ভালো থাকা

লেখক: রুবাই শুভজিৎ ঘোষ

জানলা থেকে পর্দাটা সরাতেই বিকালের সূর্যের হাল্কা তেজ ছুঁয়ে গেল পিউয়ের কপাল, নাক, থুতনি, গলা, হাত। রোজই অফিস যাবার সময় সূর্য তাকে ছুঁয়ে যায় অনেকবার। কিন্তু এরকম অনুভব আগে হয়নি তার। সূর্যের তাপের অনুভব বলতে শীতকালে একটু ভালো লাগা আর গরমে বিরক্ত লাগা। কিন্তু আজকে কেমন অন্যরকম লাগছে তার। বলতে গেলে বেশ ভালোই লাগছে। আরও একটু উষ্ণতা পাবার ইচ্ছেতে জানলাটাই খুলে ফেলল সে।
“কি করছ?” বলে উঠল বিতান, “এসি চলছে যে!”
কিন্তু কোনও উত্তর দিল না পিউ। দূরের সমুদ্রটা তাকে কেমন আনমনা করে দিয়েছে।
“কি হল?”, আবার জিজ্ঞেস করল বিতান। কিন্তু পিউয়ের কাছ থেকে কোনও উত্তর না পেয়ে উঠে তার পাশে এসে দাঁড়াল বিতান। দুরের ঐ সমুদ্রের ঢেউদের এগিয়ে আসা আর চলে যাওয়া তাকেও কেমন আনমনা করে দিল। রোদের আর পিউয়ের ছোঁয়ায় কেমন মোহিত লাগল নিজেকে। নিজের অজান্তেই তার ঠোঁটের হাসিটা লম্বা হয়ে গেল। কতদিন পর সমুদ্র দেখছে সে মনে করতে পারল না। তার পনেরো তলা অফিসের কেবিন থেকে শহরটাকে অন্যরকম লাগে, শহরের অনেক দূর অবধি দেখা যায়, কিন্তু অনেক দূর অবধি তাকিয়েও সমুদ্রের এই ঢেউ দেখা যায়না। পিউয়ের কনুইয়ের কাছে স্পর্শ করতে পিউ ঘুরে দাঁড়াল।

“কিরে তোরা এখনও রেডি হোসনি?”, সাগ্নিকের ডাকে পিছনে ফিরল দুজনে। একটু যেন লজ্জা পেয়ে দুজন দুজনের থেকে সরে দাঁড়াল। সাগ্নিক, সোমা, রণজয়, রিনি, সমর, মিমি সবাই রেডি।
“চ’ একবার বিচে ঘুরে আসব না?” রিনি বলল,”এরপর তো বিকেল হয়ে যাবে রে”।
“হ্যাঁ তোরা এগো বরং! আমরা আসছি।” পিউ বলল।
“ঠিক আছে। আমরা এগোলাম”, সাগ্নিক বলল। সবাই এগিয়ে গেল। কিছুদুর থেকে সাগ্নিকের আওয়াজ ভেসে এল, “আসিস কিন্তু!”
হাসল পিউ, “চলো! রেডি হয়ে যাই!”
“চলো!” বিতান বলল।

হোটেলের পিছন দিয়েই সমুদ্রে যাওয়ার রাস্তা। বেশ কয়েক পা হাঁটলেই সমুদ্র। ভাবতেই কেমন লাগে বাড়ির এতটা কাছেই সমুদ্র। মাত্র তিন চার ঘণ্টার তো পথ। অথচ তাদের ঘুরতে আসার সময় হয়নি কখনও। বিয়ের আগে যেখানে তারা প্রায়ই ঘুরে বেড়াত এই বন্ধুদেরই সাথে, কিন্তু বিয়ের পর কোথাওই তারা ঘুরতে যায়নি এই কয়েক বছর। বিয়ের পর কেমন বদলে গেল সব। বদলে ফেলল তারা নিজেরাই। বিয়ের পরে দুজনে একসাথে বড় তিনকামরার একটা ফ্ল্যাট নিল। কমপ্লেক্সের ভেতরেই পার্ক, সুইমিং পুল। কয়েকদিন পর তাদের স্বপ্নের গাড়ি। আরও কিছুদিন পর অফিস থেকে একসাথেই বিদেশযাত্রা। জীবনটাকে ভালোভাবে কাটানোর জন্য তারা পরিশ্রম করল খুব। কিন্তু গাড়ি, বাড়ি, বিদেশ, স্ট্যাটাস, ভালো থাকবার এই নতুন সংজ্ঞায় কোথায় যেন ভালো থাকতেই ভুলে গেল তারা। আজ হঠাৎ করে মনে হল তাদের।

সমুদ্রের জলের ছোঁয়ায় যখন পায়ের পাতা ভিজে গেল পিউয়ের,  কেমন একটা শিহরণ হল তার শরীরে। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বিতানের হাত শক্ত করে চেপে ধরল সে। অনেকদিন এভাবে তারা দুজনের হাত ধরেনি। আগে পিউয়ের হাত ধরে তাকে রাস্তা পাড় করাতো বিতান। এখন পাড় হওয়া বলতে গাড়িতে বসে লাল সিগন্যালগুলো পাড় হয় তারা। তাই হাত ধরার প্রয়োজন সেভাবে পড়েনা। অথচ এই ছোট্ট ছোট্ট অনুভূতিগুলো কত ভালো লাগা এনে দেয়। কিন্তু কথায় যেন হারিয়ে ফেলেছিল তারা। এখন আবার হাত ধরেই সমুদ্রের পাড়ে হাঁটতে লাগল। ঠিক যেমন আগে হাঁটত। সমুদ্র মাঝে মাঝে হাল্কা ঢেউয়ে ভিজিয়ে যেতে লাগল তাদের পায়ের পাতা, গোড়ালি। দূরে দূরে সকলেই তাদের সঙ্গীর হাত ধরে হাঁটছে।
“ঐ দ্যাখো!”, দুরের আকাশে সূর্যটার দিকে তাকিয়ে উৎসাহিত পিউ বলল, “কি সুন্দর না!” সূর্যটা তখন আস্তে আস্তে ডুব দিচ্ছে পশ্চিমের আকাশে। অনেকদিন পর একসাথে সূর্যাস্ত দেখল তারা। নাহলে ঘর আর অফিসের সেন্সর এলইডি লাইটগুলোর তাদের পায়ের ইশারায় জ্বলা-নেভার ফলে সূর্যের সাথে সম্পর্কটা অনেকটাই কমে এসেছিল তাদের। কিন্তু আজ বুঝল সূর্যের সাথে মানুষের সম্পর্ক সেই শুরু থেকেই। তাকে অস্বীকার করা সহজ না। চলতে চলতেই বিতানের কাঁধে মাথা রাখল পিউ।

তাদের হারানো জীবনের হারানো ভালো লাগা গুলো ফিরে আসছে এখন। হোটেলের সামনে বিশাল এই জায়গাটায় তারা গোল হয়ে বসে আছে ক্যাম্পফায়ারের আগুন ঘিরে। শেষ কবে এই আগুন দেখেছিল পিউ অনে করতে পারছে না, পারছে না বিতানও। আগুনের আলোয় কি সুন্দর লাগছে পিউকে।
“কি দেখছ?” পিউ জিজ্ঞেস করল আস্তে আস্তে।
“তোমায়!” বিতান হাসল।
“ধ্যাৎ”, আদরের একটা ধমক দিল পিউ।
“কতদিন কিন্তু আমাদের কোনও ট্যুর হয়নি বল?” সাগ্নিক বলল।
সবাইই ওর সাথে একমত হল।
“না না এবার থেকে মাসে একটা ট্যুর করি!” সাগ্নিক বলল। কিন্তু উত্তরে হেসে উঠল সবাই।
“তুই আসিস!” রিনি বলল।
সাগ্নিক এরকমই। অতি উৎসাহিত হয়ে থাকে সব সময়। এই ট্যুরটা ওইই আয়োজন করেছিল।
“তবে যাই বল।”, রণজয় বলল, “এই ট্যুরটাও কিন্তু ওর জন্যই হল”।
সবাই একবাক্যে মেনে নিল সেটা।
“না সাগ্নিক!”, বিতান বলল, “তুমি করো অ্যারেঞ্জ! আমি আছি!  প্রতি মাসে না হোক, প্রতি কোয়ার্টারে তো হতেই পারে।”
“থ্যাঙ্ক ইউ বিতানদা!” বলল সাগ্নিক।
“গ্যাস খেয়ে গেলি তো সাগ্নিক!” মিমি বলল সাগ্নিককে। হেসে উঠল সবাই। মিমি বলতে থাকল, “বিতানদার সময় হবে না। তুই কাঁদবি বলে বলে দিল!” আবার হাসল সবাই।
“এই না না!” বিতান একটু লজ্জা পেয়ে বলল, “সত্যি বলছি।” সাগ্নিকের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি করো তো অ্যারেঞ্জ!”

সূর্যের অনুপস্থিতিতেও রাত্রিরে ঢেউগুলোকে বুঝতে পারছে বিতান। রুমে জানলার পাশে বসে দেখছে সকালের মতই ঢেউ দেখছে সে। খালি সকালের মত জানলাটা খোলা নেই আর নেই সূর্য। ঢেউগুলো একবার এগিয়ে আসছে, আবার পিছিয়ে যাচ্ছে। হোটেলের এতটা কাছে সমুদ্র যে পরিষ্কার বুঝতে পারছে। আর দেখতে বেশ ভালো লাগছে। হঠাৎ তার মনে হল যদি ঢেউগুলো ক্রমাগত এগিয়ে আসত, তাহলেও কি সমুদ্রকে ভালো লাগত এত?  তাহলে তো সমুদ্র আগ্রাসী হয়ে সবকিছু গ্রাস করে নিত। বিতানদের জীবনটাও কি তাই হয়ে যাচ্ছে না। তারা যেন এগিয়েই চলেছে ক্রমশ। এই এগোনোর মাঝে যেন নিজেদের খুশিকে গ্রাস করছে তারা।
“বিতান!” পিউয়ের মৃদু শব্দে পিছনে ফিরল সে। রুমের ভেতর এখন হাল্কা একটা আলো। আলোর থেকে অন্ধকারই যার বেশি। সেই আলোয় পিউকে দেখে তার শরীরে একটা নতুন ভালো লাগা জেগে উঠল। মন ফিরে গেল অতীতে। কয়েক বছর আগের অতীতে।

পিউয়ের ঢেউ খেলানো চুলগুলো একপাশে জড়ো করে তার একটা বুকের ওপর রাখা। সেই চুলে চিরুনির মত আঙ্গুল বোলাচ্ছে সে। কপালে তার ছোট্ট একটা টিপ। মাথায় ছোট্ট করে লাগান সিঁদুরের দাগ। হাতে শুধু শাঁখা আর পলা। কত বছর অপেক্ষার পর এভাবে তাকে প্রথমবার দেখেছিল বিয়ের পর। বিয়ের পরে প্রথম সেই রাত ছিল অন্য এক উন্মাদনার রাত।  তারপরে পিউয়ের সাথে এই কয়েক বছরে অনেকবার অন্তরঙ্গ হয়েছে বিতান। কিন্তু শুরুর সেই দিনগুলোর মত পিউকে ভালো করে দেখা হয়নি তার, শুধুই দুটো শরীর এক হয়েছে বহুবার। আজ অনেকদিন পর ভালো করে দেখল তাকে, দুচোখ ভরে দেখল তাকে। এই কয়েক বছরে তাদের মধ্যে শারীরিক দুরত্বটা কমেই যেন তাদের মধ্যেকার দূরত্বটা বেড়ে গেছিল অনেক। আজ আবার সেই দুরত্ব কমে আসতে থাকল।


ছবি – লেখক

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

3 Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।