ধা তোর। আমার সাধনা ভঙ্গ করিস। এর শাস্তি তোকে ভোগ করতে হবে। কাল তোকে আমি গিলে খাব। এই ত্রিভুবনে কেউ তোকে রক্ষা করতে পারবে না। ঠিক এই সময়ে। কথা দিচ্ছি।’

শুনে শিষ্যরা একত্রে হাঁ-হাঁ করে মরাকান্না কেঁদে উঠল। ‘বাবাজি একি বললেন আপনি? আপনার কথা যে বেদবাক্য। ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বরের কথারও নড়চড় হতে পারে কিন্তু আপনার নয়।’

কয়েকজন শিষ্য আবার জনগণের মাঝে মিশে গিয়ে বাবাজির তেজের পূর্বের বিভিন্ন নমুনার ঘটনা শোনাতে লাগল। একটিও কথা আর না বলে বাবাজি উত্তরীয় ঝেড়ে দ্রুত পায়ে তাঁর তাঁবুর দিকে রওনা দিলেন। এদিকে ঘাটে সমবেত জনতা তখন ছেঁকে ধরেছে বাবাজির চেলাদের। তারা তখন হাত-পা নেড়ে ওনার তেজের মহিমা গেয়ে চলেছে ‘চন্দ্র সূর্য মিথ্যা হতে পারে কিন্তু বাবাজির কথা আজ অবধি কখনই মিথ্যা হয়নি। গিলবেন বলেছেন তো গিলেই ছাড়বেন। এমনই ওনার তেজ।’

পরের দিন ভোর থেকেই ঘাটে উপচে পড়ছে ভিড়। পা রাখার জায়গা পর্যন্ত নেই। ভিড় ঠেলে চেলা-চামুণ্ডাদের নিয়ে বাবাজি আটটার কিছু পরে ঘাটে এসে উপস্থিত হন। ওনার জয়-জয়কারে তখন কান পাতা দায়। তিনি ঘাটের শেষ ধাপে এসে মধ্যবর্তী একটি স্থান দখল করে বসলেন। চোখ বন্ধ করে ধ্যানে নিমগ্ন হলেন। পাশে রাখা দক্ষিণার চাদরটি তখন স্তূপীকৃত। চেলারা উচ্চস্বরে কীর্তন গেয়ে চলেছে। অধীর আগ্রহে সবাই স্টীমারের জন্য অপেক্ষা করতে থাকল।

নটা নাগাদ দিগন্তে দেখা গেল স্টীমারের ধোঁয়া। শোরগোল শুরু হয়ে গেল দর্শকদের মধ্যে। সবাই উৎকণ্ঠিত স্বচক্ষে এটা দেখার জন্য যে বাবাজি কিভাবে অত বড় যন্ত্রকে গিলে খান। চেলাদের কীর্তনের গতি ও স্বর বৃদ্ধি পেল।

ধীরে ধীরে স্টীমার যখন ঘাটের কাছাকাছি হাজির, বাবাজি উঠে দাঁড়ালেন। ধীর পায়ে নেমে এসে দাঁড়ালেন গঙ্গা বক্ষে। শূন্যে দু হাত মেলে ধরলেন। সটীমার তখন মাত্র কয়েক মিটার দূরে। হঠাৎ এক চেলা লাফিয়ে বাবাজির সামনে এসে চেঁচিয়ে বলে উঠল ‘প্রভু দোষ তো ঐ ক্ষুদ্র কলটা করেছে। যাত্রীদের তো কোন দোষ নেই। ঐ নিরপরাধ প্রাণীগুলোর মুখ চেয়ে ওটাকে এইবারের মতন মাফ করে দিন’। বলেই সে বাবাজির পা দুটো চেপে ধরে হাউ-হাউ করে মরাকান্না কাঁদতে লাগল।

স্টীমার তখন বাবাজির একদম সামনে। শূন্যে হাত নেড়ে উনি বললেন ‘যাঃ তোকে এইবারের মতন মাফ করে দিলুম। বেঁচে গেলি এ যাত্রায়।’ চারিদিকে উচ্চস্বরে শুরু হল পুনরায় বাবাজির জয়-জয়কার। বেশ কয়েক গাঁটরি কাপড় ভরে গেল দানসামগ্রীতে।

বলা বাহুল্য পরের দিন বাবাজির তাঁবু আর দেখতে পাওয়া যায়নি। লোক মুখে শোনা গিয়ে ছিল তিনি নাকি আবার হিমালয়ের উদ্দেশ্যে প্রস্থান করেছেন। দেবাদিদেব মহাদেব নাকি ওনাকে স্বপ্নাদেশ দিয়েছেন।


লেখক পরিচিতি : দেবাশিস চৌধুরী
দীর্ঘকাল কর্মসূত্রে আমি লখনৌতে প্রবাসী। গল্প লেখাটা আমার একটা প্রিয় সখ। আমার গল্প পড়ে সবার মনোরঞ্জন হোক, এটাই আমার কামনা।

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

One comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।