লেখক : বদরুদ্দোজা শেখু
“চলো আজ বৃষ্টির শহরে ঘোরা যাক কিছুক্ষণ
হেঁটে হেঁটে ,চলো একাই বেরিয়ে যাই ,ফুটপাত
ধ’রে ভিজে ভিজে হেঁটে হেঁটে নোংরা জলের দাগে
কদাকার হবে হোক মসৃণ চরণ ,ধরা যাক ,বিবর্ণ স্যাণ্ডেল-জোড়া
ফুলে ফেঁপে ঢ্যাপসা চর্মের পিণ্ড হবে ; পরিষ্কার
ধোয়া ট্রাউজার হবে পিচপিচে কাদার পিচকারি-খাওয়া দু’নলা কামান
জবরজং দম্ভ রহিত । এ শহরে
বস্তুতঃ এমনই হবে ,তবু
চলো আজ বৃষ্টির শহরে ঘোরা যাক কিছুক্ষণ
হেঁটে হেঁটে ,বৃষ্টির আদর মেখে গুমোট শরীরে “
—ইত্যাকার ইতস্ততঃ ভাবতে ভাবতে ধীরে নেমে গেলাম রাস্তায় ,
হাঁটবো সবুজ মাঠের কিনার ঘেঁসে , বৃষ্টি-ভেজা
স্নিগ্ধ-শ্যাম দৃশ্যের দাক্ষিণ্য নিতে নিতে চ’লে যাবো যতদূর যাওয়া যায় আজ ।
সমাজের কে-এক বিশিষ্ট ব্যক্তি গত হয়েছেন অকস্মাৎ
তাই অফিস কাছারি জুড়ে’ হৈ হৈ ছুটির হিড়িক
প’ড়ে গেছে , কর্তব্যের বন্দীত্বে বিদায় দিয়ে নেমেছে সবাই
এক জোটে রাজপথে ;জৈবনিক উৎসবের অধীর উষ্ণতা
মেখে বন্ধুদের কেউ গেল থিয়েটারে ,
সার্কাস সিনেমা কিংবা প্রদর্শনী কেউ ,
কেউ যাবে ভিক্টোরিয়া সূর্যগন্ধী কামের মাধবী ভাড়া নিতে
ঘণ্টা আর পর্বের হিসেবে । লক্ষ্য কারো
মক্ষিরাণী প্রেমিকার সাথে মৃদুমন্দ গুঞ্জরণ
রেস্তোরাঁর আড়াল-কেবিনে কিংবা প্রাপ্ত-বয়স্ক ফিলীমে ,
কেউ ফিরে যায় বাসা দিনভোর স্বস্তির আশায় ।
আপাততঃ তেমন কিছুই লক্ষ্য নেই
আমার ,বস্তুতঃ আমি ছেড়েছি মনের হাল বৃষ্টির শহরে ;
আকাশের কাছে কোনো নন্দন-তাত্ত্বিক স্বপ্ন ভাড়া পাবো ব’লে
আনমনে হেঁটে যাই ,যেতে যেতে সব
ট্রাফিক সিগন্যালে ঝুলিয়ে যাই লাল নীল হলদে সবুজ
ঘুড়ি—ভিজে ভিজে ঝুলছে গাছের ডালে , রাস্তা উপচানো জলে
খেলার মজায় ভাসালাম কাগজের নৌকা কতো ,
দেখতে দেখতে সব হ’য়ে গেল এক ঝাঁক বান-ভাসি গাঙের মরাল ,
অকস্মাৎ উড়ে গিয়ে চুপসে-একসা-হওয়া মাঠের শালিক
হ’য়ে গেল আকাশের ধূসর ফরাশে ,চৌরাস্তার চোরাগর্তে নেচে উঠলো ছলাৎ
শিশু বয়সের স্বপ্নের রূপালি মাছ স্রোতের উজানে যাওয়া
কেঁচোলের বাউস্ত নালায় ,যেতে যেতে
জলমগ্ন ময়দানে ইচ্ছামতো চালালাম পৈত্রিক লাঙল ,
পুঁতে দিলাম সবুজ গোছাগোছা আমনের চারা
অনাবৃষ্টি কবলিত দেশের আকাল দু’হাতে তাড়াবো ব’লে ,
আশপাশ মূর্ত্তিগুলোর মাথায় পরিয়ে দিলাম বীজতলার বেঢপ কাক-তাড়ুয়ার ফেটি ,
শহীদ মিনার চেপে ধরলাম আব্বাসের গান—
‘ ও বা-জান চল্ যাই চল্ মাঠে লাঙল বাইতে ‘ ;
সে গানের সুর বৃষ্টির সুরের সাথে মিলে মিশে শহরের
অলিগলি ঘুরে ঘুরে হারালো বিশাল জনরবে ।
আশঙ্কা-মিশ্রিত সেই পুরাতন পরিচিত কণ্ঠস্বর—
‘ ফিরে আয়, খোকা তুই ভিজিসনে ,ওরে
ঘরে আয় ,খোকা তুই অনর্থক অসুখ বাধাবি’ —
মনের নেপথ্যে ধ্বনিত হ’লেও শোনা যায় না এখানে ভাটপাড়ার বিস্তর দূরত্ত্ব উজিয়ে ।
বস্তুতঃ আমার আপাততঃ ফেরার তাগাদা নাই কোনো ,তবু
হাঁটছি কোথাও পৌঁছানোর লক্ষ্য নাই ব’লে । বৃথা হাঁটতে হাঁটতে কতক্ষণ এসে গেছি এভেন্যূর ফুটপাতে
কিছু অহরহ অনিশ্চিত জীবনের মুখোমুখি ।অকস্মাৎ অপরূপ
স্বপ্নের চত্ত্বরে এক বীভৎস শকুন
ডানা ঝাপটিয়ে এসে বসলো জাঁকিয়ে , খুঁটে খেতে
লাগলো ভীষণ শতাব্দীর ফসিল-জমানো আমার পাঁজর ,
হৃদয়ের ফুটপাতে কুঁকড়ে’ কুঁকড়ে’ উঠলো দুর্দশা-ক্লিন্ন বৃষ্টি-ভেজা করুণ শহর ।
অথবা রূঢ় বাস্তবতার হঠাৎ ধাক্কায় আমিই কেন্নোর মতো কুঁকড়ে’ গেলাম ।
( ২ )
অস্তিত্ত্বের আনাচ-কানাচ আঁশটে সোঁদা গন্ধ ,
লাঙল বলদ কোথায় গেল চক্ষে ঘুরে ধন্ধ ;
স্বপ্ন-মরাল মুখ থুবড়ে’ নর্দমাতেই বন্দী ,
আস্তাকুঁড়ে উঠলো নেচে শিবের ভৃঙ্গী নন্দী
রক্ত-মাংস আছে কি নেই , সারা অঙ্গেই অস্থি ,
অধঃপাতে খিঁচোচ্ছে দাঁত ময়লা গলির বস্তি ।
খিস্তি খেউড় খাচ্ছে বেতাল বদ-খেয়ালী বাদলা–
হাতে নাই যে মুখে পোরার কানাকড়ি আধলা ;
যে ফুটপাতে ক্ষুধার দাঁতে দীর্ণ পরাণ ক্লিন্ন
উড়ছে তাতেই ফূর্ত্তি-ফানুস আতসবাজির চিহ্ন ,
দিগ্বিদিকে ছুটছে বেতাল মানুষ যন্ত্র জন্তু ,
দুঃখ ধুনে’ বুনছি মূর্খ শিল্পকলার তন্তু ।
লোভের লালা ঝরছে পথের কুষ্ঠরোগীর পাত্রে
বিক্রি হচ্ছেন ফুটেই ডিফো রবিঠাকুর সার্ত্রে
জলের দরে অবহেলায় ,পর্ণো মোটা অর্থে—
হিড়িক দিয়ে ঢুকছে সবাই অন্ধ-গলির গর্তে ।
ছেঁড়া জুতোর গর্তে মুচি স্বপ্ন জড়ো করছে ,
বাটার দালাল নতুন নোটে টাকার টিকি ধরছে ,
দেয়াল-থামে যত্রতত্র বিজ্ঞাপনের বন্যা ,
যাচ্ছে ভেসে ফিল্মী ঢঙে ভিস্তি-বুড়োর কন্যা ,
যুবক-বুড়োর চক্ষু কাড়ে বিচ্ছুরিত বহ্নি
সজ্জাধারী ফ্যাসান-পরী বগল-কাটা তন্বী
লোভের আগুন ক্ষুধার আগুন লাগলো ,বাজার অগ্নি
ক্রেতার বুকে মারছে লাথি পুঁজিপতির লগ্নি ;
করছে সবাই কৌলীন্যের জাঁকজমকের শব্দ ।
ইতস্ততঃ যাচ্ছে শোনা দূষণ দূষণ রব্দ ,
মুচকি হেসে দিচ্ছে তুড়ি স্ফীতকায় কুক্ষি ;
দুঃখীরামের ফুক্কি নেতা ওড়ান কথার মুক্ষি
পথের সভায়—- শান্তিবাদী জনদরদী ক্ষুদ্ধ ,
স্বৈরাচারের লাথি খাচ্ছেন সর্বহারার বুদ্ধ
ভোটের প্যাঁচে,— ভাবখানা এই ,রাজভবনের পার্কে
লোহার ঘোড়ায় সওয়ার দেখি ধর্ম-অবতারকে ,
তীব্র ক্ষুরের ভৌতিকতায় পথের দুপাশ চূর্ণ
হ’য়ে যাচ্ছে , তবু চৌদিক হচ্ছে জনপূর্ণ
আজব দৃশ্য দেখার মজায় , বাজছে স্নায়ুতন্ত্রী ,
হঠাৎ দেখি দৃশ্য ভেঙে সাইরেনে যান মন্ত্রী ,
শব্দে শুনি রাজনীতি ও অর্থনীতির টেক্কা
দারিদ্র্য আর দুঃখ-দশার উলঙ্গ উপেক্ষা ।
কী উৎসবের উত্তেজনায় জুড়ে চোখের বর্গ
কলকাতাকে লাগেই তবু মর্ত্য-ভূমির স্বর্গ ,
যা হোক , তবু পথেই ঘুরে প্রেমের মরাল মক্ষি !
বদলে’ গেছেন ব্যাপার স্যাপার দেখেই ভাগ্যলক্ষ্মী :
সবাই ক্যামন্ ভদ্র এবং কেউ কারো নেই গ্রাহ্যে
আত্ম-শ্লাঘার বাতিক-গ্রস্ত শিবঠাকুরের রাজ্যে ,
মানুষগুলোর মতোই তিনি শহর-সুখের গন্ধে
গ্রাম ছেড়েছেন , চান না যেতে মাঠের খানাখন্দে ,
ভাদর মাসের আদর দিয়ে ঢেলে দিচ্ছেন বৃষ্টি।
সবাই চেঁচায় বদমেজাজে ‘একি অনাসৃষ্টি ?
শহরটা কি চাষের জমি ? মাঠ জ্বলছে রুক্ষ ,
লক্ষ্মীছাড়া মেঘগুলো কি দেখতে পায়না দুঃখ ? ‘
— মাঠের মায়া শহরে কই ? বিলাস-বহুল পণ্য
আছে কেবল হরেক কিসিম পয়সা-অলার জন্য ,
পয়সা ছাড়া শিশুর মুখেও নেই দু’মুঠো অন্ন ,
নেই ছাউনি মাথার উপর ; তবু বাঁচার জন্য
শহর ছাড়তে আমরা নারাজ ।ধন্য শহর ধন্য!
( ৩ )
শঙ্কিত সজাগ সেই কণ্ঠস্বর
‘ ফিরে আয় , খোকা তুই , ভিজিস্ নে ওরে—‘
শোনা যায় না এখানে আর , তবু কা’র হাহাকার
বেজে উঠে শব্দের নিবিড় এক সুনিবিড় শব্দময়তায় ?
আমি আর খোকা নই , তবু কা’র আশ্রয়ের ছায়া
খুঁজে’ ফিরি সবখানে ? বিদেশ বিভুঁইয়ে অকস্মাৎ
অসহায় অসুখের আতঙ্ক ঘনায় , ধীরে ধীরে
বড়ো অনাসক্ত হ’য়ে উঠে মন ,হেঁটে যাই
শিথিল চরণে ।
মহাপুরুষগণের মন্ত্রণায় মানুষকে ঈশ্বরের অংশ-নিধি জ্ঞানে
বৃষ্টিকে কৃষক-চোখে অন্নজলের নিশ্চিত প্রতিশ্রুতি জেনে
শহরকে শিল্প-সংস্কৃতির পীঠস্থান ভেবে
যতবার পথে নেমে সুহৃদ বানাতে চাই
ততবার অবশেষে ব্যর্থ হই শুধু ,
সংখ্যাহীন জনতার ব্যস্ততার চাপে ,ক্ষান্তিহীন
বৃষ্টির ব্যাজার ক্ষতে পূঁজ-পড়া ঘিনঘিনে পথে ,ইতস্ততঃ
আদর্শের অপমৃত্যু আর
হৈ হট্টগোল লাউডস্পীকার ও রুচির বিকারে
ক্রমশঃই বিতৃষ্ণায় ক্লান্ত হ’য়ে পড়ি , চটক-সর্বস্ব উৎসবের
উত্তেজনা ও নোংরা আবর্জনার বিরক্তিতে ভরপুর , দূষণ-পীড়িত
মহাকাল কসাই-তাড়িত দল -ছুট ছাগলের মতো ধাবমান
স্বাতন্ত্র্যের পরিচয়-হীন
স্নায়ুচর নৈঃসঙ্গ্যের নিদাঘ-জর্জর ; অকস্মাৎ মনে হয়
ব্যস্ত জংশনের জন-চক্ষুর অলক্ষ্যে চলমান মন্থর মালগাড়ির মতো
আমি আর আমার প্রহর ।।
লেখক পরিচিতি : বদরুদ্দোজা শেখু
বদরুদ্দোজা শেখু -র জন্ম ১৯৫৫ সালের ২রা ফেব্রুয়ারী মুর্শিদাবাদ জেলার সাগরদিঘি থানার ঠাকুরপাড়া গ্রামে। ক্ষুদ্রচাষী সাইফুদ্দীন সেখ ও বিবি ফজরেতুন্নেশার সন্তান। দারিদ্র্যের মধ্যেই গণিতশাস্ত্রে স্নাতকোত্তর। তাঁর এ যাবৎ প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ অলৌকিক আত্মঘাত,দুঃস্বপ্নের নগরে নিভৃত নগ্ন, শব্দ ভেঙে সংলাপ, আরো থোড়া দূর এবং পরী ও পেয়ালা । তিনি সম্প্রতি পদাতিক কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় স্মৃতি পুরষ্কার ২০২০ অযতম বিশেষ সেরা সম্মাননা পেয়েছেন। এছাড়া বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা গোষ্ঠী থেকে অনেক দৈনিক ও সাপ্তাহিক সেরা সম্মাননা পেয়েছেন।
bhalo laglo