শিক্ষক দিবস

লেখক: অয়ন মৈত্র

২০ থেকে ৪০ — এই সীমার মধ্যে যাদের রোল হয় স্কুলে,তাদের নাম, সাধারণত কোনো মাস্টারমশাই জানেন না। স্বাভাবিক। এই মহাবিশ্বের কোটি কোটি নক্ষত্রের ভীড়ে কেবল তাদেরই নামকরণ হয় যারা কোনো-না কো্নো গ্রহের খুব কাছে অবস্থান করে। কেবল তাদেরই নামকরণ হয় যাদের বিচ্ছুরণে সবচেয়ে বেশি আলো বেরোয়। কেবল তাদেরই নামকরণ হয় যারা আকৃতিতে বিশাল হ্য়। এর মাঝে রোজ কত শত নক্ষত্র মহাকাশের কোনো সুদূর কোণে চুপচাপ মরে যায়।বিস্ফোরণের আওয়াজ নয়, পৃথিবীতে এসে পৌঁছয় তাদের ধ্বংসের আলোটুকু। বিজ্ঞানীরা তাই সব নক্ষত্রের নামকরণ করেন না।

আমি যখন ছাত্র ছিলাম আমার চোখে শিক্ষকরা স্পষ্ট দুটো ভাগে বিভক্ত ছিল। এক শ্রেণীর স্যর যারা ভীষণ মারেন; আরেক শ্রেণীর স্যর যারা মারেন না, কিন্তু এমন ব্যক্তিত্বের অধিকারী যে তাদের সামনে কথা বলতে গেলে ভয় হত যে আমার কোনো কথায়, কোনো অজ্ঞানতায় না উনি অপমানিত হন। ফলে কোনোদিন আমার আর জিজ্ঞেস করা হয়ে উঠল না -– ‘এই অঙ্কের শেষটা ঠিক বুঝতে পারলাম না… আরেক বার বুঝিয়ে দেবেন স্যর! সবাই যেখানে একেবারেই বুঝে গেল, সেখানে আমার এই বুঝতে না পারা এটাই প্রমাণ করে যে – অঙ্ক আমার জন্যে না। ইংরাজিতে ‘ফ্রেন্ড’-এর সমার্থক জানতে চেয়েছিলাম এক শিক্ষকের কাছে। আমার দিকে তাকিয়ে উনি বললেন-কেন?কি কাজে লাগবে?আমি ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে বললাম — না মানে এমনি স্যর! বললেন, ‘দুঃখের সময় যে পাশে দাঁড়ায় সেই প্রকৃত বন্ধু’ — এটা আগে ট্রান্সলেট কর। পারলে, বলব। ইংরেজিতে কাঁচা আমার সেদিন আর জানাই হল না ‘ফ্রেন্ড’-এর সমার্থক হয় কিনা।

সেই বয়সে একটা কথা বুঝেছিলাম — স্যরেরা শুধু প্রথম আর শেষ বেঞ্চের ছাত্রদেরই চেনেন। মাঝখানের বেঞ্চগুলো শুধু সংখ্যা। যারা শেষ বেঞ্চে বসত তারা কেউ পড়াশোনা করত না কিন্তু খেলাধুলো আর বদমায়েশিতে প্রথম ছিল। যারা প্রথম বেঞ্চে বসত, তারা কেউ খেলাধুলো করত না কিন্তু পড়াশোনা, আবৃত্তি, গান, আঁকা-তে প্রথম ছিল। এই চরম উত্তর আর চরম দক্ষিণের মাঝে আমরা ছিলাম এক আদি অন্তহীন গ্রস্ত উপত্যকা। এ-দেশের মধ্যবিত্তের ডাকনাম যেমন -– ‘লোকটা’, তেমনি রোল ২০ থেকে ৪০-এর পরিচিতি ছিল — ‘ছেলেটা’। আরেকটু বড় হয়ে বুঝেছি দুর্গাপুজো সেই বাড়িতেই হয় — যে বাড়ির একটা ঐতিহ্য থাকে। শিক্ষকেরা হলেন — দুর্গা ঠাকুর। ভাড়া বাড়িতে থেকে দুর্গাপুজো যে হয় না, এটা বুঝতে অনেক বছর লেগে গেল আমার।

মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে ছাত্র ছাত্রীদের সম্পর্কটা অনেকটা ডাক্তারবাবুর সঙ্গে রুগীর মত। সব রুগীই এই অন্ধবিশ্বাস রাখে যে ডাক্তারবাবু আমায় ঠিক ভাল করে দেবেন। সব রুগীই এই অন্ধবিশ্বাস রাখে যে ডাক্তারবাবু যে ওষুধটা দিচ্ছেন সেটা আর যাচাই করার দরকার নেই। ডাক্তারবাবু কখনো ভুল ওষুধ দেন না। সব রুগীই এই অন্ধবিশ্বাস রেখে অপারেশন টেবিলে ওঠে যে — এরপর আমার আবার জ্ঞান ফিরবে, এরপর আর কষ্ট পাব না। ঘটনা হল, এই বিশ্বাস রেখে ঠকে গেছে যারা, তারা এরপরও আবার বিশ্বাস করে আগের মতই সব ডাক্তারবাবুদের। ক্লাসে ঢোকার পর থেকে পৃথিবীর সমস্ত মাস্টারমশাইয়ের সাথে এই ঘটনাই ঘটে। প্রতিদিনের এই নিরন্তর অভ্যেস সেই লোয়ার কেজি থেকে শুরু হয়েছিল আমাদের, যখন ক্লাসরুমে মা’কে ছাড়াই প্রথমবার এতক্ষণ থাকতে হয়েছিল। সামনের ঐ মহিলাটিকে যাকে আমি কোনোদিনও আমার বাড়িতে দেখিনি, সেই মহিলাটিকে কেঊ ‘মিস’ কেউ বা ‘দিদিমণি’ বলে ডাকছে, তাকে প্রবলভাবে বিশ্বাস করা ছাড়া আমার সে সময় কোনো ঊপায় ছিল না। ঐ ‘মিস’ যেমন যেমন বলতেন, ঠিক তেমন তেমন করার চেষ্টা আমরা সবাই করেছি, মোটেও এই ভেবে নয় যে উনি যা বলছেন ন — সব ঠিক বলছেন। উনি যা বলছেন — সব আমার ভাল’র জন্য বলছেন। ওনার সব কথা মেনেছি, কারণ সেই কয়েকঘণ্টা আমার ওনাকে বিশ্বাস করা ছাড়া কোনো ঊপায় ছিল না যে আমাকে উনি মারবেন না। সেই কয়েক ঘণ্টা আমাকে উনি একটা ভরসা দিয়েছিলেন — দু-ঘণ্টা বাদে আমি ঠিক বাড়ি ফিরে যেতে পারব মায়ের কাছে।
মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের সম্পর্কের মূল ভিতটাই দাঁড়িয়ে আছে এই ভরসার উপর। এর অনেক অনেক পর আসে, ইতিহাস, ভূগোল, অঙ্ক, বিজ্ঞান, সিলেবাস, সাজেশান, পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বর। এই অকৃত্রিম বিশ্বাস থেকেই মাস্টারমশাই যা বলেন সব না-লিখলেও, সব না-শুনলেও যতটা শুনেছিলাম তার সবটা — সবটা বিশ্বাস করেছিলাম সেদিন। আজও সে বিশ্বাস অটুট। মাস্টারমশাই আর ডাক্তারবাবুদের উপর আমাদের আস্থাটা এমনই সেই সৃষ্টির শুরু থেকে যে জীবনে এগোনোর পথে মানুষ থেকে ঈশ্বর, সরকার থেকে পুলিশ অনেক কিছুর উপর থেকেই আমাদের আস্থা কমে, কেবল এঁদের দুজনের উপর ছাড়া।

আজ বেঞ্চের এই পাড়ে দাঁড়িয়ে আছি আমরা যারা, তাদের যোগ্যতার পরীক্ষা দিতে হবে যে আমরা এই আকুলপারা বিশ্বাসের যোগ্য কিনা। আমরা দায়বদ্ধ এই পরীক্ষা দিতে কারণ আমি মনে করি শিক্ষক/শিক্ষিকা ঈশ্বর হয়ে গেলে মুশকিল। ঈশ্বর আর ঠাকুরের মধ্যে একটা প্রভেদ আছে। ঈশ্বর আরাধিত হন, ঠাকুর পূজিত। ঈশ্বর আরাধনায় কেবল ব্রাহ্মণের অধিকার থাকে। শিক্ষককে হতে হবে ঠাকুর — যার পুজো নকুলদানাতেও হয়, আবার সিন্নিতেও হয়। যার পুজো সাত বছরের মেয়েও করতে পারে আবার মেথর বাড়িতেও ধুমধামের সাথে হয়। যার পুজো অভ্রভেদী দেবালয়ে হয়, আবার খুপরি ঘরের আলো না ঢোকা কুলুঙ্গিতেও হয়।

আজ বেঞ্চের এই পাড়ে দাঁড়িয়ে আছি যারা, আমরা কি সেই মেয়েটির প্রতিটা বুঝতে না পারা দ্বিধাগ্রস্ততাকে কি একশো বার ধরে বুঝিয়ে গেছি বিরক্তিহীনভাবে সমান উৎসাহের সঙ্গে যতক্ষণ না সে বলছে — ‘এবার বুঝতে পেরেছি,স্যর।’ যদি পেরে না থাকি তবে এ শিক্ষক দিবস আমার জন্যে নয়। ওই পুঁচকে গুলোর প্রতিটা অপ্রাসঙ্গিক, সিলেবাস বহির্ভূত প্রশ্নের সম্মুখে আমি কি পাল্টা প্রশ্ন করে তার এ প্রশ্নের কারণ এবং কার্যকারিতা জানতে চেয়েছি, নাকি আমার সীমিত সামান্য সাধ্যের মধ্যে তার যুক্তিগ্রাহ্য উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছি। যদি তার প্রশ্নের উত্তরে আমি তাকেই প্রশ্ন করে থাকি, তাহলে এ সম্মানের অধিকারী আমরা নই কারণ ওই ছোট-বড়-মেজ সমস্ত অবুঝগুলোকে আমি কেবল উত্তর দিতে শিখিয়েছি — প্রশ্ন করতে নয়। এ পদ্ধতি অফিস বসের, শিক্ষকের নয়। তাই এ সম্মান আমার জন্য নয়।

শিক্ষক দিবসের প্রাক্কালে আজ জড়তাহীনভাবে, কুণ্ঠাহীনভাবে আমরা একবার স্বীকার করেই ফেলি না , তোমরা, প্রতিটা ছাত্রছাত্রী আমার একেকজন শিক্ষক। একেকজন শিক্ষিকা। তোমাদের থেকে আমি যা যা শিখি রোজ রোজ, তার একটাও আমি আজ অবধি কোথাও পড়িনি। কেউ শেখায়নি আমায়।

ক্লাস ফাইভের এক ছাত্রীর উত্তরপত্রে যেদিন দেখেছিলাম – জীবন ধারণের জন্য অপরিহার্য উপাদান- জল কিংবা অক্সিজেন নয়- মা,সেদিন অবাক হয়ে গেছিলাম।পর দিন ওকে এই উত্তরের কারণ জানতে চেয়েছিলাম।ও বলেছিল- মা ছাড়া আমরা তো জন্মাতামই না স্যর।মা না থাকলে কে আমাদের বড় করত,কে খাইয়ে দিত?এই অপার্থিব ইনোসেন্সের রাজত্বে অনায়াস পায়চারী করতে যে যোগ্যতা লাগে,আমার তা নেই।ক্লাস ফাইভের সেদিনকার সেই ছাত্রী আমার প্রথম শিক্ষিকা, যে শিখিয়েছিল – সরলতার ঠিক কত গভীরে নামলে, ফিট, ফ্যাদম সমস্ত একক একেকার হয়ে কেবল দর্শন পড়ে থাকে।আমি প্রণাম জানাই আমার সেই ছোট্ট প্রথম শিক্ষিকা কে। আমি প্রণাম জানাই অষ্টম শ্রেণীর সেই ছাত্রীটির মনের জোরকে, যে তার মা’কে সকালে কবর দিয়ে পরের দিন পরীক্ষা দিতে আসে তার আম্মীজানের কথা রাখতে যে — কোনো কিছুর জন্যই পড়াশোনা বন্ধ করবি না। আমি মরে গেলেও না। ওর বুকের পাঁজর আমি তৈরী করিনি, আমরা কেউ কোনোদিন ওকে এই অতিমানবিক মনের জোরের উৎসমুখ দেখাইনি, কারণ আমরা নিজেরাই এর উৎসমুখ খুঁজে পাইনি। শিক্ষক দিবসের এই আদি লগ্নে আমি প্রণাম জানাই তাকে, আমার শিক্ষিকাকে। আমি প্রণাম জানাই ক্লাস সেভেনের সেই দুটি ছাত্র ছাত্রীকে যারা পরীক্ষায় আমার অসাবধানতায় অতিরিক্ত তিন নম্বর পেয়ে আমার কাছে এসে নম্বর কমিয়ে নিয়ে যায়। এ-সততা ওই বয়সে আমার অনন্ত ছিল না। আমি প্রণাম জানাই আমার সেই দুই শিক্ষক-শিক্ষিকাকে। প্রণাম জানাই ক্লাস সিক্সের সেই ছেলেটিকে যে স্কুল আসবার সময় খেতে খেতে দেখে সামান্য যে ভাতটুকু সেদিন তার মা ধুম জ্বর গায়ে রাঁধতে পেরেছিল, তার সবটা মা তাকেই দিয়ে দিয়েছে নিজের জন্যে এক কণাও না রেখে। মা’কে মিথ্যে বলে নিজের টিফিন খাওয়ার পয়সা জমিয়ে মায়ের জন্য চাল কিনে নিয়ে আসবার পথে বাজারে আমার সঙ্গে দেখা হয়, আর আমি তখন কিনা তাকে শিখিয়ে এলাম না-জেনে না-শুনেই অযথা স্কুল কামাই করা উচিত নয়।

আমরা যারা শিক্ষা দান করি রোজ রোজ তারা শিক্ষা গ্রহণও করি এই সমস্ত অঙ্কুরিত প্রেরণা থেকে। কিন্তু স্বীকার করি না তাদের অবদানটা — কিছুটা সংকোচের বিহ্বলতায় আটকে গিয়ে, কিছুটা শিক্ষক এই পদমর্যাদার যুগযুগান্তরের প্রোটোকলে আটকে গিয়ে।

আমরা যারা বন্যার মধ্যেও শাড়ি গুটিয়ে, কিংবা এক কোমর জলে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা দিবসে পতাকাটা স্রেফ তুলতে তিরিশ কিমি পথ পাড়ি দিয়েছি, তারা সেদিনই ওই হাফপ্যান্ট আর ফ্রক-পড়া ছেলেমেয়েগুলোকে বুঝিয়ে দিয়েছি আমাদের অজান্তেই ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল কারণগুলো।

আমার এক মাস্টারমশাই বলতেন — মাস্টার আর রাজ মিস্তিরির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই স্রেফ পোশাকটুকু ছাড়া। দুজনেরই ভিত গড়া কাজ। দুজনেই কাজের শেষে ধুলো মেখে ভূত হয়। একজন সিমেন্টের আরেকজন চকের।

শিক্ষক দিবসের এই অস্তমিত প্রগাঢ়তায়, আমরা আজ বরং আশীর্বাদ করব না। ওটা ঈশ্বরের কাজ। আমরা ঈশ্বরও নই। আমরা শিক্ষক-শিক্ষিকাও নই। আমরা সবাই  ওদের মতই ছাত্রছাত্রী। শুধু ওরা বেঞ্চে বসে, আর আমরা চেয়ার-টেবিলে। এটুকুই যা।

ঐ সব খুদে খুদে মুখে
ঐ সব গোল গোল চোখে ওরা রোজ দেখে তোমাকে।
কিভাবে তোমার বলা প্রতিটা শব্দ, কথা,
কিভাবে তোমার নাড়ানো হাত, রোজ ত্রিভুজ আঁকে চকে।
ঐ সব খুদে খুদে হাত
সর্বদা প্রস্তুত এঁকে বেঁকে যেতে তোমার ইশারা যত।
ঐ সব খুদে খুদে হাত, রোজ স্বপ্ন দেখে
একদিন হবে ওরা বড় হয়ে, একদম তোমার মত।
ঐ সব খুদে খুদে বুকে তুমি রোজ ভিত গড়ে তোলো
রোজ তুমি ধীরে ধীরে বনে যাও — মন্দির, মসজিদ, গির্জা।
যে জানালা বন্ধ ছিল এতকাল, আজ অবারিত হল
ঐ সব খুদে খুদে বুকে, ভরবেগ তুমি, তুমিই গালিব মির্জা।
ঐ সব খুদে খুদে মনে তুমি রোজ আসা যাওয়া করো — 
নির্ভুল, নিষ্পলক — কোনো শব্দ ছাড়াই।
 ঐ সব খুদে খুদে নিঃশ্বাসে রোজ তুমি বের হও —
বের হও তুমি দ্বিধাহীনভাবে — কোনো প্রশ্ন ছাড়াই।
তুমি আর একা নও, আর একা নও
চেয়ে দেখ, ওরাও বলছে আজ তোমারই মত হবে।
বলেছিলে তুমি ঐ খুদে খুদে পিঠে হাত রেখে যবে,
কাঁদিস না, আমি জানি — একদিন তোরও হবে।



শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।