অপরূপা রাজকন্যা (ঐতিহাসিক গল্প)

লেখক: মিত্রা হাজরা

উঁচু নীচু পাহাড়ের সীমানার পদতলে বিস্তৃত বনভূমি যেন তপস্বীর মত স্থির নিশ্চল। ঢালুপথ বেয়ে সামনে সমতলে সবুজ সমারোহের মাঝে মন্দির, কোটেশ্বর মন্দির। এই মন্দিরে পুজো দিতে এসেছেন কনৌজের রাজকুমারী সংযুক্তা, সখী সমভিব্যহারে। রূপে, গুণে অসামান্য এই রাজকুমারীর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে গোটা ভারতবর্ষে। সেই খ্যাতি শুনেছেন পৃথ্বীরাজ চৌহান। তিনি সেই সময়ের এক বীর সাহসী রাজপুত রাজা, যিনি রাজত্ব করছেন দিল্লি ও আজমীরে।

কৌতূহলী হয়ে রাজা এলেন কোটেশ্বর মন্দিরে ছদ্মবেশে। রাজকুমারী রাজাকে দেখে তো মুগ্ধ, রাজারও সেই অবস্থা। চৌহান রাজা কিন্তু পড়ে গেলেন সমস্যায়, কারণ কন্যা যে শত্রু রাজা জয়চাঁদের, যার সাথে পৃথ্বীরাজ চৌহানের বিবাদ সর্বজনবিদিত। কনৌজের এই রাজা পৃথ্বীরাজকে একদম সহ্য করতে পারেন না, যে কোন উপায়ে পৃথ্বীরাজের ক্ষতিসাধন করতে চাইতেন।
কিন্তু প্রেম আর কবে নিয়ম মেনে চলেছে। ছোটবেলা থেকেই পৃথ্বীরাজের বীরত্বের কাহিনি শুনে শুনে সংযুক্তার ভালো লাগতে শুরু করে পৃথ্বীরাজকে। এখন দেখার পর ধীরে ধীরে ভালোবাসা বাড়তে লাগল। দুজনের সম্পর্ক নিবিড় হতে থাকল। পৃথ্বীরাজের শিক্ষিত পারাবত, তাঁর পত্র পৌঁছে দিত সংযুক্তার কাছে।

এই কথা একদিন কনৌজের রাজা জয়চাঁদের কানে গেল। এত সাহস ঐ চৌহানের, বামন হয়ে চাঁদে হাত! তিনি কন্যার জন্য স্বয়ংবর সভার আয়োজন করলেন, বললেন – যে সমস্ত রাজা বা রাজকুমার আসছেন, তার মধ্য থেকে তুমি তোমার স্বামী বেছে নাও। ভুলে যাও ঐ চৌহানকে, ও কোনওমতেই তোমার যোগ্য হতে পারে না। সমস্ত রাজ্যের রাজা ও রাজকুমারদের আমন্ত্রণ জানানো হলো, শুধু বাদ গেলেন পৃথ্বীরাজ চৌহান। আরও অপমান করার জন্য, তাঁর একটা মূর্তি বানিয়ে দ্বারপালের জায়গায় বসানো হলো। চিন্তায় পড়ে গেলেন সংযুক্তা, গোপনে সব খবর জানালেন পৃথ্বীরাজকে। পৃথ্বীরাজ বললেন — কোনও চিন্তা করো না, আমি তোমার উদ্ধারের সব ব্যবস্থা করব।

নির্দিষ্ট দিনে সিংহাসনে বিরাজমান রাজা জয়চাঁদ, সভা আলো করে বসে আছেন সব নিমন্ত্রিত রাজারা, সালাঙ্কারা রাজকুমারী সংযুক্তা সখীদের নিয়ে এসে উপস্থিত হলেন স্বয়ংবর সভায়। জয়চাঁদ উঠে এসে পরিচয় করাচ্ছেন, — এই আমার কন্যা সংযুক্তা, আজ নিজের পতি নিজে নির্বাচন করবেন। সেখানে তখন আছেন মালবা, বুন্দেলখণ্ড, গুজরাট প্রভৃতি রাজ্যের রাজারা, একে একে সব রাজাদের ছেড়ে সংযুক্তা এলেন সেই দ্বারপালের মূর্তির কাছে এবং মূর্তির গলায় বরমাল্য পরিয়ে দিলেন। ক্রোধে জয়চাঁদ চিৎকার করে উঠলেন — সংযুক্তা, এটা কী করলে তুমি! সভাস্থ রাজারা সব হতচকিত হয়ে গেলেন, ছদ্মবেশে ঐ সভাস্থলেই পৃথ্বীরাজ ছিলেন, সংযুক্তার হাত ধরলেন, কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাঁকে নিয়ে ঘোড়ায় চেপে পালিয়ে গেলেন। কনৌজের সেনারা ধাওয়া করল তাঁদের, এখন কনৌজ আর চৌহান সেনাবাহিনীর মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হলো। কনৌজের সেনা পরাজিত হলো, পৃথ্বীরাজ দিল্লি এসে সংযুক্তাকে বিবাহ করলেন।

আনন্দে দিন কাটাতে লাগলেন পৃথ্বীরাজ আর সংযুক্তা, কিন্তু শ্বশুর জয়চাঁদ এই অপমান আর পরাজয়ের বদলা নেওয়ার জন্য সুযোগ খুঁজতে লাগলেন। এদিকে আফগানিস্তানে ঘোরী সাম্রাজ্যের সুলতান গিয়াসুদ্দিন ঘোরীর মৃত্যু হয়েছে, নতুন সুলতান হয়েছেন মুইজুদ্দিন মুহম্মদ ঘোরী, যিনি মুহম্মদ ঘোরী নামে প্রসিদ্ধ। তিনি সাম্রাজ্যের বিস্তারে মন দিয়েছেন, লক্ষ্য ভারতবর্ষ, ধনসম্পদের প্রাচুর্য, শস্য-শ্যামল ভারতবর্ষ জয় তাঁর একমাত্র ইচ্ছা। তিনি গুজরাট আক্রমণ করেছেন, এবং ভীমদেবের হাতে পরাজিত হয়ে পলায়ন করেছেন। আশা ছাড়েননি, বারবার হানা দিচ্ছেন — সহসা তিনি পাঞ্জাবের ভাতিন্ডা দুর্গ অধিকার করে নিলেন।

এই স্থানটা ছিল পৃথ্বীরাজ চৌহানের সীমান্ত এলাকা, পৃথ্বীরাজের টনক নড়ল, তিনি সসৈন্য ভাতিণ্ডার দিকে অগ্রসর হয়ে, তরাইন নামক স্থানে প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হলেন — পৃথ্বীরাজের বাহিনী তিন দিক থেকে আক্রমণ করেন মুহম্মদ ঘোরীকে, পরাজিত ও মারাত্মকরকমের আহত হয়ে ময়দান ছেড়ে পালিয়ে যান। এটিই ১১৯১ খ্রিঃ তরাইনের প্রথম যুদ্ধ নামে খ্যাত। এই হার মুহম্মদ ঘোরীকে অস্থির করে তোলে, নিজের যুদ্ধকৌশল পালটান এবং বিশাল সেনা সমাবেশ করেন। পরের বছরই এক লাখ বিশ হাজার সেনা নিয়ে ভারত আক্রমণ করেন, সেই তরাইনের প্রান্তরে সামনা সামনি হন পৃথ্বীরাজের, এবার পৃথ্বীরাজ বুঝেছিলেন এ যুদ্ধ এত সহজ হবে না, তিনি সমস্ত রাজাদের কাছে সাহায্যের জন্য প্রার্থনা করলেন — কিন্তু সে সময় কনৌজের, বুন্দেলখণ্ড, গুজরাট, কেউ এগিয়ে এলেন না, ভীমদেব, জয়চাঁদ তো তাঁর এই অবস্থায় খুশিই হয়েছিলেন, তাঁরা মুহম্মদ ঘোরীকে বন্ধু মেনে কোনও সাহায্য করলেন না।

এদিকে মুহম্মদ ঘোরী সন্ধি প্রস্তাব নিয়ে কথা চালাতে লাগলেন, আর রাতের অন্ধকারে ঝাঁপিয়ে পড়লেন রাজপুত সেনাদের উপর, সৈন্যরা সামাল দেবার অনেক চেষ্টা করলেন, কিন্তু রাজপুতরা যুদ্ধের নিয়ন্ত্রণ হারালেন। পৃথ্বীরাজ বন্দী হলেন — কোনও কোনও ঐতিহাসিকের মত পৃথ্বীরাজ যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন। কিন্তু চন্দ্রবরদাই — ‘পৃথ্বীরাজ রাসোয়’ লিখেছেন, পৃথ্বীরাজকে বন্দী করে তাঁর চোখ অন্ধ করে দিয়েছিলেন ঘোরী। এই চন্দ্রবরদাই — পৃথ্বীরাজের বন্ধু, কবি ও মহাপণ্ডিত মানুষ ছিলেন।

যখন চন্দ্রবরদাই — পৃথ্বীরাজ চৌহানের সাথে দেখা করতে এসেছিলেন বন্দী অবস্থায়, তিনি মুহম্মদ ঘোরীকে বলেছিলেন — পৃথ্বীরাজ শব্দভেদী বাণ চালাতে জানেন। কৌতূহলী হয়ে হাতের বাঁধন খুলে তাঁর হাতে তীর ধনুক তুলে দিয়েছিলেন ঘোরী। চন্দ্রবরদাই — পৃথ্বীরাজকে একটা দোঁহা শুনিয়েছিলেন —
‘চার বাঁশ চব্বিশ গজ, অঙ্গুল অষ্ট প্রমাণ
তা উপর সুলতান হ্যায়, মত — চুক চৌহান’।
দিশা ও দূরত্ব বুঝতে পেরে পৃথ্বীরাজ চৌহান তীর চালিয়ে ঘোরীকে বধ করেছিলেন। এরপরে চন্দ্রবরদাই পৃথ্বীরাজকে মেরে নিজে আত্মঘাতী হয়েছিলেন।

এই পরাজয়ের খবর শুনেই সংযুক্তা রাজপুত নারীদের নিয়ে জওহর ব্রত করে আত্মাহুতি দেন। পৃথ্বীরাজ চৌহান তাঁর বীরত্ব ও দেশপ্রেম নিয়ে আজও অমর হয়ে আছেন ইতিহাসের পাতায়। সেই সময় ভারতীয়দের মধ্যে বহুকাল ধরেই অনৈক্য একটা সমস্যা ছিল, তাই বিদেশি শক্তিকে প্রতিহত করার কোনও শক্তি জোটই গড়ে ওঠেনি কখনও, এর মাধ্যমেই মুসলিম শাসন শুরু হয়েছিল ভারতবর্ষে।


লেখকের কথা: মিত্রা হাজরা
আমি মিত্রা, লেখালেখি করতে ভালোবাসি, কবিতা, ছোটগল্প লিখি মাঝে মাঝে। বই পড়তে ও গান শুনতে ভালোবাসি। পড়ি শংকর এর লেখা, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর লেখা, আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প আমার খুব প্রিয়। জীবনানন্দ দাশ, রুদ্রমুহম্মদ শহিদুল্লা, সুনীল, বিষ্ণু দে এর কবিতা পড়তে ভালোবাসি। আমার লেখা পড়ে আপনাদের ভালো লাগলে বা খারাপ লাগলে অবশ্যই জানাবেন।

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

3 Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।