তলোয়ার নির্মাতা ও বিক্রেতা

লেখক: রানা চক্রবর্তী

প্রাচীনকালে, সিরিয়া রাষ্ট্রের দামাস্কাস গোটা বিশ্বে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ তলোয়ার তৈরির জন্য বিখ্যাত ছিল। দামাস্কাসের তলোয়ার তৈরি শিল্প ও বাণিজ্য এতটাই উৎকর্ষ ছিল যে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ দামাস্কাস থেকে তলোয়ার নামক যুদ্ধাস্ত্রটি ক্রয় ও সংগ্রহ করত। অথচ দামাস্কাসের এই উৎকৃষ্ট তলোয়ার তৈরির আসল বীজটি বপন হয়েছিলো প্রাচীন ভারতে; এবং এই উৎকৃষ্ট দামাস্কাস তলোয়ারের সরাসরি যোগসূত্র ছিল প্রাচীন ভারতের ধাতুবিদ্যার সাথে। এই বিষয়টি আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, ১৯০৯ সালে তাঁর লিখিত ও প্রকাশিত ‘এ হিস্টোরি অফ হিন্দু কেমিস্ট্রি, দ্বিতীয় খন্ড’, গ্রন্থে সুস্পষ্ট ভাবে তথ্য প্রমান সমেত লিখে গিয়েছেন।

বেশ কয়েকজন ইউরোপীয় ও ভারতীয় লেখকদের চর্চা থেকে একথা জানা যায় যে প্রাচীন ভারতের শল্য চিকিৎসা সমসাময়িক সভ্যতাগুলি থেকে অনেক উন্নত ছিল। চরকসংহিতা ও সুশ্রুত সংহিতা থেকে প্রমাণ মেলে সে আমলে ভারতীয়দের আয়ত্তে ছিল নাকের কাটা অংশের প্রতিস্থাপন সহ বিভিন্ন প্রকারের ‘অপারেশন’। অর্থাৎ মানবদেহের অঙ্গসংস্থান সম্পর্কে তাঁদের সুস্পষ্ট ধারণা ছিল। সেযুগে এনাটমি বিষয়ে ভারতীয়রা পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন যা বিনা শল্য চিকিৎসার এত উন্নতি সম্ভব ছিল না।

সার্জারির কাজে ব্যবহৃত হত বিভিন্ন রকম ছুরি ও নানা যন্ত্রপাতি। এ বিষয়টিকেই আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র যুক্তি বিশ্লেষণে দেখালেন প্রাচীন ভারতের ধাতুবিদ্যার উন্নতি হিসেবে। সার্জারির কাজে দেহ ব্যবচ্ছেদকারী ছুরি বা যন্ত্রগুলির অত্যন্ত সূক্ষ্মাগ্র হওয়া প্রয়োজন। অতএব সেযুগে নানা ধাতুকে পরিমিত পরিমাণে মিশিয়ে বিভিন্ন ধাতু সঙ্কর তৈরি করা এবং লাগাতার পিটিয়ে সরু ধারালো ধাতুর পাতে পরিণত করার জন্য এদের মধ্যে কোন মিশ্রণগুলি আদর্শ ছিল তা ভারতীয়দের জানা ছিল। তাই স্ক্যালপেল বা ল্যানসেট-এর প্রাচীন ভারতীয় সংস্করণের অস্তিত্ব অবশ্যই ধাতুবিদ্যায় পারদর্শিতার প্রমাণ ।

ধাতুবিদ্যার কথা এলে যে জিনিসটি নিয়ে আজও ভারতীয়দের গর্ব করা সাজে তা হল উটজ স্টিল (wootz steel)। প্রায় ছশো খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে বর্তমান তেলেঙ্গানা সহ দক্ষিণ ভারতের বেশ কিছু স্থানে এই ইস্পাত তৈরি হত। পরবর্তীকালে তা রপ্তানি করা হত বর্তমানে সিরিয়ায় রাজধানী দামাস্কাস সহ আরবের অন্যান্য জায়গায়। এই ভারতীয় উটজ স্টিলের খ্যাতি ছিল বিশ্বজোড়া। ভারত থেকে রপ্তানিকৃত উটজ স্টিলের চাঙর থেকে দামাস্কাসে তৈরি হত তলোয়ার। ইউরোপে তা প্রসিদ্ধ হয় দামাস্কাস স্টিল নামে। মধ্যযুগে ক্রুসেড চলাকালীনও ব্যবহার হত উটজ ইস্পাতে নির্মিত তরবারি। অস্ত্রের উৎকর্ষর কারণে প্রতিপক্ষকে হারিয়ে অনেক যুদ্ধে জয়লাভ হয়েছে বলেও জানা যায়। পারস্যদেশে একটি প্রবাদ তৈরি হয়েছিল, যুদ্ধ ক্ষেত্রে শত্রু সৈনিকের মাথা এক কোপে কেটে ফেলাকে তাঁরা বলত “জবাব-ই-হিন্দ” অর্থাৎ ভারতীয়দের (তৈরি অস্ত্রের) জবাব। এই ইস্পাতে এমন শান দেওয়া যেত যে, অস্ত্রের ওপর একটি চুল খসে পড়লেও নাকি তা দুভাগ হয়ে কেটে যেত – এরকম কথাও লোকমুখে প্রচলিত ছিল। এধরনের অতিকথনের মাঝেও একটি সত্য লুকিয়ে থাকে, তা হল, উৎকর্ষের চরম সীমায় উত্তরণই জন্ম দেয় এরকম অতিরঞ্জিত ‘মিথ’ এর। উটজ স্টিলের উৎপাদন ইংরেজ আমলেও দেশজ রাজ্যে হত। ইংরেজরা ব্যাপক মাত্রায় এর ব্যবসায়িক উৎপাদন করতে চাইলেও ব্যর্থ হয়। কারণ অতি উন্নতমানের ধাতু হলেও এর উৎপাদন পদ্ধতিটি ছিল নিতান্ত আদিম, ফলে ব্যবসায়িক দিক থেকে লাভজনক ছিল না। শিল্প-বিপ্লবোত্তর ইউরোপ থেকে আমদানিকৃত ইস্পাতের সাথে পাল্লা দিতে না পেরে একসময় বিদায় নেয় উটজ স্টিল। আশার কথা এই যে দক্ষিণ ভারতের স্বল্প কিছু আদিবাসীদের মাঝে এই পদ্ধতির প্রচলন রয়েছে, সেখান থেকে পদ্ধতিটি ভালো করে শেখবার চেষ্টা করছেন বর্তমানের কয়েকজন গবেষক।


তথ্যসূত্র:
এ হিস্টোরি অফ হিন্দু কেমিস্ট্রি, দ্বিতীয় খন্ড, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় (১৯০৯)


লেখকের কথা: রানা চক্রবর্তী
রানা চক্রবর্তী পেশায় সরকারী কর্মচারী। নেশা ইতিহাসের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা আর লেখালিখি। নিজেকে ইতিহাসের ফেরিওয়ালা বলতে ভালবাসেন।

One comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।