ভালোবাসা ও খিদে

লেখক: মিতা ঘোষ

– ওরে ও বৌ, ও নবাবের ঝি…বলি দিনদুপুরে কার স্বপ্ন দেখছিস লো? বাগান থেকে ডেকে ডেকে গলা যে চিরে গেল। একটা সাড়া নেইকো!! এই বুড়ো শরীলে আমি এত টেনে আনতে পারি!!

একগাদা পাতা-পুতা কাঠকুটো নারকেল দড়ি দিয়ে বেঁধে টানতে টানতে নিয়ে এসে উঠোনে ফেললো অলোকের মা। শতছিন্ন কোঁচড়ে কিছু বুনোকুল।

বৌ নতমুখে চুপ। তার চোখ তখন হাতে ধরা প্লাস্টিকের ক‍্যারিব‍্যাগে স্থির। সাদা সি-থ্রু প্লাস্টিকের মধ্যে মাংস জাতীয় কিছু দেখা যাচ্ছে।

– বলি তোর হাতে ওটা কি? মাংস বলে মনে হচ্ছে!! পেলি কোয়ানে?
শাশুড়ির চোখ চকচকে!!

– তোমার ছেলে দিয়ে গেল। দুটো পেঁয়াজ রসুনও দিয়ে গেছে। বলেছে ঝাল ঝাল কষা কষা করে রান্না করে রাখতে। ফিরে খাবে।

-আ লো মুখপুড়ী। বাপের থনে কিছুই শিখে আসস নাই!! ফিরে খাবে কইতে নাই রে মা। অনেক দিন পর ভালো-মন্দ খাবারের আশায় গলা নামালো বুড়ি।

-তা রান্দবি কি দিয়া? ঘরে ত‍্যাল-তুল কিছু আছেনি!! শুধোয় বুড়ি জিভে চলে আসা জল সামলে।

-ইট্টুসখানি আছে গো মা। আজকের মতো হয়ে যাবে। তোমার ছেলে তো আজ কাজ পেয়েছে। ওই খালের ধারে গাঙ্গুলীদের বাগানে আজ পিকনিক হচ্ছে কিনা। সেখানে জোগাড় দিচ্ছে রাঁধুনীর।

-অ। তা রাঁদুনীটি কে? বিশ্বেস বাড়ির চরণ তো? ও আবার রাঁদতি জানলে কবে? ডাকতো আমারে। দেকিয়ে দিতুম খাসির মাংস রান্না কেমন করে করতি হয়।

-তুমিও যা বলো মা!! ওখানে অনেক লোকজন মিলে পিকনিক করছে। প্রায় তিরিশ জনের রান্না। তোমায় দিয়ে হয় কখনো? তারপর আজ একটা উৎসব আছে। ভ‍্যালেন্টাইন ডে! ছেলেপিলেরা সব মদ-টদ খাবে। তোমাকে ডাকলে ওদের অসুবিধে হবে না!!

-অ, তা ভালো হইয়েছে। তুমি এখন দুটি রান্দন করে আমারে উদ্ধের করো মা। বড়ো খিদে নেগিচে। এই মাংসের কতা শুনি খিদেটা কেমন বেড়ি গেল। আজ চাল দুটি বেশী নিয়ো বুজলে। আচে তো ঘরে বাড়তি চাল?

-আছে গো মা। চিন্তা কোরো না। এইতো তুমি জ্বালানি এনে দিয়েছো। এখনই ভাত বসাই।

ক্ষুদ্র একটি গ্ৰামের মধ্যে দুটি আলাদা পাড়া। এক পাড়ায় কোনো একসময়ে পূর্ব পাকিস্তানের ছিন্নমূল মানুষেরা এসে ঘর বেঁধেছিল। সেটি মুখ‍্যত বাঙাল পাড়া নামে পরিচিত। আরেক পাড়ায় জন্মাবধি স্থায়ী বাসিন্দা সব। এদেশীয়। তবে তাতে করে দুই গোষ্ঠীতে বড়োসড়ো কোনো সমস্যা কখনোই দেখা দেয় নি। ওই বাঙালপাড়ার মানুষেরা এপার বাংলায় এসেছিল সর্বহারা হয়ে। তাদের মধ্যে অনেকেই আর্থিক ভাবে থিতু হলেও বেশিরভাগ মানুষ এখনো কোনমতে জীবনযুদ্ধে টিঁকে আছে। অলোকের মা তার মধ্যে অগ্ৰনী। স্বামী হারা অসহায়া মানুষটি বাংলাদেশ থেকে নিঃসম্বল হয়ে কেবল দু’বছরের সন্তান অলোককে নিয়ে কোনোভাবে এই গ্ৰামে এসে পড়েছিল। উদ্বাস্তু কোটায় দু-কাঠা জমিও পেয়েছিল। কিন্তু খাদ্যের সংস্থান করতে পারেনি। এ গ্ৰামের একেবারে শেষপ্রান্তে যেখানে গ্ৰামের বুকচিরে ছলছল করে ছোট্ট একটি খাল বয়ে গেছে, সেখানে কোনমতে একটি খড়ে ছাওয়া মাটির একচালা ঘরে মা-ছেলের মাথা গোঁজার জায়গা। উঠোনে গর্ত করে উনুন তৈরি করে রান্নার ব‍্যবস্থা। এখন আবার বোঝার উপর শাকের আঁটির মতো জুড়ে বসেছে এই নতুন বৌ। অলোকের মায়ের জায়গা হয়েছে একচিলতে বারান্দায়, প্লাস্টিক দিয়ে ঘিরে। মা-মরা,বাপ-খেদানো মেয়েটিকে যখন অলোক হঠাৎ করেই ঘরে এনে তুললো তখন অলোকের মা তার বাপ-বাপান্ত করেও কেমন যেন মায়ায় পড়ে মেনেও নিলো।

মেয়েটি বামুন পাড়ার হরনাথ চক্রবর্তীর প্রথম পক্ষের একমাত্র সন্তান। হরনাথ আর্থিক ভাবে যথেষ্ট বর্ধিষ্ণু। হরনাথের এ পক্ষেরও তিনটি সন্তান। বড়মেয়ে কুসুম বড়ো শান্ত বুদ্ধিমতী মেয়ে। গ্ৰাম থেকে তিন কিলোমিটার দূরে  এলাকার একমাত্র গার্লস স্কুলের এগারো ক্লাসের ছাত্রী ছিল সে। স্কুলে যাবার সংক্ষিপ্ততম রাস্তা হলো ওই খালপাড়। সেই রাস্তাতেই যাতায়াতের পথে অলোকের সঙ্গে তার প্রায়শই দেখা হয়। না না…এরমধ্যে প্রেমের সম্পর্ক খুঁজতে যাবেন না যেন। নিতান্তই পাড়াতুতো পরিচিতি। এ কুসুম দেখতেও কোনো আহামরি নয়। সৎ মায়ের চক্ষুশূল মেয়েটি পড়ার সময়টুকু বাদ দিয়ে সারাদিন গৃহকর্মে ব‍্যস্ত থাকতো, যদিও তাতে পরিস্থিতি কোনদিনই কুসুমের অনুকূল হয়নি। অলোক কাজ করতো কুসুমের স্কুলের কাছে একটা প্লাস্টিক কারখানাতে। যাতায়াতের পথে কখনো কখনো কুসুমের সঙ্গে গল্প করতে করতে ওকে স্কুল পর্যন্ত এগিয়ে দিতো। ভালো লাগতো কুসুমের ওই সময়টুকু। কিন্তু সেকথা কখনো মুখ ফুটে বলেনি সে অলোককে। কিন্তু গ্ৰাম সমাজ বলে কথা। লোকমুখে বদনাম ছড়াতে এতটুকুও সময় লাগেনি। কথা কানে গেল হরনাথ চক্রবর্তীর। তার দ্বিতীয় পক্ষই তুললো সে কথা। কুসুমের পড়া বন্ধ হয়ে গেল প্রথমেই। তারপর ঘরের বিচারে শাস্তির ব‍্যবস্থা। বয়সে দেড়গুণ বড়ো সৎমায়ের তুতো ভাইয়ের দ্বিতীয় পক্ষ হবার। না, আর সহ্য করেনি কুসুম। এককাপড়ে বেরিয়ে এসে আশ্রয় চেয়েছিল অলোকের মায়ের কাছে। মানুষের মনের মতো বিচিত্র জিনিস বুঝি আর দুটি নেই। যে অলোকের মা মুখরা, দুর্জন বলে পুরো গ্ৰামে কুখ্যাত, কী জানি কী কারণে মাতৃহারা মেয়েটিকে জায়গা দিলো। গ্ৰামসমাজের মুখ চাপা দিতে পাড়ার কালীমন্দিরে নিজে দাঁড়িয়ে ছেলের সঙ্গে বিয়ের ব‍্যবস্থাও করলো। চক্রবর্তী মশাইও বিনে পয়সায় ঘাড় থেকে মেয়ে নামাতে পেরে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। না, তিনি আর মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেননি। মেয়ে বাঙাল ঘরে বিয়ে করেছে এই অজুহাতে। তাওতো সে প্রায় একবছর হতে চললো। তারপর থেকে অনটনে থাকলেও মানসিক ভাবে তারা খুব ভালো আছে। বলতে নেই, অমন দুর্মুখ অলোকের মায়ের কাছে কুসুম হারিয়ে যাওয়া মায়ের স্নেহও পাচ্ছে। এখন তো আবার সংসারে নতুন সদস্য আসার সম্ভাবনা দেখা গেছে। সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা কুসুম।

-অ বৌ। অলোক ফিরলো? বেলা যে গড়িয়ে যেতে বসেছে। তিনটে বাজতি গেল। দেকো দিকি কান্ডি ছেলের! ভরা পোয়াতি বৌ এতবেলা অবধি না খেয়ে বসি আছে.. এট্টু হুঁশ নেই!!

-কি জানি মা! সত্যি বলতে আমার একদম ইচ্ছে ছিল না, এই কাজটা তোমার ছেলে নিক। কি করবে বলো!! কারখানা উঠে যাবার পর থেকে দেখছো তো অন্য কাজের জন্য কম চেষ্টা করছে না। কিন্তু পাচ্ছে কই? আমার মনে হয় কি জানো মা, আমি মানুষটাই অপয়া গো। এই দেখো। এতদিন তো তোমাদের কোনরকমে চলে যাচ্ছিল। আমি এ বাড়িতে ঢুকে পড়ে যত গোল বাধালাম।…ম্রিয়মাণ কুসুম।

-হ‍্যাঁ লো। তুই তো আমার গুণীন এয়েছিস ভারি!! বিরক্ত অলোকের মা। -আমায় খেতে দে বাছা। বড়ো খিদে পেয়েচে। আমি আর বসে থাকতে পারচি নে। বলি, কুলের অম্বল করেচিস তো? অনেক কান্ডি করি তোর জন্যি দুটো কুল পেড়ে এনিচি। 

-হ‍্যাঁ গো মা। করেছি। তুমি আমার জন্য এত কষ্ট করে কুল পেড়ে আনলে, আর টক বানাবো না!! আমি তো সব ভাত ওই অম্বল দিয়েই খেয়ে নেবো।
উচ্ছ্বসিত কুসুম। -তুমি এসো। তোমাকে খেতে দিই।

খেতে বসেছিল অলোকের মা। খাওয়াটা শেষ করতে পারেনি। চরণ এলো ছুটতে ছুটতে।  সঙ্গে তারস্বরে চিৎকার। পিকনিকে গুলি চালিয়েছে কোনো এক মাতাল। অলোকদের বাড়ির পরেই টানা বাঁশবন আর গাঙ্গুলীদের বিশাল বাগান। বাগান না বলে জঙ্গল বলাই ভালো। হরেক রকম ফলের গাছের মধ্যে অযত্নে বাড়া ঝোপঝাড়। সেখানেই কিছুটা জায়গা পরিস্কার করে আজ পিকনিক হচ্ছিল। গাঙ্গুলীরা এ পাড়ার মধ্যে সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত পরিবার। তাদের বাড়ির আত্মীয় স্বজন বন্ধুবান্ধব নিয়ে এই পিকনিকের আয়োজন। সেখানেই কী জানি কী নিয়ে গন্ডগোল বেঁধেছিল নিজেদের মধ্যে। কেউ একজন গুলি চালিয়েছে। অলোক মাছভাজার থালা নিয়ে আসছিল ওদের কাছে। বুলেট ওর পেট ফুঁড়ে বেরিয়ে গেছে। ধরা পড়ার ভয়ে সবাই পালিয়েছে স্পট ছেড়ে। অলোককে হয়তো এখনো বাঁচানো সম্ভব হাসপাতালে নিতে পারলে। তাই চরণ ছুটে এসেছে পাড়ার ছেলেদের ডাকতে।

সন্ধ‍্যে নেমে গেছে অনেকক্ষণ। সারাদিন যত দৌড়াদৌড়ি, হাসপাতাল,থানা পুলিশ করে অলোকের মা বাড়িতে ঢুকেছে। বলতে নেই, পাড়ার ছেলেরা খুব সাহায্য করেছে তাকে। না,অলোককে ওরা ফেরত আনতে পারেনি। লাশকাটা ঘরে পোস্টমর্টেম হবার অপেক্ষায় পড়ে আছে সে। ঘরে একা কুসুম, ভরা পোয়াতি। অলোকের মায়ের বড়ো চিন্তা হচ্ছিল তাকে নিয়ে। ছেলে তো চলেই গেছে, যেটুকু রেখে গেছে, তা যেন রক্ষা করতে পারে, বারবার ঠাকুর ডাকছিল সে। ঘরের দরজা বন্ধ। ডেকে ডেকে কুসুমের সাড়া না পেয়ে ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে ফেললো অলোকের মা। ঘরের এক কোণে থালা হাতে গোগ্ৰাসে ভাত খাচ্ছে কুসুম। মাংসের ঝোলের বাটি পাশে রাখা। শাশুড়িকে দেখে থতমত খেলো সে। চোখ দিয়ে উপচে এলো জল। রুদ্ধস্বরে বললো….

“বড্ডো খিদে পেয়ে গেছিলো গো মা…”


লেখকের কথা: মিতা ঘোষ
লিখতে ভালোবাসি।পড়তেও। আর ভালোবাসি মানুষের ভালবাসা পেতে। কিছুদিন আংশিক শিক্ষক হিসেবে কলেজে বাংলা সাহিত্য পড়ানোর সুযোগ হয়েছিল। কবিতা লিখতে আর আবৃত্তি করতেও ভালো লাগে।

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

5 Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।